আজ ও আকাশে চাঁদ। কার্তিক মাসের হিম হিম নিস্তব্ধতা, জঙ্গল থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝি পোকা আর ও কত অদ্ভুত শব্দ মাঝেমাঝে এই শীতল নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে। ব্যালকনিতে বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলে ঠান্ডা লাগছিলো, আবার ঠিক সেখান থেকে সরেও আসতে ইচ্ছে করছিলোনা। হাতে পড়েছিল কাজ, সেগুলোর দিকেও ঠিক মন বসাতে পারছিলামনা। এমন সময় ওই যে রাত জাগা পাখি, এক ঝাপটাতে উড়ে যেতে যেতে যেন মনে করিয়ে দিয়ে গেল। মন বসাও। মন বসাও।
মন হলো ভারী এক অদ্ভুত জিনিস। ছোটথেকেই আমার একা থাকতে ভয় হতো। অথচ, কি পরিহাস দ্যাখো, দিনের বেশিরভাগ সময়টাই কাটতো আমার একা একা। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা থাকতো বাবার বাড়ি ফেরার। কারণ বাবা মানেই যে ছিল গল্প, হাসি, মজা। হাজার আনন্দ।
বড় হবার পর থেকেই থিতু হতে চাইতাম। স্থিরতা চাইতাম। কিন্তু যত বেশি স্থিরতা চেয়েছি, ভাগ্য ততবেশি আমাকে অস্থিরতার মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। বিএসসি করার সময় থেকেই শুধু ভাবতাম যাহোক করে একটা চাকরি নিয়ে বিয়ে করে সংসার করবো চুটিয়ে। জানি, এমন কথা শুনে অনেকের ই চোখ কপালে উঠবে, ছি ছি করার মতো কথা তো বটেই। কিন্তু কি করবো আমি যে একদম সাধারণ এক মেয়ে। অকপটে এ কথা স্বীকার করতে আমার দ্বিধা নেই যে এমন কথা আমি সত্যি ই ভাবতাম। অতন্ত্য ছাপোষা সাধারণ এক মেয়ে আমি। যে সন্ধ্যে কে আনতে চায় ধুপ ধুনোর স্নিগ্ধ সান্নিধ্যে, চায়ের গরম কাপের মধ্যে দিয়ে, রাত্রে যার একা থাকতে ভয় করে, সূর্য্যপ্রনামের মধ্যে দিয়ে যার দিন শুরু হয়। দুচোখে স্বপ্ন নিয়ে অথচ সচেতন ভাবে যে স্বপ্নের মতো জীবন যাত্রা চায়। থিতু হতে চায়।
থিতু হতে আমি পারিনি এখনো। শুধু অন্ধের যষ্ঠির মতন সহায় আছে এখনো আমার জ্ঞান পিপাসা টা। আর যেন কোথাও কিছু নেই। হটাৎ চোখ জ্বালা করে উঠলো। পরক্ষনেই হাসি পেলো। এখনো বুঝি অভিমান হয়। এখনো বুঝি ঝগড়া করিস ঠাকুরের সাথে, নিজের মনেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম। নাহ , এখন আর অভিমান হয়না। সবকিছুতে, সবকিছুর মধ্যে মনে হয় ঠিক আছে। সব ঠিক আছে। all okay . everything is okay.
আমার জুনিয়র রা বলে, আমি নাকি আলাদা, ডিস্টিংক্ট, বলে নাকি আমার মধ্যে ক্ষমতা আছে স্ট্রেস handle করার, সহ্য করার। হাসি আবার। কিজানি বা, হবে হয়তো। হয়তো আছে, আর ঠাকুর সেইজন্যেই হয়তো আমাকে সুখী গৃহকোনের কোণ টা তে এনে ফেলেনা কিছুতেই। একটা, সুন্দর, নিস্তরঙ্গ , থিতু জীবন দেয়না হয়তো তাই। নাহ , এসব কি ভাবছি। এই যে আদিগন্ত চরাচর ভাসিয়ে আমার চাঁদ তার স্মিত মুখখানি তুলে তাকিয়ে আছে, ওই যে গভীর ঘন জঙ্গল। নাহয় বন ফায়ার ওখানে হচ্ছেনা, violin বাজিয়ে গান ও নয়। তবু এইসব ও কম বা কি। জীবন যেভাবে যখন যা দেয় , তাকেই যে দুহাত ভোরে গ্রহণ করতে হয়। নাহলে ওই যে, ধরো তোমাকে সর্বস্ব দিয়ে কেউ যত্ন করতে চাইছে, ভালোবাসছে, খেয়াল রাখছে, কিন্তু তুমি তাকে অবহেলায় দূরে সরিয়ে রাখছো, বুঝতেই পারছোনা, সে না চাইতেই তোমাকে ভরিয়ে রাখতে চাইছে। তারপর একদিন অবহেলা করতে করতে তুমি তাকে হারিয়ে ফেললে, আর খুঁজেই পেলেনা কোথাও। তখন? তখন সেই সমস্ত কিছুকে একটু ছোঁবার জন্যে তুমি আকুল হবে। কিন্তু আর পাবেনা। আজকের ওই রাত জাগা did you do it বলা ওই লম্বা লম্বা ঠ্যাং এর পাখিটাও যেন ঠিক তাই বলে গেলো আমায়। গ্রহণ করো। গ্রহণ করো। প্রতিটা মুহূর্ত এর অমৃত সুধা আকণ্ঠ পান করো। দুঃখ তো একটা নেশার মতো, দুঃখের কথা ভাববে, একের পর এক দুঃখ ভেসে আসবে মনে। এই পাইনি, ওই পাইনি। পায়নি কি তা ভাবতে ভাবতে যে যা পাচ্ছ সেটা হারিয়ে যাচ্ছে। তাই পাইনি নয়, পেয়েছিও যে কত কিছু। কত কিছু। চোখটা আবার জ্বালা করে উঠলো। সত্যি তো এমন মায়াবী রাত। দুধসাদা জ্যোৎস্না। নরম চাদরের মতন একটা গভীর রাত। এইসব যে আমার জন্যে আছে। পাখিটা আবার ডেকে উঠলো, did you do it ? নারে পাখি, করিনি আমি, অনেক কাজ এখনো বাকি পরে আছে। করা হয়ে ওঠেইনি। করবো। তুই শুধু মাঝেমাঝে মনে করিয়ে দিস তো, বলিস আমায়, বকিস, ডাকিস did you do it . আমি আমার সবটুকু ক্লান্তি কাটিয়ে আবার হাসি মুখে এই পৃথিবীকে দেখবো আর বাকি পরে থাকা কাজগুলোকে সম্পূর্ণ করবো।
No comments:
Post a Comment