পঞ্চমীর সন্ধে পেরিয়ে এখন রাত। ঢাকের শব্দ, রাস্তায় লোক জনের ঢল আর আলোর রোশনাই এখান থেকে চোখে পড়ছেনা। একটু ফাঁকা লাগছিলো তাই আজ বিকেল থেকে। ইচ্ছে করছিলো, বাড়ির ambience টা পেতে। অনেক লোকজন, আত্মীয় স্বজন, হৈ হৈ, এটা ওটা খাওয়া, রান্না, আলতা সিঁদুর শাঁখা শাড়ি। দুপুর বেলা আধশোয়া হয়ে জানলা দিয়ে এসে পড়া ওই বাঁকা রোদটাতে শুয়ে শুয়ে আনন্দমেলার পাতা ওল্টানো। বিকেল বেলা বাড়িতে বসে ভাই বোনদের জমজমাটি আসর। ছোটথেকে একটু একা একা বড় হওয়ার জন্যে ওই জমজমাটি আসর আর আত্মীয় স্বজন দের ভিড় আমার খুব ভালো লাগে। বিয়ের পরে তাই আমার বন্ধুবর টির বড় ফ্যামিলি কে এককথায় আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে বেশি সময় তো নয় ই কোনো সময় ই লাগেনি আমার। কিন্তু ওই যে হয় কি, যে সহজেই পেয়ে আসে অনেক কিছু তার তাতে অনীহা আসে আর যে পায়না তার থাকে পাওয়ার পিপাসা। তাই সবথেকে ভালো হয় যদি কেউ কিছু না পাওয়া থেকে হটাৎ কিছু পায়। সঠিক মূল্যায়ন হয় হয়তো তাতে।
সে যাই হোক, কি কথা থেকে কি কথা এসে যাচ্ছে। আসল ব্যাপারটা হলো আজ পুজোর দিন। ছোটবেলার পুজোর ছুটি নেই, নতুন জামার গন্ধ নেই, নতুন পড়ার অপেক্ষা নেই। আনন্দমেলা শুকতারার কাড়াকাড়ি নেই। বাবা কে প্রণাম করা নেই। তবুও আজ পঞ্চমীর রাত। বাতাসের শিরশিরানি শীত শীত ভাব, নীল আকাশ আর ঝকঝকে রোদ্দুর বলে দিচ্ছে পুজো এসেছে।
'নেই'তো আমাদের জীবনে কতই থাকে,তবু আছেও তো কত কিছু। সেই থাকার মধ্যে দিয়ে বারবার মনে পড়ছে গত কাল সেই সন্ধের সময় কালীবাড়ি গেছিলামনা? সেখানে দেখা গাঢ় নীল অপরাজিতা আর গোলাপি পদ্মের একশো আটটা মালা দিয়ে সাজানো মা এর কথা। কালকে সব ঠাকুরের ছিল হলুদ এর সাজ। চওড়া লাল পাড় হলুদ তাঁতের শাড়ি আর গলায় গাঢ় নীল অপরাজিতা আর একশো আট গোলাপি পদ্মের মালা। সন্ধ্যারাতির সেই এক ই ঘোর। সন্ধ্যারতির একটানা শব্দ ছাড়া চারিদিক খোলা মন্দিরটা তে আর কোথাও কোনো শব্দ নেই। ধুপ, ধুনো কর্পূরের গন্ধ। প্রদীপের আলো। ধীরে ধীরে কেমন সব কিছু শান্ত স্থির হয়ে এলো। হটাৎ করে চোখে জল চলে এলো।
আমাদের দৈনন্দিন চাওয়া পাওয়ার হিসেব নিকেশে আমরা এতটাই জর্জরিত থাকি যে অনেক সময় ই আমাদের চারপাশের ভালোলাগা গুলোকে খুঁজে পেতেই ভুলে যাই। হয়তো মিথ্যে ভার্চুয়াল দুনিয়ার মধ্যে নিজের সুখ খুঁজতে ছুটে যাই সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে। হটাৎ করে অনেক কিছু প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকি অন্য কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটার আশায় অথবা আমাদের নিজেদের ই তৈরি কিছু অভ্যেস এর কাছে। কিন্তু ভুলে যাই, যে অভ্যেস একদিন হটাৎ তৈরি হয়ে গেছিলো, কিছু ভেবে নয়, কিছু আশা করে নয়, এমনি ই সহজাত আকুলতা আর সম্পর্কের মিষ্টতা থেকে আসা সেই অভ্যেস এর মধ্যে থাকে এক সহজাত spontaneous ভালোলাগা। ঠিক ওই চাঁপা বা শিউলির মতো, যেভাবেই ফুটুক যেখানেই ফুটুক সেই এক ই সুবাস, সেই এক ই মিষ্টতা আসবেই তার থেকে। এও যেন ঠিক তেমন। সেই সুবাসিত প্রস্ফুটিত শিউলি বিছানো পথে আগামীর দিনগুলো ভোরে উঠুক শুধু বাধ্যবাধকতার হাজার টানা পোড়েনে ওই শিউলি যেন নিষ্পেষিত না হয়ে যায়।
আমাদের চলার পথে গড়ে ওঠে কত শত ঘটনা, কত সম্পর্ক, কত জানা, কত চেনা, সময় এগিয়ে চলে, কারোর জন্যে থেমে থাকেনা। আমরা চাই বা না চাই আমরাও সেই সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে চলি। দিন শেষে অস্তগামী বিদায়ী সূর্য্যকে সাক্ষী রেখে পরের দিনের উদয় এর আশা বুকে নিয়ে চাঁদের আলোয় দিগন্ত ভেসে যায়। আবার সেই চাঁদ ও ঢলে যায়, নতুন ভাবে নতুন দিনের শুরু হয়। আর এইভাবেই কেটে যায় মাসের পর মাস বছরের পর বছর। কাল যা ছিল আজ যে তা থাকবেই তাও সবসময় সত্যি হয়না। পরিবর্তনশীল জগৎ সংসারে কেউ কেউ অপরিবর্তনীয় ভাবে থেকে যায় অচঞ্চল আবার ঘটনার প্রবাহে কেউ নিজেকে ভাসিয়ে দেয় সেই স্রোতে। তবে যাই ঘটুক বা যাই ঘটতে চলুক ই না কেন, আমি তো জানি এর পিছনে কারসাজি ওই একজন এর ই। সবার ওপরে বসে সে মুচকি মুচকি হাসে আর বলে, কেমন পারলিনা তো স্থির থাকতে? ভেসে চলে গেলি? ফিরিয়ে দিলি তাকে? যাকে পাঠালাম তোর হাত ধরতে? চিনতে পারলিনা? দেখি এবার কি করিস? অথবা বলে কিরে পারবিতো সবকিছুকে শক্ত হাতে সামলে রাখতে? ভুল করবিনাতো? ঠিক বুঝবিতো? এইরকম কত কথা তার, কত তার ইশারা, কত তার মায়া , কত স্নেহ। রাগ হলেও আমি তার সাথে ঝগড়া করি, অভিমান হলে মুখ ফিরিয়ে থাকি কষ্ট হলে কেন কেন করে অস্থির হয়ে যাই। আবার জানি, যা কিছু হয় বা যা কিছু যা কিছু হচ্ছে তা কোনো এক সুন্দরের, এক শুভ চিন্তায় হচ্ছে। এতো কিছু ভেবে আমরা কি করবো, আর ভাববই বা কেন। আমাদের তো শুধু আমাদের প্রতিটা দিনের প্রতিটা মুহূর্তের সমস্ত দায়িত্ব কর্তব্য সঠিক ভাবে পালন করার কথা। না ঠান্ডা গলার শুখনো দায়িত্ব নয়। মন থেকে ভালোবেসে, উষ্ণ কর্তব্য। উত্তপ্ত নয় মিষ্টি কথোপোকথন। সত্যি কারের আত্মার বন্ধন। আমরা শুধু এই টুকু করি? বাকি যেটুকু করার আর যার করার, তিনি সব করে দেবেন। আমাদের পথ নির্দিষ্ট। সেই পথে চলার সময়টুকু কিভাবে কার সাথে ভাগ করে নেবো তাও। আমাদের শুধু দেখতে হবে ওই পথের সৌন্দর্য্য যেন অমলিন থাকে। বাকি দিলাম ছেড়ে সবকিছু ওই মহাকালের হাতে। কালের নিয়মে সবকিছু আপন আপন ক্ষেত্রে, আপন ছন্দে স্পন্দিত হবে। এর মধ্যে আমি নেই তুমি নেই, আমরা কেউ নেই। আর যতবার ই সেই অসীম মহিমার কাছে নিজেকে সমর্পন করে দি, অমনি মনে হয় যেন চারিদিকে কোথাও কোনো "নেই" নেই, আছে শুধু নিরঞ্জন আনন্দএর বোধ আর অসীম নিশ্চিন্ততার স্নিগ্ধতা। কি শান্তি, কি স্বস্তি, কত আলো আর একরাশ ভালোলাগা। আমার খুব প্রিয় সেই সুর মনে নিয়ে ঘুমোতে গেলাম আজ "তুমি সুন্দর যৌবনঘন রসময় যাবো মূর্তি,
দৈনভরণ বৈভব তব অপচয় পরিপূর্তি।
নৃত্য গীত কাব্য ছন্দ কালগুঞ্জন বর্ণগন্ধ-
মরণহীন চিরনবীন তব মহিমাস্ফুর্তি।
No comments:
Post a Comment