ছাদে ছিলাম। কতক্ষন ঠিক জানিনা। ঘড়ি, মোবাইল, facebook , সোশ্যাল মিডিয়ার হাজার রকমের বিভ্রান্তিতে আমরা নিজেরা নিজেদের সাথে সময় কাটাতে ভুলেই যাই কখনো কখনো। মাঝেমাঝে তাই নিজেকে কিছুক্ষনের জন্যে এই সব কিছু থেকে বের করে নিয়ে আসা দরকার হয়ে পরে। তাই কিছুক্ষনের জন্যে নিজেকে এই সব কিছু থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে আমার ওই একান্ত আপনার সময়টা একান্ত ভাবে শুধু নিজেকে দিয়েছিলাম। সমস্ত আকাশ আবীর রঙে রাঙিয়ে আমার দিনের দিবাকর বিদায় নিলেন। ওই দূরে পাহাড়টার ওপারে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। তারপর দেখলাম। আর নেই। পরে আছে লালে লাল আকাশ।
গত কালের অস্থিরতা, আজকের কি এক অপেক্ষার সাথে মিশে আমার মনকে করে তুলেছিল অশান্ত। ওই স্থির, ধ্যানমগ্ন প্রকৃতি, আসতে আসতে লাল রঙের রেশ মুছে গিয়ে যখন সন্ধ্যার গভীরতা কে তুলে ধরতে লাগলো, দূরে ওই পাহাড়ের চূড়ার ওপরএর মন্দির থেকে ভেসে আসা ওই ক্ষীণ কিন্তু গভীর শান্তিময় সন্ধ্যারতির শব্দ ভেসে এলো। তখন বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক ঢেউ উঠলো। যেন দামামা বেজে উঠলো। তারপর ধীরে ধীরে সেই শব্দ সমস্ত কোলাহল স্তব্ধ করে দিয়ে, অনন্ত সুন্দরের মতো আপনার মুখখানি তুলে ধরলো। আকাশে তখন এক মঙ্গলময় চাঁদ স্মিত হেসে তাকাচ্ছে। মনে হলো আমার সমস্ত দিনের জমে থাকা অজস্র প্রশ্ন, গ্লানি, ব্যাথা, বেদনা, অপূর্ণতা সব কিছু থেকে আমি যেন বেরিয়ে আসতে পারলাম , সদ্য স্নান করার পর যেমন শীতল, সুন্দর বোধ হয়, সেইরকম মনে হলো যেন ওই সন্ধ্যা নামার মুহূর্তে ওই অস্তগামীর আভায়, চাঁদের স্মিত হাসিতে অবগাহন করে উঠলাম।
বুকের মধ্যে যখন সেই গভীর প্রাপ্তি নিয়ে নিচে এলাম, তখন হটাৎ আবার প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম। শান্তি, সেই পরম প্রাপ্তির প্রতিধ্বনি। জানিনা কেন নিজের সমস্ত চেতনা এইভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এ কিসের আহ্বান। এ কিসের ইঙ্গিত। এ কি পরীক্ষা। তবে যাইহোক, বড় পবিত্র এই প্রতিধ্বনি। আর সেখান থেকেই আরো এক বাসনার কথা ভেসে এলো, 'ভাবছি সন্ন্যাস নেবো'। ঠিক এইরকম ই কিছু তখন অনেক বছর আগে, আমি যখন কলেজ এ পড়ি মনে হয়েছিল। সবসময় মনে হতো, এ জীবনের কি মানে, কি লক্ষ্য এই জীবনের। কেন আমরা এসেছি এই পৃথিবীতে, শুধুই কি চাকরির জন্যে পড়াশুনো, টাকা রোজগারের জন্যে চাকরি, ভালো থাকার জন্যে বিয়ে, সংসার, আমার আর আমার, গাড়ি , বাড়ি।..তারপর।...তারপর কি? বাবাকে বলেছিলাম আমি বিয়ে করবোনা। বাবা বললো কেন। আমি বলেছিলাম না যদি না করি, বাবা বলেছিলো না সেটাও করতেই পারিস। কিন্তু না বুঝে শুধু মোহে পরে কিছু ভাববিনা। আমি ঠিক জানতামনা, বলেছিলাম, জানিনা বাবা, তবে মনে হয় আমি যেন সন্ন্যাসি হয়ে যাই। বাবা রামকৃষ্ণকথামৃত পরে আমাকে সন্ন্যাসী হওয়া নিয়ে রামকৃষ্ণ কি বলেছেন জানাতে বলেছিলো। পড়েছিলাম। সব হয়তো বুঝিনি। কিছু বোঝা নিয়ে কিছু না বোঝা নিয়ে সেই থেকে আজ পর্যন্ত মনের মধ্যে থেকে গেছে, যে সংসারে থেকেও সন্ন্যাসী হওয়া যায়। রামকৃষ্ণ এর সেই উপমা নিজেদের যদি হাঁসের মতো তৈরি করতে পারি, হাঁস যেমন শুধু দুধ টুকু খায় জল টুকু ফেলে দিয়ে। সেইরকম। সংসারের মধ্যেও দুধ আর জল মিশে থাকে, সেই জল মিশ্রিত দুধ থেকে আমাদের শুধু দুধ টুকু তুলে নিতে হবে। সেইটাই হলো সাধনা। সেই হলো আসল সন্ন্যাস। আমার অপর প্রান্ত থেকে যে সন্ন্যাস হবার কথা ভেসে এলো আজ, তাতে আমার ভীষণ ভাবে এই কথা মনে হলো। আর মনে হলো, তুমি ঠিক সেই পথেই আছো, পদ্ম পাতায় জল এর মতো সংসারের ওপর ভেসে থেকে তার মধ্যে থেকে অথচ তার সাথে ভেসে না গিয়ে স্বমহিমায় সূর্য্যের কিরণে জ্বলজ্বল করছো। তোমার সৃষ্টির নেশা, তোমার ভালোবাসা, স্নেহ তোমার চারপাশে মায়ার বলয় রচনা করে তোমাকে ঘিরে রাখবে। অসাধারন আমার মধ্যে কিছুই নেই, আমি খুব সাধারণ আর খুব সাধারণ ভাবে আমার চারপাশটাকে আমি দেখতে চাই। আমার চাওয়া, পাওয়া আর পাওয়া না পাওয়ার মাঝে এক অলিখিত সেতু বন্ধন আপনি হয়ে গিয়ে আমাকে পৌঁছে দিয়েছে এই চাঁদনী রাতের মাধুরীর খোঁজে। সেই মাধুরী মমতা হয়ে তোমাকে জড়িয়ে থাকুক , তোমার সব অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিক। কিন্তু তা যেন অন্য কোথাও অসুন্দরের ছায়া না ফেলে।
এখন রাত হয়েছে। চাঁদএর আলো খুব নরম হয়ে, আদর হয়ে হয়তো জড়িয়ে রাখছে কাউকে। কেউ বা হয়তো সে আলো অবহেলায় সরিয়ে দিচ্ছে দূরে। হয়তো কেউ খুঁজছে আবার হয়তো কেউ পেয়েও হারাচ্ছে। কি বিচিত্র এই সংসার। আমাদের এই সংসারে প্রতিনিয়ত ঘটে চলে নানান ঘটনা। কত তার অর্থ, কত তার ইঙ্গিত। হয়তো কত ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তা আমাদেরকে প্রতিদিন একটু একটু করে আমাদের চলার পথের পাথেয় খুঁজে দেয়। আমাদের বোধ কে উন্নত করে। চলার পথে, কত ইচ্ছে, কত আশা অনেক সময় আমাদের সেই যাত্রাকে মেদুর করে তোলে। হয়তো পথের বাঁকে পৌঁছে আমরা চুপ করে ভাবতে থাকি, ফেলে আসা পথের কথা। হয়তো ভাবতে থাকি, আগামীর পথের কথা। তারপর আবার চলতে শুরু করি। পথ নিজেই পৌঁছে নিয়ে যায় আমাদের গন্তব্যে। সেই পথে, আমাদের শুভ কামনা, শুভ চেতনা আর অভিজ্ঞতা আমাদের পরিণত ভাবে ভাবতে শেখায়। তখন আমরা আমাদের না পূরণ হওয়া ইচ্ছে গুলোকে, পূরণ করার জন্যে না দৌড়ে, স্বপ্ন দিয়ে মুড়ে ভবিষ্যতের হাতে গচ্ছিত রেখে দি। আর মনে মনে ভাবি, কোনো একদিন যদি ভগবান আজকের এই পরীক্ষাতে পাশ করার জন্যে আমাদের পুরষ্কৃত করে আমাদের হাতে তুলে দেয় ওই ইচ্ছাপূরণের চাবিকাঠি। তখন সবাইকে ভালো রেখে, নিজেদের জন্যে রাখবো একটা দিন যেখানে আজকের যা কিছু তখন খুব যত্ন নিয়ে ভালোবেসে আলোচনা করবো। ঠোঁটের ওপরে হাসির রেখা হয়তো চাঁদ কে বাধ্য করবে কোপাই এর ওপর নিজের ছোয়া ফেলতে। আর সেদিন একরাশ চাঁপা ফুল তুলে রেখো আমার জন্যে। আমরা সেদিন নাহয় আমাদের ক্রমবর্ধমান ইচ্ছেখাতার ইচ্ছের লিস্ট গুলো নিয়ে বসবো। মনে পড়বে আদুরে অভিমান গুলোর কথা, মনে পড়বে সবুজ এর আনন্দ, নীলের গভীরতা, সাদার শুভ্রতার কথা। আর এখন সেই দূর ভবিষ্যতের সুখকর দিনের কথা মনের মাঝে রেখে এসো মনে করি ওই সন্ধ্যারাতির শব্দকে। আর ওই সন্ধ্যারাতির শব্দ, ধূপের গন্ধ , ধুনোর আবেশের সাথে মিশে যখন স্থির, অচঞ্চল শান্তি নিয়ে আসবে। তখন ওই কর্পূর জলে হাত ডুবিয়ে, সেই শান্ত, শীতল জল এ ভেজা ঠান্ডা হাতে , অনুভব করবো আজকের সুন্দরতা কে, আগামীর সুন্দরতাকে, চিরকালীন সত্যি, চিরকালীন সুন্দরতা কে । আর সেই শীতল সুন্দরের অনুভব ছড়িয়ে পড়বে তোমার মধ্যে, আমার মধ্যে, আমাদের উত্তপ্ত, অশান্ত পৃথিবীকে শান্তকরে আগামীর আহ্বান শোনাবে।
No comments:
Post a Comment