সন্ধ্যে বেলায় বাড়ির উষ্ণতাটা ভীষণ মিস করি। ধুপ ধুনো কর্পূরের গন্ধ, তুলসী তলা, আমার সেই ছোট্ট প্রদীপটা, একসাথে চা খাওয়া, সারাদিনের সমস্ত রকম গল্প। কত আনন্দ কে যে যত্ন করে ধরে রাখা যেতে পারে, ওই ৪ দেওয়ালের মাঝে।
আমার নিজের গৃহকোণটাকেও হয়তো চেষ্টা করি, ঐরকম ঝকঝকে, জমজমাট করে তুলতে, ঘষামাজা চলছে, একদিন নিশ্চই, mobile, netflix এর নানান সাসপেন্স, মার্ডার আর কমেডি শো থেকে বার হয়ে এসে আমার ছোট্ট ঘর এর সন্ধ্যাও সোনালি হয়ে গল্প গানে সেজে উঠবে। নিশ্চই হবে তা। অপেক্ষা করবো। তবে আজকে জানিনা কেন এই ঝোড়ো ভিজে হাওয়ার সন্ধ্যে বেলায় একলা আমার এই হোস্টেল এর ঘরটাতে বসে, ধূপের ধোয়াতে, ঝরে যাওয়া চাঁপা ফুলের গন্ধে খুব কান্না পাচ্ছে। বুঝলাম এসব ই ওই বদমাশ মনখারাপ টার কারসাজি। আবার আমার মধ্যে ঢুকে আমাকে তছনছ করে দেবার ইচ্ছে বুঝি। না কিছুতেই একে জিততে দিলে চলবেনা। কিছুক্ষন চালালাম যুদ্ধ। তারপর যেন আর যুদ্ধেরও ইচ্ছে হলোনা। কেমন এক বিষন্ন ক্লান্তিতে চুপ করে বসে রইলাম। মনে হলো জীবনে আমার বোধয় আর বিষয়ী হওয়া হলোনা। কতবার ভেবেছি হোস্টেল এর এই রুম টা ছেড়ে দেব। কতগুলো করে টাকা HRA তেই কেটে যায়, একটু নাহয় কষ্ট করে যাতায়াত করে নেবো। কিন্তু কাজটাও এমন আর আমার "বন্ধু'বরে"র কথায় আমার এই আলটুসি health টাও এমন যে কিছুতেই ওই যাতায়াত করা হয়ে ওঠেনা। শুধু যদি ১০টা ৫টার কাজ হতো, তাহলেও হয়তো কোনো কথা না শুনে জোর করে যাতায়াত ই করতাম, কিন্তু ওই যে স্বইচ্ছেতেই যে মাথার কাজ বেছেছি। তাই মাঝখান থেকে আমি এই শহর ও শহরতলী র প্রায় দু খানা সংসার সামলাছি গত ৪ বছর ধরে, না আপসোস নয়, উপভোগ ই করি, তাইতো জোর করে নিজে হাতে রান্না করবো বলে রান্নার জন্যে কাউকে রাখতে দিইনি। তাইতো ক্লান্ত হয়ে ফেরার সময় ও বাজার করে নিয়ে যাই, কি কি রান্না করবো ভেবে ভেবে। HRA এর টাকাটা জমিয়ে রাখলে হয়তো অনেক কিছু করা যেত। নাহলে অন্তত পোস্টডক আর বিবাহিতের সুবিধে টা নিয়ে কোয়ার্টার টা তো নেওয়াই যেত। কিন্তু ওই যে বোকামি ই হয়তো। দুটোর কোনোটাই করা হয়নি। তার জন্যে কি আজ আপসোস হচ্ছে, না ঠিক আপসোস নয়, কিন্তু ভাবছি অনেক কিছুই জীবনে হয়তো করা যেত, কিন্তু হয়নি। তবে এটাও আমি মানি, আমি জানিও অনেক বছর পরে যখন একবার পিছন ফিরে তাকাবো তখন বুঝতে পারবো যে যা কিছু না হয়ে যা কিছু হয়েছে জীবনে বা যা কিছু না পেয়ে যা কিছু পেয়েছি জীবনে, ঐটাই হয়তো ওই সময়ের জন্যে আমাদের জন্যে একদম সঠিক। যদি জীবনে আমি যেমন যেমন যা যা চেয়েছি সব ই পেয়ে যেতাম, তাহলে হয়তো কখনো এইভাবে নিজের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতে পারতামনা। আমার এই ঘরে সন্ধ্যে এমন মদির হয়ে নেমে আসতোনা। বা ভোর ৪তে থেকে পাখির কাকলি আমাকে ডেকে তুলতোনা। আমার এই হোস্টেল জীবন আমাকে ভীষণ ভাবে নিজেকে চিনিয়েছে। চারপাশটাকে বুঝিয়েছে। হোস্টেল লাইফ আমি আগেও কাটিয়েছি। কিন্তু এই জীবনটা একদম অন্যভাবে আমার কাছে এসেছে। হয়তো এক পরিণত জীবন যাত্রা, যেটা কখনো ভাবিনি, সেটা এখানে এসে দেখেছি তাই। হয়তো এখানে এসে নিজেকে পরিচিত করেছি এক অদ্ভুত বাঁধাহীন বাঁধনএর সাথে, যে বাঁধন অন্য আর কারোর কাছে নয়, যার লাগাম নিজের ই কাছে থাকে।
আজকের বিকেলের এই ঝড় জল আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলো গত পরশুর সেই অভিজ্ঞতার কথা। যখন ওই রাতের বেলা ঘরে না ফিরতে পেরে এক মেয়ে একা ল্যাব এ এক কাপ কফি নিয়ে সাক্ষী হলো ঝড়ের মধ্যে দিয়ে আসতে আসতে কিভাবে অন্ধকার সরে গিয়ে শান্ত দিনের শুরু হয়। সেই মেয়ে যে এতটুকু জোড়ে হাওয়া চললেই জানলা দরজা বন্ধ করে বাবার কোলে গিয়ে আশ্রয় নিতো, সেই মেয়ে। চোখের সামনে সেদিন দেখলো সাধের চাঁপা ফুলের গাছটা ঝড়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে কিভাবে নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলো, সেই শ্বেতশুভ্র ভুল গুলো মাটিতে কাদাতে লুটোপুটি খেতে লাগলো আর ঝড় নিষ্ঠূর ভাবে সমস্ত গাছটাকে যেন তছনছ করে দিয়ে, ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে চলে গেলো। কাঁচের জানলার এপাশ থেকে করার কিচ্ছু ছিলোনা। ভয়ে দলা পাকানো কান্না নিয়ে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো, পারলোনা তাকে দুহাতে করে কাছে টেনে বুকের মধ্যে আগলে রাখতে। ধুলোর মধ্যে দিয়ে, প্রলয়ের মধ্যে দিয়ে, ঘরে ফিরে এসে দেখলাম, এতো বছরের সাধের ফুলদানি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে লুটোচ্ছে। বুদ্ধমূর্তি একপাশে হেলে, খাতায় আটকে গ্যাছে বলে শুধু কিছু হয়নি। কিন্তু গনেশের গায়ে ঝড় তার চিহ্ণ রেখে গ্যাছে। ধুলো বালিতে ভরা ঘর, ভাঙা ফুলদানি, বাইরে ঝড়ের শো শো শব্দ যেন কেমন এক অশুভ ইঙ্গিতে আমাকে একাকিত্বে ভয়ে, কান্নায় জর্জরিত করে ফেললো।
ওই ফুলদানিটা প্রথম স্টাইপেন্ড পেয়ে কেনা ছিল। মা এর জন্যে শাড়ি, বাবার জন্যে শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় এর "ঐতিহাসিক সমগ্র" আর বন্ধুবর টির জন্যে একটা হাফ পাঞ্জাবী কিনে সেই প্রথম নিজের জন্যে কিনেছিলাম যাদবপুরের রাস্তার ধার থেকে ওই ফুলদানীটা। তারপর কলকাতার পাট চুকিয়ে দিল্লিতে আসার সময়ও তাকে সঙ্গে করে আনতে ভুলিনি। যখন যেভাবে যা পেয়েছি, তাই দিয়ে সাজিয়েছি ওই ফুলদানী। কৃষ্ণচূড়ার ডাল, নাম না জানা হলুদ ফুল, চাঁপার গুচ্ছ , বন্য ঘাস পাতা।জ্যোৎস্না রাতে সবকটা পর্দা সরিয়ে দেবার পরে যখন কাঁচের দেওয়াল দিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে চাঁদের আলো সমস্ত ঘরটাকে ভাসিয়ে দিয়ে যায়, সকালের প্রথম রোদে যখন ঝলমল করে ওঠে, শীত এর মিঠে রোদ বা গ্রীষ্মের ঝিম মারা দুপুর এ যখন কি এক আবেশ তৈরি হয়, তখন বারবার ওই সব কিছুর সাথে আমার ওই ফুলদানী হেসে উঠে আমার এই ঘরকে বারেবারে সাজিয়ে দিয়েছে।
সেদিন ওই ভোর রাতে ফুলদানীর ভাঙ্গা টুকরো গুলোকে ফেলে দিয়ে এসে, ঘর পরিষ্কার করতে করতে বারবার যেন কি এক অশুভ আশঙ্কায় মন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিলো। তবে কি এমন কিছু ঘটতে চলেছে আমার নিজের বা আমার পরিচিত কারোর জীবনে, যা থেকে আমি তাকে বাঁচাতে পারবোনা? শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হবে, ওই ভেঙ্গে যাওয়া? বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো আমার খুব প্রিয়, ওই শ্বেত শুভ্র চাঁপা ফুল গুলোর অসহায় আর্তি। ভয় , গ্লানি , রাত্রি জাগার ক্লান্তি, অজানা আশংকা সব কিছুতে আমি যেন ভীষণ ভাবে শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো কোথাও কি পৌঁছে দেওয়া উচিত আমার এই ভাবনার কথা, সাবধান হওয়া উচিত কি অনেক বেশি। জানিনা। সবকিছু পরিষ্কার করে যখন স্নান করে ঘরে এলাম, দেখলাম ঝড় থেমে গেছে। সেই প্রলয় থেকে আসতে আসতে চোখ মেলে তাকাচ্ছে এই ধরিত্রী। চারপাশ ভীষণ রকমের শান্ত, স্থির, ঠান্ডা। সবে স্নান সেরেছিলাম। গা শিরশির করে উঠছিলো। একটা ধুপ জ্বালালাম। আর তারপর ছাদে গেলাম। পশ্চিম আকাশ থেকে তখনো কালো মেঘের ঘনঘটা কাটেনি, আর পুব আকাশ আসতে আসতে , ধীরে ধীরে গোলাপি, তারপর লালে ছোট্ট শিশুর মতো চোখ রগড়াতে রগড়াতে চোখ মেলে তাকাচ্ছে। সেই লাল রং ধীরে ধীরে সমস্ত আকাশকে ভরিয়ে দিতে লাগলো, কিছুক্ষনের মধ্যে কালোর চিহ্ন কোথায় মুছে গিয়ে, প্রলাপের চিহ্ন কোথায় সরে গিয়ে সোনালী আভাতে শুরু হলো নতুন দিন। কিছুক্ষন আগে যে আমি ভয়ে, ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে ছিলাম, কি এক জাদুকাঠিতে সেই আমি ই স্নাত, স্নিগ্ধ হয়ে স্থির হয়ে এই শান্ত আর বড় পবিত্র সেই ব্রহ্মহ মুহূর্তের সাক্ষী হলাম। শুনেছিলাম ব্রহ্মহ মুহূর্তের থেকে পবিত্র ক্ষণ নাকি আর হয়না। র আমি সেই ক্ষনে নিজের মনের এই অল্প কিছুক্ষনের তফাতে এমন পরিবর্তন এমন দুই বিপরীত ধর্মী অনুভবে ভীষণ ভাবে বিস্মিত হলাম। মনে হলো যে ঝড় আসার সে আসেই বোধয় জীবনে, তাকে এড়ানো হয়তো যায়না। কিন্তু সেই ঝড় ও থামে। প্রকৃতি তার আপন নিয়মে সে ঝড় থেকে নিজেকে থিতু করে। আর ঠিক সময়ে ওই নতুন দিনের সূচনা করার মতো সূর্যোদয় তার আপন মহিমায় উজ্জ্বল করে দেয় আমাদের জীবনকে। আবার। বারবার। শুধু আমাদের ওই অনুভব টাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, যাতে ওই যে যখন সূর্যোদয় হবে, তখন ও যেন আমরা ঝড়ে বিধ্যস্ত হয়ে বসে না থাকি, তখন যেন আমরা ঠিক ওই দিনের মতো শান্ত , স্থির , সুন্দর ভাবে ওই নবসূচনাকে অন্তরে স্থাপন করতে পারি। তাহলেই যতই ঝড় আসুক না কেন , কোনো কিছুই লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারবেনা। ছাদ থেকে ফিরে শুলাম একটু, চোখ ও বন্ধ হয়ে এসেছিলো, কিন্তু অর্ধ জাগরণে শুধু ওই কথাই মনে আনাগোনা করছিলো। পৌঁছে দিতে ইচ্ছে করছিলো কোথাও, নিজের সেই সদ্যপ্রাপ্তি কে। কিন্তু সেদিন সুর বারবার কেটে যাচ্ছিলো, তাল মিলছিলনা। অবশেষে আবার সুর খুঁজে পেলাম। কিন্তু তখন আমার আর কিছু বিশদ ভাবে বলা হয়ে উঠলোনা। দরকার ছিলোনা। কারণ ঠিক আমার মনের কথার ই প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম যে "প্রকৃতি নিজের নিয়মে আবার সব ঠিক করে দেবে। সব কিছু আবার গুছিয়ে দেবে। " আজ সকালে ল্যাব এ যাবার সময় মনেই হলোনা আগে কখনো কিছু হয়েছে বলে। ...দেখলাম, পৃথিবী সত্যি ই গুছিয়ে নিয়েছে সব কিছু। আমার চাঁপার ও সব কুঁড়ি ঝরে যায়নি দেখলাম। আজ আবার ফুটেছে।
No comments:
Post a Comment