১৯৫০ সন ২৩ শে জানুয়ারী। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে বাড়ির অঙ্গন এ সামনের আঁতুর ঘর থেকে ভেসে এলো সদ্যজাত শিশুর ক্রন্দন। দিদিমা শাঁখ বাজিয়ে উলু দিয়ে সেই সদ্যজাতকে আবাহন করলেন এ পৃথিবীতে, তাঁদের সেই ছোট বাড়ি টিতে। শিশুটির পিতা অস্থির ভাবে পায়চারী করছিলেন, বলে উঠলেন, আমি কি এখনো ওখানে যেতে পারিনা, এ সব কি আপনাদের নিয়ম , কতবার বলেছি ও আমি মানিনা। ভিতর থেকে দাইমা বাইরে আসিলেন, ঘোমটায় মুখ ঢাকিয়া মৃদু হাসিয়া বলিলেন "পুত্র সন্তান , আজ থেকে তুমি ছেলের বাবা হলে গো , বাপ্ , যাও চিনি বাতাসা নিয়ে আইস।"
শিশুর প্রশস্ত ললাট , মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল, টুকটুকে ফর্সা, আর যে বয়সে চোখের দৃষ্টি ই আসেনা, তখন ই এ কেমন বড় বড় চোখে চারিদিক দেখছে। পিতা অবাক হয়ে নিজ পুত্রকে নিরীক্ষণ করতে লাগিলেন, তাঁর আরো এক কন্যা সন্তান আছে, এছাড়াও সদ্যজাত শিশু তিনি আগেও দেখেছেন, কিন্তু এমন দেবতুল্য পরিণত শিশু তিনি আগে কখনো দেখেননি। বুকের ভেতর টা কেমন যেন করে উঠলো ওনার , পাশেই ছিলেন ওনার শাশুড়ি , ছেলের দিদিমা, তিনি মেয়ে জামাইকে সম্বোধন করে বললেন, "দেখ আমাদের গরিবের ঘরে রাজা এসেছে।" "রাজা নয় মা, সাক্ষাত ভগবান এসেছেন। কিন্তু কেন তিনি আবার মনুষ্য জন্ম ধারণ করলেন, আবার তো তাহলে সব দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করে নীরবে চলে যেতে হবে।" বিড়বিড় করে বললেন পিতা। "এ কি বলছেন আপনি", মা এর চোখ ছাপিয়ে জল উপচে পড়ল ," সন্তান ভূমিষ্ঠ হাতে না হতেই আপনি, আপনি তার যাবার কথা বললেন , ছি ছি। এ কি অমঙ্গল এর কথা।" "না না স্বর্ণ এর থেকে মঙ্গল আর পুন্যের কিছু নেই , আমাকে ভুল বুঝনা। শোনো আমি ওর নাম দিলাম রনজিত , যে যুদ্ধ এ জয় লাভ করে জয়ী , সেই রনজিত।"
শুরু হলো শিশু রনজিত এর পথ চলা। মা দিদিমার রণ , বাবার খোকা আর দিদির ভাই। ছোট থেকেই অসাধারণ মেধা, পর্যবেক্ষণ শক্তি আর ধৈর্য্য ছিল তাঁর। কিন্তু দুষ্টু বুদ্ধিতেও কিছু কম যেতেন না তিনি , পাড়ার বড় রা তাঁর দৌরাত্ব্যে অস্থির হয়ে যেতেন। আর ছোটরা পেতেন আরো উত্সাহ। নিজেদের বিশাল আম, জাম , কাঁঠাল , কলা, নারকেল এর বাগান। তবু অন্যের বাগান থেকে ফল পেড়ে খেতে ছোটদের দল এর ছিল বেজায় উত্সাহ। পুকুর ঝাঁপানো, এ পার থেকে ও পার করা, গাছে গাছে ঘুরে বেড়ানো, গুলতির এক টিপ এ দূর থেকে লক্ষ্য ভেদ এ সব এ তার বেজায় উত্সাহ। শান্ত শিষ্ট মা, কিছুতেই ছেলেকে সামলাতে পারেননা, বাবা ধরে ফেললে, পিটুনি তো অবধারিত, কিন্তু ধরতে পারলে তো, দিদি অন্ত প্রাণ ছিল তাঁর। কিন্তু দুষ্টুমির সময় কাউকে ধরা দেবেনা সে, শুধু হি হি হাসি। আর দৌড়ে দৌড়ে পালানো। কিন্তু একজন এর ডাক কে উপেক্ষা করতে পারতেননা। তিনি হলেন দিদিমা। দিদিমা ডাকতেন ও না বেশি। উনি সব জানতেন, কোথায় আছে, কি করছে, সে ছিল ওনার আর নাতির মধ্যের একান্ত বোঝাপড়া। চুলে তেল মাখান, জোর করে স্নান করানোর জন্যে পুকুরে নিয়ে যাওয়া , সেখান থেকে তুলে আনা, খেতে বসানো, রাত্রে শুএ শুএ গল্প বলা এ সব ছিল দিদিমার কাজ।
সেই দুরন্ত , কিন্তু কখনো কখনো এমন শান্ত হয়ে যেত, যে বাড়ির লোক খুঁজতে বেরিয়ে পরতেন , ছেলে কোথায়, ছেলে কোথায়, গিয়ে দেখেন চুপ করে পুকুর ধারে গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসে কোনো বই পড়ছে তাঁদের রণ। সে পড়ার হোক কি গল্পের , বাহ্য জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যেত তাঁর বই হাতে পেলে।
(পরবর্তী অংশ পড়ুন )