Sunday, 13 May 2018

চাঁপা ফুল

কিছুদিন ধরে পুরোনো বেশ কিছু ছবি বারবার আমাকে পৌঁছে দিচ্ছিলো আমার ছোটবেলার দিনগুলোতে। আবৃতি, আঁকা, রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী , আর এই সব ভাবতে ভাবতেই ২৫ শে বৈশাখ এসে গেছিলো। যদিও কোনো দিনকে কখনোই আলাদা করে পালন করার খুব একটা পক্ষপাতী আমি নই।  সব দিন ই তো সমান। কাউকে মনে করার জন্যে আলাদা করে বিশেষ একটা দিন হয়না ঠিক ই। তবু ওই যে অভ্যাস, ওই এতোবছরের অভ্যেস এর বশে কি যেন এক উৎসবে মদির হয়ে থাকে, আমার ওই দিনটা। এ বছর ও তার ব্যতিক্রম হলোনা দেখলাম। 
aiims যাবার সময় একটা রাস্তা পরে , যেখানে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া না সোনাঝুরি না কি রবি ঠাকুরের অমলতাস, তা ঠিক জানিনা, কিন্তু ওই লাল আর হলুদ ফুলে দুধার ভরে থাকে। বাস থেকে যতটা পারা যায়, দুচোখ ভোরে দেখি ওই লাল হলুদের মাঝে দুপুরের রোদে ঝলসানো নীল আকাশটাকে, আকাশ তখন যেন আর ঝলসে যায়না, বরং ওই রং এর মাঝে সেও খুব নরম হয়ে মুচকি মুচকি হেসে তাকায়। 

সেদিন, ওই দাড়িওলা বুড়ো মানুষটার জন্মদিনের দিন আর কি, কিছুইনা, তবু যেন কি এক উৎসব এর ছোঁয়ায় আমার রাস্তা ভরে ছিল, কাজের ফাঁকে বারবার মন ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো। দুপুর ১২ তা নাগাদ দেখলাম, আকাশে মেঘ জমেছে, হালকা নয় , কালো কালো আবেশ মাখানো মেঘ , আসতে আসতে এগিয়ে আসছে। বুঝলাম দাড়িওলা মানুষটা তার এই ভক্তটিকে খালি হাতে ফেরাবেনা। এই সুযোগের অপব্যবহার করা যায়না। অতএব মনটাকে আর ধরে বেঁধে না রেখে বেরিয়ে এসেছিলাম, বাড়ি ফেরার কিছুক্ষনের মধ্যে, কালো মেঘ আরো আরো ঘন হয়ে এলো। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছিলো। 
কি এক অদ্ভুত ভালো লাগায় সমস্ত শরীর মন আচ্ছন্ন হয়ে চোখে জল এনে দিয়েছিলো হটাৎ। আমাদের চারপাশে এতো এত কিছু আছে? আমাদের কে মাতিয়ে রাখার জন্যে, ভাসিয়ে দেবার জন্যে এত আয়োজন, তবু শুধু আমরা বলি পাইনি, পাইনি। কে বলেছে, পাইনি? সব পেয়েছি। সব কিছু পরিপূর্ণ হয়ে আছে।
বৃষ্টি তখনো আসেনি, কিন্তু একটা মাতাল করা ঠান্ডা হাওয়া দূরে কোথাও বৃষ্টি হবার খবর নিয়ে এলো, জানিনা কেন কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো আমি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি। ভীষণ এক অন্য রকম অনুভব এ অনেক্ষন চুপ করে শুধু বসে রইলাম। বুঁদ হয়ে বসেছিলাম। তারপর ওই ঠান্ডা হাওয়া সর্বান্তকরণে অনুভব করতে করতে বৃষ্টি এসে গেল, দু এক ফোঁটা বৃষ্টি গায়ে পড়তেই এক অসম্ভব শিহরণ অনুভব করলাম। তখন ই, ওই বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে, বোধয় "রাইসেনা বেঙ্গলি স্কুল " থেকে ভেসে আসছিলো "হে নুতন দেখা দিক আরবার , জন্মেরও প্রথম ও শুভক্ষণ "......হাওয়াতে সব কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলোনা, বারবার শব্দ ভেঙ্গে গিয়ে যেন তাকে আরো মধুর করে তুলছিলো। এখানে তখন শুনছিলাম "আমার এ ঘর বহু যতন করে, ধুতেও হবে, মুছতে হবে মোরে "..... 
সন্ধ্যে হওয়ার অনেক আগেই ওই মাতাল হাওয়া তার মাতলামি কাটিয়ে একদম শান্ত শিষ্ট ভালো মেয়ের মতো কনে দেখা আলোতে সেজে লাজুক চোখে তাকাতে লাগলো। প্রতিবারের মতো এবারেও রবি বুড়োর গলায় একটা রজনী গন্ধার মালা দেব ভেবেছিলাম। মালা পেয়েছিলাম , তবে সেটা এখানকার কি সব ফুলের। তাই সই। তাই দিয়েই প্রতিবারের মতো সাজিয়েছিলাম ওই আমার কাছে দাড়িওলা লোকটার যে প্রিন্টআউট টা আছে, তাকে। এখানে কোনো সেরকম বাঁধানো প্রতিকৃতি নেই, তবে, একটা প্রিন্ট আউট কে পিচবোর্ড এ আটকে অনেক আগে থেকেই একটা প্রতিকৃতি তৈরি করা আছে, এমন ই ভক্তির শ্রী আমার, যে কোনোদিন সেখান থেকে এক সাজানো গোছানো বাঁধানো প্রতিকৃতি আর ঘরে রাখা হয়ে ওঠেনি। 
সন্ধ্যে নামলো, বোধয় অন্যদিনের থেকে একটু তাড়াতাড়ি ই। ধুপ, ধুনো কর্পূরের গন্ধের মাঝে, অর্ধসতেজ রজনীগন্ধার স্টিক ফুলদানিতে রেখে, ঝরে যাওয়া গোলাপের পাঁপড়ি গুলোকে যত্নে রাখতে রাখতে হটাৎ অনুভব করলাম, দুপুরের সেই মাতাল ভালোলাগার বদলে হটাৎ কেমন এক শূন্যতা আসছে। মনখারাপ একদম আমার ভালো লাগেনা। কারণ জানি, ভালোলাগার মতো মনখারাপ ও একটা নেশার মতো, তখন ওই দুঃখের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে, এমন প্যানপ্যান করতে থাকবো যে হয়তো আশেপাশের কত সুন্দর জিনিস আমার অগোচরেই যাবে থেকে। অতএব তাড়াতাড়ি সেই মনখারাপ কাটানোর জন্যে একার জন্যেই বানিয়ে ফেললাম জেসমিন টি। যদিও সাধারণত একার জন্যে কখনো কোনোদিন কিছু বানাতে আমার ভালো লাগেনা, তবু ওই বেয়াড়া মনখারাপ টাকে তো কাটাতে হবে। নাহলে যে এখুনি নাছোড়বান্দা বেতালের মতো ঘাড়ে সরি মনে চেপে বসবে। হালকা ভিজে হাওয়াটা কিন্তু সেদিন খুব বেয়াদপি করলো, আমার এত আয়োজন বৃথা করে দিয়ে, জেসমিন টি এর সুগন্ধকে মিথ্যে প্রমান করে দিয়ে কেমন এক বিষন্ন ক্লান্তি দিয়ে আমার সন্ধ্যেকে ঢেকে দিতে লাগলো, কি যেন এক নেই, কি যেন এক খালি, কি যেন এক অপেক্ষার মাঝে খুলে বসলাম গীতবিতান আর সঞ্চয়িতা। হয়তো অভ্যেস বশত , হয়তো আশ্রয় পাবার জন্যে যেমন বহুবার ছুটে যাই ওই লোকটার লেখনী গুলোকে ছুঁতে, সেরকম ই। 
না, খালি হাতে কোনোদিন ই বোধয় কাউকেই ফিরতে হয়না, আমরা চেয়ে না চেয়ে অনেক সময় কত কিছু পাই, ভেবেই পাইনে এর ঋণ চুকাই কি করে। যেমন আজ আমি গরমে বিদগ্ধ দুপুরে পেলাম অঝোর ধারায় বৃষ্টির ছোঁয়া।  যেমন আমার সেদিনের অনেক বড় প্রাপ্তি হলো, IPL এর খেলা ছেড়ে উঠে এসে আমার পাশের মানুষটি যখন আমার সাথে গলা মেলালো, হোকনা সে এক দুটো লাইন, তবু তাওতো আমার ই পাওয়া। ওই অমলীন সদা হাস্যময় মুখের দিকে তাকিয়ে কোনোদিন কোনো দাবি নিয়ে আমি দাঁড়াবোই না। তাই যখন সে বলে আমি একটু খেলা দেখলে রাগ করবিনাতো , তখন বিনা বাক্যব্যায়ে আমি বলতে পারি, আমিও আসছি এখুনি দেখতে। আমি যে সত্যি ই কোনোদিন রাগ করিনি। করিনা। আর তাই বোধহয় গত কালের রবীন্দ্র সন্ধ্যার কাছে আবার আমি দুহাত বাড়িয়ে পৌঁছে যেতে পেরেছিলাম। হয়তো সেদিনের সেই বিষণ্ণতা থেকেই যাবে, তাও গত কালের পাওয়াটাও যে মিথ্যে নয়।
বুঝলাম, এই চাওয়া পাওয়ার হিসেব খুব গোলমেলে। ওই যে আমার ঠাকুর, ওই হিসেবটা বোধহয় শুধু সেই করতে পারে, আর কি যে তার মনে আছে, শুধু সেই জানে, নইলে কেন এভাবে আমার এতদিনের সযত্নে রক্ষিত চাঁপা ফুলে আজ এতদিন পরে আমি কারোর দুহাত ভরিয়ে দিতে পারি। কোন অমৃত বোধে কালকে JNU auditorium এ ঢুকেই স্ক্রিন এ দেখি সেই কটি লাইন, যাতে আমার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। 
যেন কত বিষ্ময়, কত পাওয়া না পাওয়ার বোধ থেকে আজকের এই নবজাগরণের বোধ আমাকে ঘিরে ফেলে। মনে হয় যেন আমার ই জন্যে, শুধু আমাকেই বোধি দেবে বলে, ওই বাণী আমার সামনে জ্বলজ্বল করছে। শুরু হলো, 'কতবার ও ভেবেছিনু'...'যে ছিল আমার স্বপন চারিনী '....আর তারপরে যখন ওই লাইন গুলো এলো, "কতবার যে নিভলো বাতি/ গর্জে এলো ঝড়ের রাতি"...বুঝলাম ওই দাড়িওলা বুড়োর এ এক নতুন অভিসন্ধি। সঙ্গে বোধহয় হাত মিলিয়েছিল ওই যে আমার ওই ঠাকুর। ওই যে সবার ওপরে থেকে যে মুচকি মুচকি হেসে চলেছে। সেই ঠাকুর। আমার বিধাতা। ভগবান। যে নামেই তাঁকে ডাকিনা কেন, সেই পরম মহিমাময় এর ইচ্ছা ছাড়া যে গাছের একটা পাতাও নড়েনা। 

আসলে, বারবার আমার যে কথা মনে হয়, আজ আবার সেকথা বলতে ইচ্ছে করছে, সংসার অন্তঃসার শূন্য নয়। এতে অনেক আনন্দ ছড়ানো আছে। আর আমাদের এই সংসার নামক আনন্দলোক এ ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনাই বুঝি ভীষণ অর্থবহুল। কিছুর মানে হয়তো আমরা বুঝি, আবার অনেক কিছুই হয়তো থেকে যায় আমাদের চিরপরিচিত বোধের অগোচরে। তখন শত মাথা ঠুকে কেঁদে মরে গেলেও সে কেনোর কোনো উত্তর পাওয়া যায়না। কখনো কখনো সেই উত্তর না পেয়ে ভীষণ এক ক্লান্তি বোধে আমাদের গতি আটকে দেয়। মনে হয় সত্যি বোধয় পিছিয়ে যাচ্ছি, থেমে যাচ্ছি, ভুল হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। সত্যি তখন মনে হয় "ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু" . আবার বুঝতে পারি, ওই প্রভুই যা করার করছেন, তিনি ই সব কিছুকে চালনা করে চলেছেন। কোনো এক গভীর বোধে, কোনো এক শুভ চিন্তায় , কোনো এক সুন্দরের জন্যে হয়তো আমরা বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন সময় এ , বিভিন্ন জনকে আমাদের চলার পথে খুঁজে পাই, কিছু জন হয়তো আমাদের সাথে আজীবন একসাথে পা মিলিয়ে চলে, আবার কেউ কেউ হয়তো আর পা না মিলিয়ে অন্য কোনো পথ খুঁজে পেয়ে সে পথে মিলিয়ে যায়। তবে যদি মনে করি ওই পা মেলানোটাও যেমন নির্দিষ্ট, তেমনি কতটা পথ কার সাথে চলা এ সব এ বুঝি আমার ওই ঠাকুরের ঠিক করে রাখা, তবে নিজে যেন নিশ্চিন্ত হয়ে যাই। মনে হয় দিলাম ই নাহয় সবকিছু ওই কালের নিয়মে ছেড়ে, যা কিছু হবে সব ভালোই হবে। তাঁর মহিমা বোঝার আমরা কে, মনে পরে যায়, সেই সুর 
"তুমি সুন্দর, যৌবনঘন রসময় তব মূর্তি,
দৈনভরণ বৈভব তব অপচয় পরিপূর্তি। 
নৃত্য গীত কাব্য ছন্দ  কলগুঞ্জন বর্ণগন্ধ -
মরণহীন চিরনবীন তব মহিমাস্ফূর্তি। । "
আর তখন ই দূরের ওই বৃষ্টি ভেজা মাতাল হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যায় আমার ভাবনা রাশিও। জলের ছিটে যেন এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় আমার সর্বাঙ্গ। সর্বান্তকরণে অনুভব করি সেই শিহরণ। আর কি এক আবেশে হারিয়ে যেতে যেতে মনে হয় যেন একরাশ চাঁপার গন্ধ পেলাম। 
সেই তীব্র সতেজ, সবুজের মাঝে উজ্জ্বল শুভ্রতার চাঁপা ফুল, যার মাঝখানটা হালকা হলুদ। 









No comments:

ইচ্ছেনদী

আমার ল্যাব টা মাউন্ট sinai এর ১০ তলায়, আর আমার ওয়ার্কিং ডেস্কটা একদম জানালার ধারে , বিশাল জানালা। মনে হয় মেঘ গুলো এখুনি ঢুকে পড়বে এর মধ্যে। ...