জীবন মাঝেমাঝে অদ্ভুত কিছু মোড় নেয়। তারপর আমরা চলার নিয়মে সেই মোড় ধরেই চলতে শুরু করি। আর তারপরে অনেকটা চলে আসার পরে যদি পিছন ফিরে তাকাই আর দেখি কেমন ছিল সেই পথ টা , তখন কখনো ঘিরে ধরে বিষন্নতা, কখনো হয় রাগ, কখনো কষ্ট আবার কখনো কখনো অদ্ভুত একটা ভালোলাগা ঘিরে ধরে। বুঝতে পারি ওই মুহূর্তের তাৎপর্য্য। যা সেইসময় দিয়েছিলো শুধুই অবাক অভিজ্ঞতা। তাই আবার সেই পথ ফেলে আসার পরে তুলে ধরে সেই সময়ের সুন্দরতা। প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততায় রোজনামচা হয়ে ওঠা অনেক কিছুই হটাৎ করে ফিরে পায় তার স্বমর্যাদা, ভীষণ ভাবে আবার চাই সেই সমস্ত কিছুকে মনে করতে যা আমাদের ফেলে আসা বন্ধুর পথে হাত ধরেছে, একসাথে হেঁটে আসা পথটাকে দেখি তাকিয়ে, হয়তো অজান্তে আঁকড়ে ধরতে চাই আলগা হয়ে যাওয়া হাতের আঙ্গুল। সম্পর্কের বুনিয়াদি কে আর একবার দেখে নি যত্ন করে , মজবুত আছে কিনা। আর এই ফিরে দেখতে গিয়ে অনেক সময় ই নতুন করে খুঁজে পাই অনেক কিছু, অনেক মুহূর্ত যা তার নিজ নিজ তাৎপর্য্য আর বোধ নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসে। "ফিরে দেখা " তাই বোধয় কখনো কখনো খুব দরকার।
আজকের দিনটা শুরু হয়েছিল ঠিক এমন ই কিছু শিরশিরানি অনুভূতি দিয়ে। বছরের প্রতিটা মুহূর্তের , প্রতিটা সময়ের আলাদা কিছু অনুভব আছে, আলাদা গন্ধ, আলাদা বর্ণ , আলাদা আলাদা, distinct feel . এবারে ঠান্ডাটা বোধয় একটু আগেই পড়েছে, একটু বেশি ই আর কিছু আগেই হয়তো বা। আর তাই নভেম্বর এর শুরুতেই কেমন ডিসেম্বর এর বোধ এনে দিয়েছিলো। সময়ের আগু পিছুতে হটাৎ উপুড় হয়ে গেছিলো স্মৃতির ঝাঁপি। এক একটা শব্দ , এক একটা ভালোলাগা, কিছু ভালোবাসার অকপট প্রকাশ হটাৎ করে চোখ ভরিয়ে দিলো, দুচোখ ছাপিয়ে গাল ভিজিয়ে দিতে থাকলো বারবার। চোখের জলকে আমি আটকাইনা , কিন্তু তবুও কি যে হয়েছে ছাই , সেই গত কাল সন্ধে থেকে এ যেন বন্ধই হতে চাইছেনা। বেয়েই চলেছে। উফ কি যে করি একে নিয়ে, থামাতেই পারছিনা যে।
যদিও গত কাল সন্ধের সেই জলের মধ্যে ছিল যেন এক অদ্ভুত অন্যরকম কষ্ট। আর আজকের এই জলের মধ্যে সেই কষ্টের বোধ নেই, কি যে ঠিক আছে তাও ঠিক তেমন যে জানি তা নয়, তবে কষ্ট নয়, কেমন যেন এক শান্ত স্তব্ধ শান্তির বোধ। যা চোখে জলের সাথে সাথে ঠোঁটের কোণে টেনে দেয় হাসির রেখা। সেই যে ঠান্ডার মধ্যে বাবা এসে গায়ে যখন চাদর জড়িয়ে দিতো, সেইরকম গরম উষ্ণ একটা ভালোলাগা আমার সারাদিন টাকে কেমন এক উষ্ণ নিশ্চিন্ততা দিয়ে জড়িয়ে রাখলো যেন। কেন জানো ? ওই যে, ফেলে আসা পথ টার দিকে যখন তাকালাম তখন দেখলাম সেই পথে খানা খন্দ , চড়াই উৎরাই হয়তো ছিল অনেক, কিন্তু সেসব আমরা খুব সুন্দর করে পেরিয়ে এসেছি, আর গোটা পথটা যেন শুধু ওই বেলি, গন্ধরাজ, মাধবীলতার গন্ধে ভোরে আছে। অপরাজিতা , শিউলি আর কাশ ফুলে ফুলে সে পথ ভোরে আছে, আছে চাঁদনী রাতের স্নিগ্ধতা, আছে নতুন ভোরের আহ্বান, আছে পলাশের হাতছানি, গোধূলির রক্তিম মায়া। আর এই সবকিছুর মায়া যেন কেমন অদ্ভুত এক টান তৈরি করছে। ভীষণ এক বিশ্বাস। ভালোলাগা, যা থেকে অমলিন ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। বুঝলাম ওই যে ওপরে যিনি বসে আছেন, তিনি হয়তো ঠিক তাই চান, শেষ হবার হলে হটাৎ শুরুর মতো আবার হটাৎ শেষ ও হয়তো হয়ে যেতেই পারতো , অমলিন হবার হলেও হয়তো লাগতেই পারতো তাৎক্ষণিক glitter এর আড়ালে অমলিনতার দাগ। কিন্তু হয়নি। শেষ ও হয়নি। অমলিন ও হয়নি। বরং ওই যে, আরো বেশি সুবাসিত হয়েছে। পেয়েছে সকালের পবিত্রতা। জীবনের বিশ্বাস। বাঁচার আনন্দ।
এই প্রথম জানিনা কেন ভীষণ এক টান অনুভব করছি। ভীষণ টান। অদ্ভুত ভালোলাগা। আলোর মতো আনন্দ। নিজের প্রতি বিশ্বাস। অন্যের প্রতি বিশ্বাস। বেঁচে থাকার প্রতিটা দিনের আনন্দ। প্রতিটা মুহূর্তের উজ্জ্বলতা।
মনে পড়ছে 'fireflies', যা ঠিক ওই জোনাকির মতোই যেন নিভে জ্বলে আমাদের আলোকিত করছে, অন্ধকারে পথ দেখাচ্ছে। শান্তিনিকেতন কি শুরু থেকেই একদম অগোচরে, অজান্তে শান্তির নিকেতন তৈরি করে রেখেছে? বারবার নাহলে কেন ওই বুড়ো লোকটা তার সমস্ত ছন্দ, বর্ণ নিয়ে সেতু বন্ধনের কাজ করে গেছে ? হটাৎ সেই সকালে নাহলে কেন খুঁজে পেয়েছিলাম
"আজ নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও,
মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও ।"
"আজ নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও,
মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও ।"
ওই বুড়ো লোকটা কি তার ছন্দে ছন্দে সত্যি সত্যি দেবদারু তলা সাজিয়ে রাখছে? কিজানি। হয়তো বা। যার কাজ সে করুক, আমরা কিছু ভাববোনা। 😊 আমরা বরং হাঁটতে থাকি, চলার আনন্দে। অনেক কাজ বাকি, অনেক কিছু জানার, অনেক কিছু বোঝার, অনেক কিছু শেখার বাকি। অনেকটা পথ বাকি, ক্লান্ত হলেও চলবেনা, থেমে গেলেও চলবেনা। পথের শেষে হয়তো কেউ ঝালমুড়ি বানিয়ে, বাদাম ভাজা নিয়ে অপেক্ষা করবে, দেখাই যাকনা, এই পথ সেই দেবদারুতলায় গিয়ে লাল কাঁকরের পথে মেশে কিনা। 😊 ততক্ষন চলো সৃষ্টির আনন্দে স্রষ্টার প্রতিটা মুহূর্ত ভরিয়ে দিয়ে নিজেদের করি সমৃদ্ধ, আর সেই আনন্দে আমাদের 'আমি' রা যেন চারিদিক মঙ্গলময় করে তুলতে পারে।
আর একটু পরেই গোধূলি নামবে, দিনের শেষে দিন শুরুর সেই এক ই কথা বারবার করে বলতে ইচ্ছে করছে
"আমার পরান-বীণায় ঘুমিয়ে আছে অমৃতগান—
তার নাইকো বাণী, নাইকো ছন্দ, নাইকো তান ।
তারে আনন্দের এই জাগরণী ছুঁইয়ে দাও ।
বিশ্বহৃদয়-হতে-ধাওয়া প্রাণে-পাগল গানের হাওয়া,
সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার নুইয়ে দাও ॥
"আমার পরান-বীণায় ঘুমিয়ে আছে অমৃতগান—
তার নাইকো বাণী, নাইকো ছন্দ, নাইকো তান ।
তারে আনন্দের এই জাগরণী ছুঁইয়ে দাও ।
বিশ্বহৃদয়-হতে-ধাওয়া প্রাণে-পাগল গানের হাওয়া,
সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার নুইয়ে দাও ॥
আলোকের এই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও ।
আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা
ধুইয়ে দাও ॥"
আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা
ধুইয়ে দাও ॥"