সন্ধ্যের আজান এর শব্দ ভেসে এলো দূর থেকে। রোজ ই এই সময় সন্ধের আজান হয়, তার ও আরো একটু পরে নামে সন্ধ্যে। আর তখন আমার তুলসী তলাতে জ্বলে ওঠে প্রদীপ। সেই ছোটো বেলা থেকে এক ই ভাবে, এক ই নিয়মে এই এতগুলো বছর ধরে হয়ে আসা সেই এক ই অভ্যেস। কি যেন এক ঘোর আছে ওই শব্দে, কি যেন একটা মনখারাপ করা উদাস সুর, দিনের শেষ সূচনা করে।
ছোট বেলাতে এই শব্দ শুনে ছাদ থেকে নামতাম। এইটা ছিল আমার ছাদে থাকার মাপকাঠি। এর পরে আর ছাদে থাকা যেতোনা, বাইরে তো নয়। তারপর বড় হলাম, এই শব্দ কে ভাগ করে নেবার সঙ্গী পেলাম। পাঁশকুড়ার ওই শান্ত সবুজ জলা, জমির মধ্যে দিয়ে শীতের ধোঁয়া ধোঁয়া সন্ধের মধ্যে দিয়ে, আজানের শব্দের মধ্যে দিয়ে সন্ধ্যে নামতো। আর দুজন, সদ্য ভালোবাসা কে ঠিক করে বুঝে উঠে না উঠতে পারা ছেলেমেয়ে ওই অবাক সুন্দরের মধ্যে দিয়ে সেই ভেজা নরম হয়ে আসা শান্ত সন্ধ্যে নামাকে আবাহন করে নিত। মনের ভেতরে কত ঢেউ , সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। মনের মধ্যে শুধু একটাই চিন্তা তখন, আচ্ছা থাকতে পারবো তো একসাথে? গাড়ি নয়, বাড়ি নয়, বড় বড় দেশ বিদেশের লক্ষ্য স্বপ্ন নয়, দামি রেস্টুরেন্ট এ খাওয়া নয়, এই পৃথিবীর কোথায় কে কত বড় বড় বিজ্ঞান করছে, কে কতটা সাফল্য পেয়েছে জীবনে, কার সাথে মেশা উচিত আর কার সাথে মেশা উচিত নয়, এসব কথা দুঃস্বপ্নেও আসতোনা। জীবন তখন শুধু যেন এক টাই লক্ষ্যে, একটাই ছন্দে ছন্দিত হয়ে চলতো। ভালোবাসা, ভয়, অনিশ্চয়তা মেশানো ভবিষ্যতের স্বপ্ন। একটাই। একসাথে থাকার। আর ওই ধোঁয়া ধোঁয়া সন্ধ্যে নামার শব্দ কে কান পেতে শোনার। 😊
আজকের সন্ধের আজান এর শব্দ হটাৎ সেই কত্তদিন আগের সেই মেঠো রাস্তা, আর আমার প্রথম কাশফুল দেখতে পাওয়ার স্মৃতিকে উস্কে দিয়ে গেল।
চড়াই উৎরাই ভরা কেমন আমাদের জীবন। প্রতিদিন কত নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম, নতুন শিক্ষা, নতুন প্রাপ্তি, সুখের প্রাপ্তি, দুঃখের প্রাপ্তি সে যাই হোক প্রাপ্তি তো বটেই। কত বোধ, কত ব্যাপ্তি, কত নতুন নতুন অভ্যেস, কত অভ্যেস আমরা সেই ছোট থেকে বয়ে বেড়াই আবার কত অভ্যেস কয়েকদিনের মধ্যেই কেমন যেন মিশে যায় আমাদের সাথে। নিজের অজান্তেই কখন তা আমাদের বিশ্বাসের জায়গাটা দখল করে বসে। যত সমস্যাও তো ছাই মন কে নিয়েই। মনখারাপ হলে মনে হয় দৌড়ে যাই, আমার জায়গা, উজাড় করে কাঁদি ই না হয়। মনভালো হলে ও তাই মনে হয়। দৌড়ে যাই।
দিনশেষের আজান এর ওই উদাস শব্দ যেন হটাৎ আমায় এক ডাক দিয়ে গেল, নারে মেয়ে, তোর নিজের পাওনা সেটা তুই ই বুঝিস। তার ভাগ সবাই পেতে পারে নাকি? সে যে তোর ই শুধু , একার।
শীত এর সন্ধ্যে। কেমন ঝুপ করে অনেকটা অন্ধকার হয়ে যায়। আজ কতগুলো বছর হয়ে গেছে , সেই মানুষটাকে দেখিনি, সামনে থেকে। সেই যে একজন যার মান্তুর এতটুকু মনখারাপ ও তার অগোচর থাকতোনা, সামনে এসে মাথায় হাত দিয়ে বলত মনখারাপ করতে নেই। ওই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল একরাশ অভিমান কে শান্ত করে দেবার জন্যে। সেই মানুষটা জানতো, তার মেয়ের হটাৎ আসা মনখারাপ আবার হটাৎ সরে যেতে খুব কষ্ট করতে হয়না। আর সেই মনখারাপের ও সবসময় যে অনেক বিশেষ কারণ থাকে তাও নয়। মেনি বেড়ালটাকে অনেক্ষন না দেখতে পাওয়া বা যে ফুল টা ফুটতই তার হটাৎ ঝরে যাওয়া বা প্রিয় ফুলটাকে গাছ থেকে কারোর তুলে নেওয়াই যথেষ্ট কারণ হতে পারে, সেই মনখারাপের জন্যে। মা বলতো আহ্লাদী, এতো আদর দিওনা, পরে কষ্ট পাবে। আর বাবা বলতো কষ্ট পেলে ওর কাছে চাবিকাঠি আছে নিজেকে সামলে নেবার। মা বলতো, কষ্ট পেলেতো কাউকে মুখ ফুটে বলতেও পারেনা কোনোদিন, এক তাকে যে আদর দিয়ে বন্দর করছে সেই বাবা ছাড়া। আর বাবা বলতো, যদি কোনোদিন কাউকে ও নিজে থেকে নিজের মনখারাপের কথা বলে, জানবে সে ধন্য। মা রাগ করতো।
কতদিন আগেকার সেই সব কথা। সব বাবারাই হয়তো তাদের মেয়েদের এইভাবে বড় করে। সব বাবারাই হয়তো মনে করে তার মেয়েই সবথেকে সেরা। তবে জানিনা সব বাবারাই কি তাদের মেয়েদের মধ্যে মনখারাপ সামলে নিয়ে আবার হাসিমুখে বাঁচার ক্ষমতা দিতে পারে কিনা। ওই মানুষটা পেরেছে।
No comments:
Post a Comment