প্রচন্ড ঠান্ডাতে বিছানা ছেড়ে উঠে, ধরা চুড়ো পরে তৈরি হয়ে বাইরে বেরোতে হবে এটা ভেবেই গায়ে জ্বর এসে যায়, তারপর যদি সেই ভোর বেলাতে যদি বৃষ্টি হয়, তাহলে তো আর কথায় নেই।
তো গত কালকে আমার সকালটা শুরু হয়েছিল এই ভাবেই। কিন্তু করার কিছু ছিলনা, কারণ একদিন ছুটি নিয়ে পরের দিন ল্যাব এ যাওয়া টা দরকারী তো ছিলই , তার থেকেও দরকারী ছিল খুব প্রয়োজনীয় কিছু স্যাম্পল কালেকশন। মানে মানুষ্ নিয়ে কাজ কর্ম করলে যা হয় আর কি, তাদের DNA পাবার জন্যে (মানুষ্ যে আর বেচারা গিনিপিগ কি ইঁদুর নয়) তাই তাদের সময় মতো যখন তারা বলবে, তখন ই তাদের কাছে ছুটে গিয়ে saliva মানে সোজা কথায় থুতু নিয়ে আসতে হয়। কি অবস্থা আর কি, সকাল বেলা, শীত সঙ্গে বৃষ্টি উপেক্ষা করে , বিছানার নরম গরম আরাম ছেড়ে লোকের থুতু আনতে যেতে হবে। মনে মনে এসব ই বলতে বলতে, গজগজ করতে ব্যাগ পত্র নিয়ে আমি বেরিয়ে পরলাম আর বৃষ্টির ছাট বাঁচিয়ে ভুট ভুটিয়া করে পৌছে গেলাম মেট্রো স্টেশন এ। এদিকার লাইন এ বসার জায়গা পেলেও, পেলামনা ওদিককার লাইন এ, ফলে ৪০ মিনিট দাড়িয়ে দাড়িয়ে যখন সিকান্দার পুর মেট্রো স্টেশন এ পৌছলাম, বলাই বাহুল্য, মনে মনে ভেবেই নিয়েছিলাম যে দিন টা আজ নেহাত ই বাজে যাবে। এরপর সুভাদির পরিচিত বাবলু ভাই এর অটোর জন্যে অপেক্ষা আমার বিরক্তি আরো বাড়িয়ে তুলেছিল। বাইরে তখন বেশ বৃষ্টি হচ্ছে।
মনে মনে ঠিক করলাম যে চটপট স্যাম্পল নেব আর ৫ মিনিটের মধ্যেই আসব। বাবলু ভাইকেও সেরকম ই বলে ডোর বেল বাজালাম, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একজন মাঝাবয়সী সুন্দরী মহিলা উঁকি দিলেন আর এক অপূর্ব উষ্ণ অভ্যর্থনা করে আমাকে ভেতরে ডাকলেন। এত সুন্দর অভ্যর্থনায় এবং ওনার আমাকে ডাকার মধ্যে এমন এক আন্তরিকতা ছিল যে যা আমাকে মুহুর্তের মধ্যে সহজ করে দিল। জুতো খুলতেই খুলতেই আমি শুনলাম, উনি আমাকে বলছেন "I am sure , u need coffee". ওনারা হিন্দি বা বাংলা জানেননা, কারণ ওনারা পার্সি। নিজেদের মধ্যেও ওনারা ইংরাজি তেই কথা বলেন। এরপর ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই বাড়ির মালিক প্রায় ৮৫ ও ৮০ বছরের শক্ত সমর্থ ও সক্রিয়, ধোপ দুরস্ত ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী আমাকে এমন ভাবে দুহাত বাড়িয়ে ভেতরে ডাকলেন, যে মনে হলো যেন বহু বছর পরে আমার নিজের দাদু, ঠাকুমা আমাকে দুহাত ভরে কাছে ডাকলেন। আমার দাদু, ঠাকুমার অভাব আমার বহু দিনের। ছোট বেলাতে তাদের কাছে শুএ শুএ গল্প শোনা তো আমার হয়নি। তাই ওই ভদ্রমহিলা যখন আমাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলেন ,মুহুর্তের মধ্যে আমার চোখে জল এসে গেছিল। না দেখতে দিইনি কাউকে আমি তা, চোখের জল লুকিয়ে মুখে হাসি আনতে আমার এখন কোনো অসুবিধে হয়না। কিন্তু কোন অমৃতে ওনারা মাত্র একবারের পরিচিতিতে প্রায় অদেখা, অচেনা এক মেয়ে কে এত কাছের করে নিতে পারলেন। বাইরে বেড়িয়ে বাবলু ভাইয়ের ও কোনো অসুবিধে হচ্ছে কিনা, তা দেখে এলেন। ৫মিনিট থাকব ভেবে এসে, ২৫ মিনিট কেটে গেল নানান কথায়। এত আন্তরিক এত সুন্দর ব্যবহার আমাকে ভুলিয়ে দিল সকালের বিরক্তি। বরং মনে হলো যে এখানে না এলেই বুঝি আমার মানুষ্ সম্পর্কে আরো জানা বাকি থেকে যেত।
বয়স্ক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা গুরগাঁও তে থাকেন, দুই মেয়ে, দুজনেই বাইরে। প্রতি বছরে এই সময় ছোট মেয়ে ওনার পুরো পরিবার নিয়ে কানাডা থেকে আসেন এবং বেশ অনেকদিন থেকে যান।এবছর ও তাই এসেছিলেন। তার মধ্যেই আমি আমার কাজের জন্যে ওনাদের বাড়ি যাই , আমি ছিলাম ওনাদের সেই মিষ্টি গেট টুগেদার এ একেবারেই অযাচিত , অন্য কেউ হলে বিরক্ত হত, কিন্তু ওনারা সেই বিরক্ত হবার বদলে আমাকে যে ওই ভাবে আপন করে নেবেন, ভাবতেই পারিনি। আপন করা বা না করা হয়ত একটু বেশি দুরের কথা, আমি কিছু ইমোশোনাল হয়েই বলে ফেলেছি কিন্তু ওই ভাবে ভেতরে ডাকা? আমার জীবনে খুব কম মানুষ্ অন্য কাউকে এভাবে সাদর অভ্যর্থনা করতে দেকেছি , তাদের মধ্যে সবার আগে বলতে হয় আমার বাবার কথা। আমাদের বাড়িতে যত লোক ই আসুক না কেন, বাবা সব সময় হৈহৈ করে ডাকত। আর সেটা মন থেকে না হলে কখনো কেউ ওভাবে বাইরের লোক কে ডাকতে পারেনা।
একটা সুন্দর হাসি, একটা সুন্দর ব্যবহারের এত গুণ যে আমার গোটা দিনটাই কালকে যেন বদলে গেছিল। nbrc এসেই সবার সাথে আপনা আপনি ভেতর থেকে একটা ভালো ব্যবহার আমার বেরিয়ে আসছিল। অনেক সময়, অনেক দিন আমি ভেবেছি, দূর ওর সাথে কথা বলবনা, ও আমাকে এভাবে বলল, আমার আত্ম সম্মান এ আঘাত হলো, আমার বাবা অবশ্য সব সময় বলত, এমন কি অর্নব ও বলে, আত্ম সম্মান কি এতই ঠুনকো , একটু কথাতেই আঘাত লাগবে? তখন বুঝিনি, কালকে মনে হচ্ছিল কি হবে এসব ভেবে, নিজেকে এত শক্ত করে রেখে, ভেতরের যে ভালোলাগা তা যেন ভালবাসা হয়ে সবার দিকে ছড়িয়ে পরেছিল। কে কতদিন, আর কার সাথে থাকব, কিন্তু এই যে দুদিনের দেখা, কথা, তার মধ্যে দিয়ে নাহয় নিলাম ই সবাইকে আপন করে। এই যে ওনাদের এক মুহুর্তের ভালো ব্যবহার আমার সারা দিন তাকে প্রজাপতির পাখার মত হালকা করে দিল, এরপর আমার ওনাদের সাথে ভবিষ্যতে কখনো দেখা হোক বা না হোক, ওই সুখস্মৃতি টা তো থেকে যাবে।
গত কালকের সেই সুন্দর ব্যবহার আমার মন থেকে অনেক বাজে স্মৃতি মুছে দিতে সাহায্য করেছে। আগেও এরকম হয়েছে, তবে কালকে আমি সত্যি ই আমার মনের ভেতরে জমে থাকা রাগ, দুঃখ , ক্ষোভ, বিরক্তি থেকে , কিছুটা না হলেও খানিকটা মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। হয়ত সেইসব ক্ষোভ, দুঃখ রাগ আমার একসময়ের ভালবাসা আর expectation থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু থাকনা, সবাই তো সব কিছুর উপযুক্ত নয়, যে যেমন ভাবেই আমার কাছে আসুক না কেন আমি কি তাদের কে আমার ভালবাসা দিয়ে আমার মতো করে আমার কাছে রাখতে পারিনা? প্রতিদানে নাইবা পেলাম সে ভালবাসা, কি হয়েছে তাতে, তবু আমি তো দিতেই পারি।
আমার সেই একদিনের সুন্দর অভিজ্ঞতা নিজেকে একটু হলেও মানুষ্ বলে ভাবতে সাহায্য করলো কি? জানিনা। তবে এই ভালো লাগা থেকে আমি বেরিয়ে আসতে চাইনা। কালকে ফিরে আসার পর থেকেই খুব লিখতে ইচ্ছে করছিল ওই মানুষগুলোর কথা, এই অভিজ্ঞতার কথাই লিখতে বসে আমার নববর্ষ পালন এর কাহিনী লেখা হয়ে গেছিল।