Tuesday, 24 April 2018

মিষ্টি পৃথিবী

মাসটা বৈশাখ, কিন্তু জানিনা কি কারণে সেই প্রচন্ড দাবদাহ এখনো শুরু হয়নি এখানে। বসন্তের বাতাস যেন কোনো এক বিলম্বিত লয় এ কোকিলের কুহুতানে, কাঞ্চনের স্নিগ্ধতায়, চাঁপার শুভ্রতায় নিজেকে উজাড় করে আটকে রেখে দিয়েছে আমাদের চারপাশ টাতে।

গোধূলী বেলায় ল্যাব থেকে এমনি ই বেরিয়েছিলাম, একটু হেঁটে ফিরে আসতে। হটাৎ কোকিলের কুহু আমাকে যেন কোথায় একটা নিয়ে গিয়ে ফেললো। কোন এক অজ্ঞাত কারণে আজ সারাদিন চারপাশের সমস্ত কথা যেন বড় বাহুল্য মনে হচ্ছিলো। লোকজনের ভিড় এড়িয়ে , কথা, সৌজন্য মূলক হাসি এই সব কিছু এড়িয়ে মন যেন বারবার একটু একা নিভৃতে নীরবে থাকতে চাইছিলো। মনের সেই চাওটাকে সম্মান না করে পারিনি। জোর করে কথা বলতে কিছুতেই আর পারছিলামনা। কাজ একটু হালকা হতেই তাই বেরিয়ে গিয়েছিলাম ল্যাব থেকে। আর বেরিয়েই পেলাম কোকিলের কুহু ডাক সঙ্গে নিমফুলের গন্ধ। ফুলে ফুলে সাদা হয়ে থাকা গাছটা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আমায় ডাকছিলো যেন। সকাল বেলাথেকে কাজের মাঝে মাঝে বারবার মনে পড়ছিলো ওই যে earth day নিয়ে কি করা যায়। দুপুর ১২ টার সময় অনেক গুলো ভাবনা কিছুটা ভালো লাগলেও মন ছুঁয়ে যেতে পারেনি। হটাৎ ওই ফুলে ফুলে ভর্তি নিমগাছ, সবুজ পাতা আর ওই হালকা তিতকুটে কিন্তু কেমন এক মনমাতানো মিষ্টি গন্ধ, একটা খুব মিষ্টি ছবি আর একটা লাইন আমার মনে এনে দিলো "life is still sweet in bitter taste"..নিজের অজ্ঞাতেই লাইন টা যে আমার মুখে হাসি এনে দিয়েছিলো, তা বুঝলাম পাশ দিয়ে যেতে যেতে চেনা একজনএর উক্তিতে, বললো গাছের তলায় একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছি, ব্যাপারটা কি?লজ্জা পেয়ে তারতারি গাছের নিচে থেকে চলে এলাম। ছবিটা নিজের মনেই রাখলাম। ওই গাছটাই গ্রীষ্মের প্রচন্ড রোদে উজ্জ্বল আকাশটাকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে এই পৃথিবীকে প্রকাশ করার জন্যে খুব মিষ্টি এক ভাবনা আর ছবি আমার মনে এনে দিয়ে গেলো। তবে এই প্রথম ভাবনাকে বাঁধ দিলাম। অনেক বার ভাবছিলাম, খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো আমার ওই ছবি, ওই ভাবনা কোথাও পৌঁছে দিতে। কিন্তু জানিনা কেন, মনে হচ্ছিলো থাক, সব ছবি, সব সুন্দর, সব কথা কি ভাগ করে নেওয়া যায়..না কি তা উচিত।

ল্যাব এ ফিরে গেছিলাম। কাজের থেকে বড় আর কিছু বোধয় হয়না, যা মন কে স্থির রাখতে পারে। গত কালের রাত থেকে আজ সারাদিনে চলা এ মনের উত্তালতা আমি প্রকাশ করতে পারবোনা, তবে সমস্ত কিছুর মাঝে এক অন্য অনুভব আমাকে আজ বিস্মিত করছিলো। হয়তো সেই বিষ্ময় থেকে একটু অস্থিরতা এসেছিলো যা আমায় খুব এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছিলো। আসলে কোনোদিন নিজেকে নিজের মনের কথাকে কোথাও প্রকাশ করতে পারিনি। মনে জানতাম, আমার নীরবতার ভাষা বোঝার সাধ্য কারোর নেই। এ বোধয় শুধুই আমার আপনার। আজ দেখলাম, আমার ওই নীরবতার ভাষাও কেউ পড়তে পারে, শত ভাবে নিজেকে লুকোনোর চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েও, হাজার হাজার kiometer এর ব্যবধান তুচ্ছ করেও ওই নীরবতার অন্তর্নিহিত অর্থ বোঝার মতো ক্ষমতাও সত্যি কারোর আছে। সামনে থাকার দরকার হয়না, মুখের প্রতিচ্ছবি দেখার দরকার হয়না, গলার স্বর শোনার দরকার হয়না, তবু নীরবতার ভাষা পড়া যায়। আমার সেই বিস্ময় আরো বেড়ে গেলো যখন দেখলাম, আমার ওই যে পৃথিবীকে খোঁজার প্রচেষ্টা, ...যদিও কোনো কাজে লাগলনা, তবুও সে প্রচেষ্টা ওই নিস্তব্ধতা পড়তে পড়ার মতোই এটাও কারোর নজরের বাইরে ছিলোনা। আর শুধু তাই নয়, ওই যে বলছিলাম, একটা ছবি তৈরি হয়েছিল মনে, - দেখলাম তার খুব কাছাকাছি একদম হয়তো এক নয়, তবু ভীষণ মিষ্টি খুব আদুরে আদুরে উজ্জ্বল চোখের আর ছোট্ট ছোট্ট মেঘের জুতো পায়ে, মাথায় লতা পাতা ফুলের মুকুট পরা মিষ্টি একটা পৃথিবী, যেটা দেখেই এক নিমেষে আমার সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো, সারাদিনে নিজের জন্যে রচিত অজস্র বাধা নিষেধের বেড়া এক ঝটকায় ভেঙে গেলো। এমনকি ভুলে গেলাম নিজের খুঁজে রাখা, ভেবে রাখা ভাবনা গুলোর না কাজে লাগা, শুধু মনে হলো, কি করে হলো, কি করে হলো। ..এই ছবিটাই, এই রকম এ কিছু যা ছিল আমার মনে তা কোথা থেকে কি করে সামনে এলো। একটা ভীষণ এক সন্তুষ্টি এলো মনে, মনে হলো, ওই মিষ্টি পৃথিবীটা রচনাতে যেন আমারও অংশ আছে। অথচ অবাক ব্যাপার আমি যখন খুঁজছিলাম, হয়তো তার আগেই বা সেই সময় এই এর রচনা হয়ে গেছে , তবু কেন জানিনা, একবারও মনে হলোনা যে আমার খোঁজা টা কাজে লাগলোনা, বরং মনে হলো, একসাথে কিভাবে এক ভাবনাতে যেন ওই মিষ্টি পৃথিবী সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে।

একটু আগে ল্যাব থেকে বেরোবার সময় দেখলাম "চোদ্দ টা তিথির খন্ডতা" বোধয় পূর্ণতা পেতে আর বেশি বাকি নেই। মৃদু একটা হাওয়া আসতে করে আমায় বলে গেল, কথা নয়, কথা নয়। মুগ্ধ হয়ে যাও। মুগ্ধতায় ছেড়ে দাও নিজেকে। আর পারলামনা। মনে হলো, ওই চাঁদ, এই আকাশ, নিমফুলের গন্ধ, শ্বেত শুভ্র চাঁপা সব কিছু যেন আমাকে বলে দিচ্ছে, "তুমি ভুল ছিলে , তুমিতো কখনো সুন্দরকে ভাগ করতে অন্য কিছু ভাবোনি, আজ কেন ভাবছো?"
মনে হলো, সব কিছুর সব ভাবনা এক হয়ে মিশে গিয়ে ঠিক যেন এই জ্যোৎস্না রাতের সাথে আগামীর শান্ত সবুজ সকাল  এক হয়ে, স্নিগ্ধ হয়ে আমার দরজায় এসে দাঁড়ালো। দুহাত বাড়িয়ে তাকে কাছে না ডেকে কি ফেরানো যায়।
আর ধরে রাখলামনা নিজেকে, ওই সুন্দরের মধ্যে লীন হয়ে যেতে যেতে বুঝলাম, সত্যি ই আমি ভুল ছিলাম, beauty demands naturality, সুন্দরতার মধ্যে দ্বিধা রাখতে নেই, ভাবনা আনতে নেই। যা স্বাভাবিক, যা সত্যি যা অকপটে মনে ভেসে আসে, যা অকপটে ঠোঁটে আসে, তাই সুন্দর। আর এই সবকিছু নিয়ে আমাদের এই পৃথিবীটা সুন্দর। স্বপ্নের মতো। মিষ্টি পৃথিবী।

No comments:

ইচ্ছেনদী

আমার ল্যাব টা মাউন্ট sinai এর ১০ তলায়, আর আমার ওয়ার্কিং ডেস্কটা একদম জানালার ধারে , বিশাল জানালা। মনে হয় মেঘ গুলো এখুনি ঢুকে পড়বে এর মধ্যে। ...