Wednesday, 22 May 2019

জন্মান্তর

সেদিন, হটাৎ ছেলেটি মেয়েটিকে বললে,
এই আমাকে তুই বলে ডাকবি? ডাকনা।...
মেয়েটি অবাক।....যাহ , তুমি করে ডাকতে ডাকতে হটাৎ আবার তুই বলা যায় নাকি,
ছেলেটি জেদ করলে একবার বলার জন্যে।..
কেন এমন অদ্ভুত আবদার।
অবাক হলো মেয়েটি
পরে বুঝেছিলো, খুঁজে পেয়েছিলাম মাতৃ ছায়া আকাঙ্খিত এক অবুঝ বালক কে
যে বারবার তার পরম কাছের জায়গা থেকে খুঁজে পেতে চেয়েছে মা এর মমত্ব
সহোদরা, বন্ধু, সখী , প্রেমিকা, স্ত্রী। .....বয়সের সাথে সাথে অজস্রের সম্পর্কের ভিড়ে , অনেক দায়িত্বের আবডালে কেউ আর আলাদা করে মনে করেনি বা করায় ও নি, যে তার ও চাই একটা মাতৃক্রোড়ের মতোন ভরসাস্থল
এক নিশ্চিন্তে বাহুডোর
এক অনন্ত আশ্রয়।
মৈথুন রত ক্লান্ত শরীর কি শুধুই শরীর হাতড়ে চলে,
তার মধ্যে কি শুধুই থাকে ভোগের ইচ্ছা, চেতনাহীন, বোধহীন অনন্ত সম্ভোগ?
শুধুই ?
আমি যদি বলি, স্নেহহীন , মমত্ব হীন মৈথুন ধর্ষণ এর ই সমান।....
ধর্ষিত কি শুধু নারী ই হয়,
পুরুষ নয়.........
সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীর যখন চেয়েছে সঙ্গিনীর নরম বক্ষস্থলের উষ্ণ আদোরে গলে পড়তে,
তখন হয়তো তাকে মেটাতে হয়েছে সঙ্গিনীর ই রতি লিপ্সা
তার সন্তুষ্টি আর তৃপ্তির সঙ্গে মিশে যেতে যেতে কখন ভুলে গেছে নিজেরও কিছু চাওয়ার ছিল
বীর্য্যস্খলন এর যন্ত্রণা নয়, তার সুখ শরীরের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইয়ে দেওয়ার, বইয়ে নেওয়ার গভীর অভীপ্সা।
সমঝোতার মধ্যস্থতা নয়, দুটো মনের সঠিক বোঝাপড়ার পরে এক হয়ে মিশে যাওয়া।
শুধুই স্বামীত্বের কর্তব্য নয়, স্বামী হয়ে উঠতে পারার পরম প্রাপ্তি কে আপন স্বত্বার প্রতিটা বিন্দুতে অনুভবের ইচ্ছা।
আত্মগ্লানির মধ্যে জেগে ওঠা নয়,
নতুন ভোরের স্নিগ্ধতার মধ্যে, সলাজ মধুর স্মৃতির রোমন্থনের মধ্যে দিয়ে, নতুন ভোরের পবিত্রতার মধ্যে দিয়ে, নতুন করে মাতৃ ক্রোড়ের মতোই নিশ্চিন্ত তার সঙ্গে ঘুম ভাঙা।..আর দিনের আলোর মতো চেতনা বোধ মায়ায় এগিয়ে চলা।
অবাক হচ্ছেন, ভাবছেন মৈথুন কিভাবে মাতৃপ্রেম এর সাথে তুলনীয় হয়?
হয়....প্রেম মনের এক প্রকাশ, যা সম্পর্কের পরিবর্তনে তার রূপ বদলায় মাত্র, আর আমাদের অন্তরের অন্তস্থলে বয়ে চলে সেই প্রেম এর অবিনশ্বর ধারা।...
যেহেতু মা বাবা হচ্ছেন সবথেকে বিশ্বস্ত জায়গা
তাই....
পুরুষ তার সঙ্গিনীর থেকে খুঁজে চলে সেই নিশ্চিন্ততার জায়গা
নারী তার সঙ্গীর কাছ থেকে খুঁজে চলে সেই ভরসাস্থল
আর যখন এই দুই চাওয়া সম্পূর্ণ হয়, তখন হয় প্রকৃত মিলন
কখনো নারী সেই পর্বত সমান বক্ষস্থলে চায় ছোট্ট চড়াই পাখিটি হয়ে থাকতে
আবার কখনো বা নিজ বক্ষের নরমে আগলে রাখে সেই পর্বত এর ই শিশু সুলভ সত্তা।
সমুদ্র মন্থন এর পরে, আকণ্ঠ গরল পান করে শিব যখন হলেন নীলকণ্ঠ
তখন স্বয়ং পার্বতী তাঁকে আপন স্তন্যের সুধা পান করিয়ে সেই গরল কে অমৃত রূপ দান করলেন।
মহাকাল তখন এক শিশুর মতন মাতৃরূপী পার্বতীর কাছে নিজেকে করলেন সমর্পন।
আর পরম যত্নে, মমতায় পার্বতী আপন সন্তান স্নেহে শিশু ভোলানাথের মুখে দিলেন নিজ স্তন।
কি অপূর্ব, কি অসাধারণ সেই সৃষ্টি।
প্রেম ও প্রকৃতি যদি একাত্ম হয় রচনা হয় যুগান্তকারী সৃষ্টির
নারী পুরুষ তখন উন্নীত হয় শুধুই নারী পুরুষের সাধারণ সম্পর্কের থেকে অনেক ওপরে।

আর এইভাবেই আমাদের নিজেদের অজান্তেই , অজ্ঞানে, হয়তো ফল্গুধারার মতো নারীমনে বয়ে চলেছে, তার পাশের মানুষটিকে যত্নে স্নেহে সমস্ত সংসার গরল থেকে রক্ষা করার বাসনা।....যা তাদের শুধুই  প্রেমিকা, শুধুই স্ত্রী, শুধুই সখার জায়গা থেকে নিয়ে যায় আরো ওপরে।
আর পুরুষ, সমাজ সংসার এ সকল দায়িত্ব , কঠোর কর্তব্যের পরেও মনের গভীরে থাকে এক মা এর খোঁজ, নিজের অজ্ঞানে, অচেতনে
কোথাও হটাৎ যদি সেই স্নেহ ময় মাতৃ রূপ এর সাথে এতটুকু মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তখন মন বলে ওঠে এই খুঁজছিলাম,
কিন্তু কজন নারী একাধারে বান্ধবী, প্রেমিকা,  থেকে সহধর্মিনী হয়ে উঠতে পারে ?
মাতৃরূপে আপন মমতায় পাশের পুরুষটিকে রাখে আগলে ?
আর কজন পুরুষ ই বন্ধু, প্রেমিক, সখা থেকে সত্যি স্বামী হয়ে উঠতে পারে?
বা স্বামীত্বের অধিকার বোধ পেরিয়ে পিতৃত্বের সুরক্ষার আবডালে রাখতে পারে পাশের নারীটিকে
হোকনা নাহয় জন্মাতর এবার ,
নবজন্ম পাক সংসার প্রেম
নব চেতনায় উন্মীলিত প্রেম বোধ তব
ফিরিয়ে আনুক মোরে নব নব রূপে
দিক ফিরিয়ে তোমারে
এ সংসার সাগরে।
বারেবারে।

Thursday, 9 May 2019

আমার পঁচিশে বৈশাখ- tribute to Rabindranath

আজ পঁচিশে বৈশাখ। আমার পঁচিশে বৈশাখ বলতেই চোখ বন্ধ করে একটাই স্মৃতি খুব উজ্জ্বল ভাবে ভেসে ওঠে মনে। সেটা হলো আমার মেজদিদার বাড়ি। দোতলার দক্ষিণের ঘরের টেবিল এর ওপরে বড় একটা কবিগুরুর ছবি। দুপাশে পেতলের ফুলকারী কাটা ফুলদানীতে পুকুর পাড়ের কৃষ্ণচূড়া গাছের থেকে আনা লাল টকটকে উদ্ধত কৃষ্ণচূড়ার গুচ্ছ। মাসি ধুপ জ্বালাতে জ্বালাতে বলছে নমো করো। একটা জিনিস ওই তিন চার বছর বয়সে আমি কিছুতেই বুঝতে পারতামনা। রবি ঠাকুর কি ঠাকুর? তাহলে ওপরের ঠাকুর ঘরে না থেকে বই এর টেবিল এ কেন ? খুব বড় প্রশ্ন ছিল এটা আমার মনে। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম বাবা বললো ঠাকুর তো সবজায়গাতেই থাকে, এখানেও আছে ওখানেও আছে। ঠিক সন্তুষ্ট না হলেও শিশুমন এটুকু  বুঝেছিলো যে ঠাকুর ঘরে থাকা ঠাকুরদের মতন এই ঠাকুর একদম ধরা ছোয়াঁর বাইরে বুঝি নয়, প্রতিদিনের পাঠ্যের মধ্যে এঁকে পাওয়া যায়, নিজের বই এর বনে থাকে বাঘ গাছে থাকে পাখি যে বলেছে সেই আবার দিদির বই এর আঁধার হলো মাদার গাছের তলার কথাও বলেছে, গরমের সন্ধেতে বা চাঁদনী রাতে মায়ের গলার গানে যেমন আছে আবার মামার সেতারেও তার সুর বাজে । গরম কালের সন্ধেতে চাঁদের আলোতে ভেসে যাওয়া ছাদে মাদুর পেতে বসে মা যখন গান গাইতো, কিংবা দুপুর বেলা শুয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে 'লুকোচুরি' শোনাতো, তখন মা এর দুপাশে আমরা দুবোনে শুয়ে সত্যি সত্যি চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফোটার কথা ভাবতাম, অথবা মা যখন বলতো 'যখন যেমন মনে করি তাই হতে পাই যদি '..আর আমার মন ও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠতো, আমি যেন এখুনি হৈ ইছামতি নদী। তারপরে বড় হওয়ার সাথে সাথে আলাদা করে আর বিষ্ময় নিয়ে রবি ঠাকুরকে ভাবতামনা, রবি ঠাকুর তখন পড়াশুনা ইত্যাদির মধ্যে হটাৎ করে রবীন্দ্রনাথ হয়ে গিয়ে পাঠ্য পুস্তক আর পঁচিশে বৈশাখ এর অনুষ্ঠানের মধ্যে আটকে গেলেন। কিন্তু ফিরে পেলাম তাকে আবার, খুব অভিনব ভাবে। কৈশোর পেরিয়ে যৌবন আসবো এসব করছে, আবার কৈশোর ও যাবো কি যাবোনা ভেবে থমকে দাঁড়িয়ে আছে, এমন একটা সময়, যখন আমাদের পাড়ার পল্লীশ্রী পাঠাগারের ছোটদের বিভাগের পাণ্ডব গোয়েন্দা, এমনকি ফেলুদা, কাকাবাবুতেও ঠিক মন টাকে বেঁধে রাখতে পারছেনা, প্রায়শই উশখুশ করছে পাশের বিভাগের বইগুলোর দিকে, বাড়িতেও বড় দের মার্ক করে রাখা বই গুলোর দিকে প্রায় ই হাত বাড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে। এমন সময় এক গোছা গোলাপের গন্ধের সাথে হাতে এসে পড়লো বুদ্ধদেব গুহর বাবলির। বুঝতেই পারছেন সবাই, কৈশোরের প্রথম প্রেম নিবেদন হাতে এসে পৌঁছেছিল আর কি। সে গোলাপের রং টকটকে লাল ছিলোনা, ছিল নেহাৎ ই অপটু হাতের কারোর বাগান থেকে ছিঁড়ে আনা একগোছা গোলাপি প্রকাশ। কিন্তু নিষেধের বেড়া জালের মধ্যে সেটুকু হটাৎ প্রচন্ড উত্তেজনায় কিশোরী মনকে রোমাঞ্চকতায় ভরে দিতে যথেষ্ট ছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। সেই প্রথম বড়দের বই। পড়ার পরে আবার ফেরত দিতে হবে। কি আছে ওই বইতে? কেন আমাকে পড়তে দিলো? উত্তেজনায় আর তর্ সইছিলোনা, পড়ার বইয়ের নিচে লুকিয়ে পড়তে শুরু করে দিলাম। অভিরূপ আর বাবলি সবে হাতে হাত দিয়ে বেড়াতে বেরোচ্ছে এমন সময় পিছন থেকে মা এর চিৎকার, কে দিলো এই বইটা? কোথা থেকে পেলি এ বই তুই? এ বই পড়ার মতন তো তোমার বয়স হয়নি। ওগো দেখে যাও তোমার আদুরে মেয়ের কান্ড, আদোরে আদোরে তো বাঁদর করেছো , এবার বোঝো। ..ইত্যাদি ইত্যাদি, বাস্তবিক ই আমি সত্যি ই সেদিন তখন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি যে বই তো ভালো জিনিস, সেটা আমাকে একজন দিয়েছে আর আমি নিয়েছি, এতে দোষের কি হয়েছে। আমার কথাও যে সেদিন আমার জননী শোনেননি সেটিও বলাই বাহুল্য। প্রচন্ড বকা ঝকা যথারীতি আমি চোখের জলে বালিশ ভাসাচ্ছি এমন সময় কানে এলো পাশের ঘর থেকে আমার বাবা আর আমার এক মামা সেদিন এসেছিলেন, দুজনের কথোপকথন। বাবা একটু চিন্তিত গলাতে মামাকে বলছিলো, বুঝলি বাবুন ছেলে মেয়েরা যতক্ষণ না সব বুঝতে শিখছে ততক্ষন যে কি চিন্তা, আমি মরমে মরে যেতে যেতে শুনতে পেলাম আমার মামা খুব হালকা ছলে বাবাকে বলছে এতো ভাববেননাতো রঞ্জিতদা, এবারে মান্তুর হাতে রবীন্দ্রনাথ তুলে দিন, এখন ওর রবীন্দনাথ পড়ার বয়স , দেখবেন ওই যে কোনটা পড়বো আর কোনটা পড়বোনা, কোনটা বুঝবো আর কোনটা বুঝবোনা, কতটা নেবো আর কতটা নেবোনা সেই সব ভাবনা কেমন এক দিকে channelise হয়ে যাবে। মায়ের অভিযোগ অনুযোগ মেয়ের কান্না এইসবে জর্জরিত অসহায় ভালো মানুষ আমার বাবার গলায় বেশ একটা উৎসাহ এসে গেল হটাৎ। বললো ঠিক বলেছিস, বঙ্কিম কেও এখন ই দিতে হবে। অর্থাৎ কিনা অমৃত রসে আগে সম্পৃক্ত করে দেওয়া হোক অপরিণত মনটাকে, তারপরে, পরিণতির সাথে সাথে যে রকম ই এক্সপোজার ই পাকনা কেন, যে রসে মজে আছে মন , সেই রসে সিক্ত মন নিজেই বিচার করে নিতে পারবে, কোন রসে, কিভাবে কতটা মজবে। পরে বুঝেছি কি অসাধারণ স্ট্রাটেজি। কি অভিনব উপায়ে আমার বড় হওয়ার সাথে সাথে এক একটা মাইলস্টোন দিয়ে আমার ভাবনা চিন্তা গুলোকে একটা লক্ষ্য দিয়ে দিয়েছিলেন আমার চারপাশের এই মানুষগুলো।যাতে অস্থির হয়ে দিকভ্রান্ত না হয়ে সবকিছুকে খোলা মনে বুঝে বিবেচনার সাথে গ্রহণ করতে পারি। সেই প্রথম পাশের ঘরের সেই কথোপকথনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে আমার অন্যভাবে পাওয়া, বা তাঁর কাছে আমার সমর্পন। গীতবিতান এর গান গুলোর সব ই নতুন ভাবে নতুন বোধ নিয়ে আমার কাছে উঠে এলো তা নয়, কিন্তু বঙ্কিমের গড় মান্দারনের সেই রহস্য মাধুর্য্য এর রস রাজ্য এর অপার অকৃত্রিম মধুরতা, সঞ্চয়িতার পাতার পর পাতা বিষ্ময়ের সাথে মিশে গিয়ে আমাকে রুশ উপন্যাস থেকে বুদ্ধদেব, শরৎ, শীর্ষেন্দু, সুনীল, দুলেন্দ্র সবাইকেই অন্তঃস্থ করতে সাহায্য করেছে।

এরপরে জীবনের সমস্ত ধাপে পদে পদে কখন কিভাবে যেন ওই বুড়ো লোকটা জুড়ে গ্যাছে।  শুধুমাত্র কাব্য করার জন্যে বলছিনা, বিশ্বের কাছে নিজেকে রবীন্দ্রপ্রেমী বলে প্রমান করার জন্যে নয়, একদম বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, নিজের সবথেকে কাছের সবথেকে প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে বারবার যখন গীতার মধ্যে শান্তি খোঁজার চেষ্টা করছি, তখন একদিন এমনিই কানে এলো আছে মৃত্যু, আছে দুঃখ, বিরহদহন লাগে। ..এর আগে কত বার শুনেছি ওই সুর, কিন্তু সেদিনের মতন ঐভাবে কোনোদিন যেন অন্তস্থ করতে পারিনি। সেদিন আরাবল্লী পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট সবুজ উপত্যাকাটার গেস্টহাউসে বসে মনে আছে মা বলেছিলো আচ্ছা এই গানগুলো কি আমাদের জন্যেই লেখা। আমরা মা মেয়ে সেদিন ওই সুর গুলোর মধ্যেই ধীরে ধীরে নিজেদের আস্তে আস্তে ফায়ার পেয়েছিলাম। যে অস্থিরতা আমাদের পারিপার্শিক কোনো কাজে মন বসাতে দিচ্ছিলনা, ধীরে ধীরে ওই সুরের প্রলেপ আবার আমাদের নিজ নিজ কর্মযজ্ঞে ফিরে যেতে সাহায্য করলো। তারপর দিন কেটেছে, কত ঘটনা, ঘটনাবলী, কত মানুষ , অভিজ্ঞতা আমাকে আমার বোধকে উন্নীত করে দিয়ে গেছে। কখনো আনন্দে মন উদ্বেল হয়ে গেয়ে উঠেছে, মম চিত্তে নীতি নৃত্যে,....আবার কখনো বা পারিপার্শিক আঘাত, অভিমান, প্রতিকূলতা আমাকে নিয়ে গেছে ছাদের কোণে , নিভৃতে গীতবিতান হাতে ফিরে পেয়েছি নিজেকে। দুজন মানুষ পাশাপাশি ই থাকুক বা থাকুক যোজন মাইল দূরে, মুখ যেখানে মৌন হয়ে, মন চায় মুখর হতে, সেখানে এই মানুষটার লেখনীর মাধ্যম ই অব্যক্ত বক্তব্য কে কতবার পৌঁছে দিয়েছে। মনের আবেগ তার আপন গভীরতায় যখন ভাষা হারিয়েছে, তখন বহুবার সেই অমিতর মতন কত লোককে বলতে হয়েছে, "বাণী দাও, বাণী দাও"...আমিও বলেছি, আশ্রয় নিয়েছি ওই লোকটার লেখনীতে। তাকে সেতু করে কখনো হয়েছে প্রেয়সীর সাথে চারিচক্ষুতে চাওয়ার ইচ্ছে। কখনো "সজনি সজনি রাধিকা লো
দেখ অবহুঁ চাহিয়া, পিনহ ঝটিত কুসুমহার, পিনহ নীল আঙিয়া। সুন্দরী সিন্দূর দেকে সীঁথি করহ রাঙিয়া।" শুনে লক্ষ দামামার শব্দ বেজে উঠেছে বুকে। কত "তৃষিতনয়ন ভানুসিংহ" হয়তো এখনো সত্যি ই কুঁচ্যপথে চেয়ে বসে আছে তার প্রেয়সী কখন জুঁই বেলি মল্লিকার ডালি সাজিয়ে আসবে তার জন্যে। কত প্রেমিক মন হয়তো আজকের দিনে বসেও বুনে চলে অজানা ভবিষ্যতের দিনে শান্তিনিকেতনের কোপাইকে সাক্ষী রেখে শান্তির নীড় রচনার স্বপ্নজাল। আর এই দাড়িওলা বুড়ো লোকটা যেন সেই প্রেমিক মন এর যুগলবন্ধীর মধ্যে সেতুবন্ধন করে কখনো খুঁজে দেয় আমাদের মধ্যের টগবগিয়ে ঘোড়ায় চড়া বীরপুরুষ বা গোড়ার উজ্জ্বল চরিত্র, কখনো বা সে অমিত এর মতো সৌখিনতার মোড়কে খুঁজে চলে কোনো লাবণ্যের সুনন্দিত রুচিশীল স্পর্শ অথবা যোগমায়ার মতন স্নেহময়ী মায়ের একটু ছোঁয়া।  
এখনও যখন কোনো ক্যানোর কোনো উত্তর পাওয়া যায়না, তখন মনে মনে আবৃত্তি করি "কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও, তার রাত নিত্যই উধাও/ জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন/ চক্র পিষ্টে আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন/ ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল জড়ায়ে ধৰিলো মোরে ফেরি তার জাল --"....এইভাবে রোগে, শোকে, দুঃখে, আনন্দে, প্রেমে, বিরহে কখন যেন কিভাবে সবকিছুর মধ্যে ওই সৃষ্টির মধ্যে আবর্তিত হতে থেকেছে আমাদের মন। শান্তি পেয়েছে তাতেই, আশ্রয় পেয়েছে তাতেই। অনন্য আনন্দে মন উঠেছে ভোরে, মনে হয়েছে "আনন্দধারা বহিছে ভুবনে" , কি ব্যাপ্তি, কি শান্তি আর কি অসাধারন বার্তা এর ছত্রে ছত্রে  যখন শুনি "বসিয়া আছ কেন আপন-মনে, স্বার্থ নিমগন কী কারণে।
চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারি, ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি।
প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে।" সত্যি ই যেন এক পুণ্য ইচ্ছা এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বোধিপ্রাপ্ত হই।   আর এমন করেই বহুবার বহুকারণে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি তে , নিজের ই দায়ে থমকে দাঁড়িয়েছি ওই অসীম সৃষ্টির সামনে, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেছে বারবার। রবীন্দ্রনাথ হয়তো আমার প্রতিদিনের দৈনন্দিন জীবনের সাথে এক এবং অদ্বিতীয় ভাবে সচেতন ভাবে জড়িয়ে নেই, কিন্তু যখন চারপাশের অসহিষ্ণুতা, অপ্রীতিকর ঘটনা, অশালীনতা, চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অপ সংস্কৃতীর হাত থেকে আমাদের বাঁচতে হয়, তখন ওই বিরাট মঙ্গলময় সৃষ্টি জলে স্নান করে নিজেকে স্নিগ্ধ করার জন্যে বারবার তাঁর কাছে ফিরে যেতে হয়। তাই বারবার হয়তো নিজের আমিত্ব কে রক্ষার জন্যেই, নিজের স্বার্থেই বারংবার তার কাছে ফিরে যাই, আর বলি "হে নুতন দেখা দিক আর বার জন্মের ও প্রথম ও শুভক্ষণ " যে মহাজন্ম আমাদের বিশ্বসংসার কে আলোড়িত করে তুলেছে, আমাদের প্রতিদিনের বোধ কে উন্নীত করেছে এক অমোঘ শুভ কামনা দিয়ে, আমাদের মানব জন্ম কে সার্থক করার এমন ইঙ্গিত, এমন মঙ্গল ময় শান্তির বার্তা যে দিয়ে গেছে , সে মহা আবির্ভাব ফিরে আসুক বারংবার। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সমস্ত অসুন্দরকে সুন্দর দিয়ে ভরিয়ে তুলি। নাহয় কল্পনার তুলিতে প্রকৃতির রঙে ডুবিয়ে তাকে জীবনের রূপ রস লাবণ্যে ভরিয়ে তোলার জন্যেই থাকো, কিন্তু থাকো আমাদের মর্মে, মননে , জ্ঞানে, অজ্ঞানে , সত্যি আর স্বপ্নে। 






ইচ্ছেনদী

আমার ল্যাব টা মাউন্ট sinai এর ১০ তলায়, আর আমার ওয়ার্কিং ডেস্কটা একদম জানালার ধারে , বিশাল জানালা। মনে হয় মেঘ গুলো এখুনি ঢুকে পড়বে এর মধ্যে। ...