Sunday, 29 April 2018

কনে দেখা আলো

বারান্দায় বেরিয়েই দেখলাম, একটা অদ্ভুত হলদে রঙের আলো চারপাশ টাকে কেমন করে যেন মুড়ে রেখেছে। শুনেছি এই আলোটাকে বলে কনে দেখা আলো। তার সাথে একটা হালকা শিরশিরানি হালকা হাওয়া দূরে কোথাও বৃষ্টির খবর বয়ে নিয়ে এলো। এখানের গরম হলকা সেই ভিজে হাওয়া টাকে যেন পরম আদরে সর্বাঙ্গে গায়ে মেখে নিয়ে কেমন এক স্বস্তি আর শান্তির নিশ্বাস ফেললো। 

স্বস্তি, শান্তি, বিশ্বাস, নির্ভরতা ---আমার খুব প্রিয় আর কাছের কিছু শব্দ। আমাদের সবাইকেই কখনো কখনো চলার রাস্তায় হোঁচট খেতে হয়, তখন এই শব্দ গুলো, এই শব্দ গুলোকে আঁকড়ে ধরে আবার আমরা পথ চলতে পারি। আমার বাবা একদিন বলেছিলো, "মান্তু, মনের সঙ্গে কখনো তঞ্চকতা করবিনা, খুব ভালো করে বোঝার চেষ্টা করবি, আমাদের মনটা কিসে ভালো থাকে, কিসে শান্তিতে থাকে, কিসে স্বস্তিতে থাকে। খুশি বা আনন্দে হয়তো এ মন কে অনেক কিছুই রাখতে পারে, কিন্তু দেখিস ভালো করে বুঝে দেখিস, ক্ষণিকের আনন্দ নয়, চিরকালীন শান্তি। এ মন শান্তি পায় কোথায় দাঁড়িয়ে, কোথায় নির্ভরতার আশ্রয় পায় , সেই জায়গাটা দেখিস চিনতে কখনো ভুল করিসনা।" পরে এই কথার প্রতিধ্বনি শুনেছিলাম রামকৃষ্ণের কথামৃতে, মনি ভৌমিকের বিবেকানন্দ ব্যাখ্যায় বা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এর গল্পের বিভিন্ন ছত্রে ছত্রে। আমার শান্তির জায়গাটা চিরকালই ওই মানুষটা যে আমাকে হাত ধরে হাঁটা শিখিয়েছে, প্রত্যেক পদক্ষেপে যার কথা আমাকে দিশা দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়, ধ্রুবতারার মতো যে কথা, বাণী হয়ে আমাকে পথ দেখায়। সেই মানুষটা।  আমার বাবা। আর ওই ঠাকুরের সিংহাসন। সন্ধ্যারতির ধূপের ধোঁয়ায়, প্রদীপের আলোতে যখন অজান্তে আমার চোখের জলে গাল ভিজে যায়, তখন বুঝি, সমস্ত গ্লানি ওই জলের মধ্যে দিয়ে ধুয়ে মুছে গেলো। 

আজ এই গোধূলি বেলার মনকেমন করা কনে দেখা আলোর সাথে দিবাবসানের স্নিগ্ধ স্বস্তি যখন মিশে গিয়ে আমাকে আমার বাবার বলা ওই কথা গুলো মনে করিয়ে দিয়ে গেলো। তখন মনে হলো সারাদিনের নীরবতার বড় প্রয়োজন ছিল। হয়তো নিজের জন্যে, হয়তো অন্যের জন্যে। একদিন আমার বাবা যখন আমাকে আমার চেতনাকে গড়ার জন্যে ওই কথা গুলো বলেছিলো, তখন আমাদের কেউ একথা বোধয়  জানতোনা যে , এ কথার কি গভীর মর্ম। আজ আমার মন একথা অন্য কারোর কাছেও জিজ্ঞাসা করতে চাইছে, দেখো ছেলে, খোঁজো নিজেকে, ভুল বুঝলেও বুঝো বৈ কি আমায়, তবু খোঁজো। এ কি শুধুই মুহূর্তের আনন্দ , ক্ষণিক সুখের আকুলতা নাকি তোমার মন কোনো চির শান্তি , স্বস্তিকে খুঁজতে চায়। বসতে চায় দুদণ্ড শীতলপাটির স্নিগ্ধ ছায়ায়, গণ্ডূষ ভরে পান করতে চায় সুধা মুহূর্ত আর তারপর আবার পথ চলে। 

আসলে কি জানো , কি করি বলো, বিধাতা আমাকে হটাৎ করে সমস্ত আধুনিকতা দিয়েও পৌরাণিক করে রেখে দিয়েছে যে। আমি মুহূর্তে বাঁচা মানে বুঝি আমাদের জীবনের ছোট্ট ছোট্ট এক একটা সমস্ত মুহূর্ত এর যা কিছু ভালো, যা কিছু সুন্দর তাকে নিঃশেষে অন্তর এ গ্রহণ করে নেওয়া। ভালো থাকার সেই যে চাবিকাঠি। জীবনের সারবত্তা সেখানেই আছে লুকিয়ে। আর ওই সমস্ত মুহূর্ত তখন ই অন্তরে নেওয়া যায় যখন আমাদের মন চিরশান্তির পথে স্থির রাখে নিজেকে। আমার মুহূর্তে বাঁচা westernize রঙে রাঙিয়ে তুলতে পারলে, হয়তো এটাই বলতাম আজকের আনন্দ কালকের গ্লানির কারণ হলেও আজকের আনন্দ আজকের ই।  না পারলামনা এ কথা বলতে, এ আবার যেন সেই শেষের কবিতার অমিতের সংঘর্ষ তার চারপাশের তথাকথিত সভ্য সমাজের সঙ্গে।  
আমার মন ওই মুহূর্ত তে বাঁচেনা, কি করি বলো বীরপুরুষ মশাই, আমার মন যে প্রদীপের অনির্বাপিত শিখার মতো, সত্যি, শান্তি আর স্বস্তির পথে অনির্বান জ্বলতে চায়। আর তাই ক্ষনিকের আনন্দ নয়, চিরকালীন স্বস্তিকে খুঁজতে দেবার জন্যে এ নীরবতার তোমার জন্যে হয়তো বা আমার জন্যেও বড় দরকার ছিল। কি জানো , ওই যে তুমি বলেছিলে, আমরা সারাবছর অপেক্ষায় থাকি কখন ওই শরৎ কালে মেঘের ভেলা ভাসিয়ে দুগ্গা মা, চারদিনের জন্যে আমাদের আনন্দে ভাসিয়ে দিয়ে যাবে, এটা জেনেও যে চারদিন পরে বিসর্জন, কিন্তু জানোকি, ওই চারদিন পরের বিসর্জন আমরা হাসিমুখে দিতে পারি এই কারণেই কারণ আমাদের মনের ভেতরে থাকে আবার পরের বছরের ওই চারদিনের জন্যে ফিরে পাওয়ার আশা। আর মনের ভেতরে এই চারদিনের স্মৃতি আগামীর চারদিনের আশার সাথে যেমন ই এক হয়ে যায়, অমনি ই দুঃখ ভুলে স্বস্তি খুঁজে পায় এ মন। সেই কোন ছোট থেকে এই সনাতন ভাবনার সাথে এক হয়ে আমরা বড় হয়েছি, পারিনি বিসর্জন দিতে সেই বোধ কে। তাই আমার জীবন রাস্তায় চলতে চলতে গড়ে ওঠা ছোট বড় সমস্ত সম্পর্ক আমার কাছে যে বড় সুন্দর, মধুর হয়ে তার নিজের নিজের জায়গা আলোকিতো করছে। আমি ভাবতে এখনো পারিনি যে আজ যার খারাপ থাকা আমাকে ভাবালো, কাল তাকে শুধুই চলার পথের মুহূর্তের অভ্যেস বলে ফেলে দেব। আর তাইতো, দিনকাল সময় পেরিয়ে ওই চিরন্তন বোধ এর হাত ধরে, হটাৎ করে তোমার পাশে এসে দাড়াঁতে দ্বিধা বোধ হয়নি। আর তাই বোধয় ওই চিরকালীন শান্তির ছায়ার খোঁজে তোমায় সাথ দিতে ইচ্ছে করে। 
আর তাই এই নীরবতা। যার হয়তো বড় প্রয়োজন ছিল। 

অনেক সময় আমরা নিজেরা শুধু মাত্র কিছু অভ্যেস এর বশে, কিছুজিনিস কে জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে ফেলি। ভাবি বোধয় এ ছাড়া আমি কিছুতেই থাকতে পারবোইনা , কিন্তু যখন ই তা আমাদের থেকে চলে যায়, তখন দেখি আমরা এতটুকু তাকে miss না করেই , তাকে ছাড়াই খুব ভালো ভাবে দিন কাটিয়ে নিতে পারি। এই হলো আমাদের মন। এই মন কে বোঝার জন্যে তাই, কিছুটা নীরবতা, কিছুটা সময়, কিছুটা space খুব দরকার হয়ে পরে। 
আবার জানো আগের ঘটনার উল্টো ঘটনাও ঘটতে পারে, যাকে শুধু মাত্রই অভ্যেস এর বশে আমরা অবহেলায় ভাবি, এ আর এমনকি , জীবন একে ছাড়াও চলে যাবে, হটাৎ তার না থাকা সমস্ত পৃথিবীটা কে যেন শূন্য করে দিয়ে যায়। অকারণ কান্নায় বুকের ভেতরে ঢেউ ওঠে। মনে হয় সব কিছু থেকেও আমার এই চাঁদনী রাতের কোনো মানেই নেই, বেলী র সুগন্ধ আজ ব্যর্থ আক্ষেপে কেঁপে উঠছে। সব কিছু থেকেও আমার মনের তন্ত্রীতে কোনো সুর ই যেন বেজে উঠছেনা। এও আমাদের মন। এই যে একজনের অভাবে সবকিছু শূন্য হয়ে যাওয়া, একে বোঝাও খুব দরকার। কিছুটা নীরবতা , সময় এই একজন মানুষের আর একজনের জীবনে যে অনিস্বীকার প্রভাব ফেলতে পারে, যা আমরা অনেক সময় ই বুঝতেই পারিনা, তাকে বুঝিয়ে দিয়ে যায়।
আর এই নিরাবতা আর একটা খুব মূল্যবান জিনিস আমাদের বুঝতে শেখায়, নিজেকে। নিজে কি চাই, কেন চাই আর কাউকে সত্যি ই পাশে চাই কিনা, একথা বুঝিয়ে যেমন দেয় ই। তেমন ই খুব গভীর ভাবে আমাদেরকে বোধহয় আমাদের শান্তির, ওই স্বস্তির জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে যায়। 
অদ্ভুত আমাদের মন , খুব সুন্দরও। আর আমাদের জীবন, না তাতে কোনো জটিলতা নেই। সরল শাদা সুন্দর একটা পথ। আর এই সুন্দর পৃথিবীতে, অনেক কথা, কত হাসি, ফুলের রাশি আর অপরিমিত ভালোবাসা আমাদেরকে চেনায় আমাদের সংসার এর সারকথা। সংসার অন্তঃসার শূন্য নয়। সংসার বড় সুন্দর, গভীর , অনাবিল। আর আমাদের চারপাশের সবাইকে নিয়ে, ভালোয় মন্দে, সবকিছুকে নিয়ে  সৌন্দর্য্য এ ফলে ফুলে ভরে ওঠে এ সংসার।

গোধূলীর আলো ক্ষীণ হয়ে আসছে, সন্ধ্যার আগমনকে বরণ করে নেবার সময় হলো, যাই আমার্ সন্ধ্যার শান্তি কে আবাহন করার প্রস্তুতি নি। আমার ঘরের কোণে যে দ্বীপ জ্বলে উঠবে, আমি জানি তা তোমার মনের সকল অভিমান কে ও নিঃশেষে দূর করতে পারবে। আর ওই যে  " সন্ধ্যার প্রদীপ আর ধুপ। একজন আলো দেয় আর একজন ছড়ায় মোহময়ী সুবাস" সেই সুবাসে চারিদিক আমোদিত হয়ে উঠুক, আর ওই আলোতে যেন খুঁজে পাওয়া যায় সেই স্বস্তির নির্ভরতা, শান্তির আশ্রয়কে। 

খুব ভেতরথেকে একটা গান মনে উঠে আসছে , 

তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥ 
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,. বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ॥ 
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,. কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে। 
নাহি ক্ষয়নাহি শেষনাহি নাহি দৈন্যলেশ--. সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে 






No comments:

ইচ্ছেনদী

আমার ল্যাব টা মাউন্ট sinai এর ১০ তলায়, আর আমার ওয়ার্কিং ডেস্কটা একদম জানালার ধারে , বিশাল জানালা। মনে হয় মেঘ গুলো এখুনি ঢুকে পড়বে এর মধ্যে। ...