Tuesday, 10 April 2018

ফিরে এসো

অনেক দূর থেকে ভেসে আসা এক শিশুমনের কান্না আমার সবকিছু কেমন ঝাপসা করে দিলো। খুব মনে পরে যাচ্ছে অনেকদিন আগের কোনো একটা ছোটো মেয়ের কথা, যার বাবার আসতে একটু দেরি হলেই তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠতো। খুব ভয় করতো। মনে আছে দুহাত জড়ো করে ঠাকুরকে বলতো ঠাকুর আমার বাবা যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। যেন এখনই চলে আসে। লুকিয়ে লুকিয়ে খাতার পাতায় ঠাকুরকে লিখতো ওই এক ই কথা। লিখতে লিখতে কতদিন চোখের জলে পাতা ভিজে গ্যাছে , এই আজকের মতোই, আজ ও যেমন ল্যাপটপের কীবোর্ড টা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে শব্দ বারবার। ঠিক তেমন ই, সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটার চোখের জল দেখে, তার বাবাও তাকে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে বলতো, "ভুল হয়ে গেছে মা, আর কখনো হবেনা। দেখো আর কখনো আমি দেরি করবোনা। " মা আর দিদি বলতো উফ এই মেয়েকে নিয়ে আমরা আর পারিনা যেন। কারোর কোনো কথাই শোনেনা।
আজ খুব মনে পড়ছে , আজ ও খুব কাঁদছি আমি বাবা, কৈ তুমি তো আসছোনা। সেইযে আজ থেকে সাত বছর আগে, তখন ও কত করে ঠাকুরকে কে বলেছিলাম, কৈ ঠাকুর শুনলোনাতো, ফিরে এলেনাতো তুমি। জানতেনা তোমার মান্তু কাঁদবে?  তোমার আদরের 'বামি', তোমার মান্তুর কাছে ফিরে এলেনাতো? সবসময় যাকে নিয়ে তুমি চিন্তা করতে, সেই যে বিএসসি এর সময় , msc এর সময় কত কাঁদছিলে তোমরা দুজনে, একে অপরকে ছেড়ে থাকতে হবে বলে কত কাঁদছিলে, মা কত বকলো আমাদের, বললো হ্যাঁ , মেয়ে তো শ্বশুর বাড়ি চলে যাচ্ছে। আজ তোমার মেয়ে সত্যি শ্বশুর বাড়ি গেছে বাবা। সবাইকে নিয়ে সে সাজিয়ে গুছিয়ে সংসার করছে। তুমি যেমন চেয়েছিলে, সেরকম তাকে সবাই খুব ভালোবাসে। আর তুমি যেমন চেয়েছিলে, সেরকম করে সে পড়াশুনো করছে। এগিয়ে চলছে। আর ওই যে সেই শব্দটা? বজ্রকঠোর কুসুমকোমল। ?ওই শব্দ টাও সে মনে রেখেছে বাবা। কোনোরকম চারিত্রিক শৈথিল্য সে বরদাস্ত করবেনা , সে নড়ে যাবেনা দেখো। শুধু রোজ, প্রতিদিন সে তোমাকে খোঁজে, ওই যে তুমি যেভাবে কম্বল বুড়ো সেজে তোমার মান্তুকে লুকিয়ে ফেলতে আর সবাই খুঁজতো তারপর তোমার মান্তু খিলখিলিয়ে হাসতো , আর তুমি তোমার মান্তুর ওই হাসিটা দেখার জন্যে কত কাণ্ডই না করতে। আবার তোমার মান্তুকে লুকিয়ে দাওনা ঐভাবে। জানো , কত কথা আছে তোমার সাথে, কত গল্প, কত অভিজ্ঞাতা।

তুমি সবসময় বলতে "কবে যে এই পাগলিটা বড় হবে", তুমি জানো , তোমার সেই মান্তু কত বড় হয়ে গেছে। সে তার জীবনকে সাজিয়েছে তোমার মতন করে। যেমন তুমি চেয়েছিলে। ভোরে ওঠা, সূর্য্য প্রণাম। যোগ। ঠাকুর পুজো। পড়াশুনা। কাজ। দিনশেষে নিজের সাথে কথা বলা। ব্যাডমিন্টন। হাঁটা। প্রকৃতির মধ্যে, বই এর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া। সবাইকে ভালোবাসা। জানো বাবা, তুমি চলে যাবার পরে , তোমার সমস্ত চেতনা, সমস্ত বোধ দিয়ে আমি পাগলের মতো এই সবকিছুকে আঁকড়ে ধরলাম। আর তোমার চেতনার মধ্যে দিয়ে তোমাকে খুঁজে পেলাম আসতে আসতে। তোমার মান্তু তোমাকে ছাড়া নিজেকে স্থির করতে পারলো। অবশ্য না, ছাড়া তো নয়। তোমাকে নিয়েই সে স্থির হলো। জানো বাবা, আমি রোজ, সবসময় তোমার কথা ভাবি, কিন্তু নিজেকে দিনা তোমাকে miss  করতে। সবকিছুর মধ্যে থেকে, সবার মধ্যে থেকে তোমাকে খুঁজে পাই। শত আঘাতেও হাসতে পারি। তোমার হাসি মুখটা মনে পরে। মনে পরে তোমার মান্তুকে তুমি সবসময় হাসিখুশি দেখতে চাইতে। আমি হাসি। আর জানো , সত্যি ই কোনো কষ্ট আমাকে বেশিক্ষন কষ্টে থাকতেই দেয়না , কোথায় জানো ভালোলাগার স্রোতে সব ভেসে যায়। শুধু ভালোলাগা পরে থাকে।

তবু মাঝেমাঝে খুব মনে হয়, কেন তুমি নেই , কেন সেই দিনগুলো ফিরে আসেনা, কেন তুমি সেদিন চলে গেলে , কেন ঠাকুর সেই ছোট্ট বেলার মতো করে তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলোনা। আজকের ওই ছোট্ট মেয়েটার চাপা কষ্টটা সেদিনের সেই ছোট মেয়েটার উথাল পাতাল মন টার এক ই অনুভূতি কে আবার ফিরিয়ে দিয়ে গেল। ওই কষ্টটা ওই কান্না টা খুব চেনা আমার। সেই কষ্টটা আজ ও এক ই ভাবে সব কিছু শূন্যতায় ভরিয়ে দিয়ে যায়। আর এক ই ভাবে বলে, তারতারি এসো। তাড়াতাড়ি এসো। ফিরে এসো।

তুমি ভালো থেকো। খুব ভালো থেকো বাবা। তোমার মান্তু কষ্টে নেই। সে ভালো আছে। তুমি ভালো থেকো।




No comments:

ইচ্ছেনদী

আমার ল্যাব টা মাউন্ট sinai এর ১০ তলায়, আর আমার ওয়ার্কিং ডেস্কটা একদম জানালার ধারে , বিশাল জানালা। মনে হয় মেঘ গুলো এখুনি ঢুকে পড়বে এর মধ্যে। ...