Sunday, 5 October 2025

পুজোর উপহার

দেখতে দেখতে পুজোর চারটে দিন কেটে গেলো।পুজোর এই চারটে দিন কেন প্রায় আগে পিছে করে মাসখানেক বেশ বিপজ্জনক। হিংসুটে আমি মাঝেমাঝেই কাজ ফেলে facebook  খুলে দেখি চারিদিকের আলো ঝলমলে ছবি—নতুন শাড়ি, নতুন জামা, ঠাকুরের সামনে ভিড়, মুখে হাসি, হাতে কচুরি, টেবিল এ কষা মাংস।

 আমি আবার বরাবর ই শাড়ীর পিয়াসী। শাড়ী দেখেই আমারও শাড়ী প্রেমী মন উৎসাহিত হয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা শাড়ীর বাক্স খুলে ঘাঁটতে শুরু করে। তারপর , এখানে অতীব খারাপ শাড়ী পাওয়া যায় জেনেও স্ক্রল করে করে শাড়ী পছন্দ করে কার্ট ভর্তি করা এবং তারপরে এক এক করে সব ই অপছন্দের তালিকায় ফেলে দিয়ে শেষে বেশ সুদৃশ্য blouse কিনে ফেলা এসব চলতেই থাকে। এমন সময় পুজো এসে যায়। পৃথিবীর এই প্রান্তে পুজো হৈ হৈ করে আসেনা, আসে বেশ নিঃশব্দে, পায়ে পায়ে। তবু তো সে আসে। এই আসা নিয়ে কতদিনের কত জল্পনা। এবারে আবার নতুন এক সদস্য—তাকে মা দুর্গার সঙ্গে আলাপ করাতে হবে। তার পুজোর সাজ রেডি তাই সবথেকে আগে। 

এখন যেকোনো পুজো বা অনুষ্ঠান মানেই এই ছোট্ট মানুষগুলোর মহা দুর্ভোগ। বাড়ির বড়রা এদের সাজাতে সাজাতে একেবারে নাজেহাল করে ফেলে। রথে জগন্নাথ, জন্মাষ্টমীতে গোপাল, গণেশ পুজোয় গণেশ, লক্ষ্মী পুজোয় লক্ষ্মী, সরস্বতী পুজোয় সরস্বতী—ছোটবেলা থেকে এসব সাজের বোঝা টানতে টানতে আমার তো ভয় হয়, এরা বড় হয়ে পুজোর নাম শুনলেই শত হস্ত দূরে পালাবে না তো!

আমাদের কাছে যা আনন্দের পুতুলখেলা, ওদের কাছে সেটা মাঝে মাঝে একেবারে বিপর্যয়। তবে অবশ্য সব সময় এমনটা হয় না। ছোট থেকে নিজেকে মডেল ভাবে দেখতে দেখতে অনেকেই পরে সহজেই নিজেদের খুঁজে পায় আধুনিকতার রিলে।তখন বাবু ফোন নিওনা বললে আর বাবু শোনেনা তা! 

সে যাই হোক, আমার ছোট্ট মানুষটাকে নিয়ে এমন টানাটানি না করলেও আমি কিন্তু এবারে একেবারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, বহুদিন পরে ফেইসবুক এ যখন উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছি ই  আর বেশ হিংসুটে হিংসুটে মন নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে বলছি যে কবে পুজোর সময় বাড়িতে থাকবো, আর একসঙ্গে শাড়ী গয়না পরে তোরে একদম ভীষণ রকমের বাড়াবাড়ি করবো। এমন সময়ে বাধ সাধলো দুটো জিনিস। এক ফ্লু ভ্যাকসিন এর ভয়েও পালিয়ে না যাওয়া ফ্লু আর দুই পৃথিবীর এই সবচাইতে হ্যাপেনিং জায়গায় থাকার ফলশ্রুতি। এই ফাঁকে বলে দি, US এর পূর্ব উপকূল এর নিউ ইয়র্ক ও পশ্চিম উপকূলের ক্যালিফোর্নিয়া ছাড়া US এর বাকি সমস্ত জায়গা,  সমগ্র কানাডা এসব কিছুটা কলকাতার সামনে মফস্বল ও গ্রাম গঞ্জের মতন। আর সে জায়গা যদি হয় নিউ ইয়র্ক এর অন্যতম শহর ম্যানহাটান তো কথাই নেই। এই পুজোর সময়ে অন্যান্য জায়গায় উইকেন্ড এ বাঙালিরা এক সঙ্গে জোট বেঁধে আমাদের ওখানকার পাড়ার মতন ই পুজো করলেও , এই শহর এ বাঙালি ও যেমন বেশি, পুজো ও তেমন , অজস্র পুজোর সবাই ই মোটামুটি ভারত বর্ষের আসল সময় সুচির সঙ্গে তাল মিলিয়েই হয়, সেখানেই মানুষ কাজের পরে দৌড়ে যায়, ঠাকুরের কাছে দু দণ্ড দাঁড়িয়ে আবার পরের দিনের কাজের প্রস্তুতি। নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পূজো, লোপামুদ্রা থেকে রূপঙ্কর ,ভোগ খাওয়া,—সবই হয় এখানে, কিন্তু সেগুলো মিশে যায় রোজকার কাজকর্মের ভিড়ে। তাতে অ্যালবাম ভরলেও মন ভরেনা। মন পরে থাকে আমার চিরকালীন সাবেকি চন্ডী মণ্ডপে। যেখানে উমা সপরিবারে বাপের বাড়ি আসে, আবার ফিরে যাবার সময় ঠিক ঘরের মেয়ের মতন ই মা তাঁর মুখে আদর করে অশ্রু সজল চোখে কানেকানে বলেন, আবার আসিস মা। সেইখানে। তবুও পূজো তো পূজোই। সারাবছরের অপেক্ষা যেটুকু সময়ের জন্যে, তাকে যেভাবেই পাওয়া যাক না কেন সেটুকুকেই আষ্টেপৃষ্ঠে নেবার জন্যে প্রস্তুতি চলছিল মন জুড়ে।

মাঝপথে বাধ সাধলো মা-ছেলের অসুস্থতা। ঘরে শুয়ে থাকলে এখানে না শোনা যায় ঢাকের আওয়াজ, না শোনা যায় মাইকে মন্ত্রোচ্চারণ। অথচ আশ্বিনের আকাশ আর পেঁজা তুলো মেঘ - মুখর —আজ পূজো। মনেই ভেসে উঠল ঢাকের তালে তালে ধুনোর গন্ধ, মন্ত্রের সুর আর ঘামতেলে ঝলমলে ঠাকুরের মুখ।কিন্তু তখনো জানতামনা ওপরে বসে বসে অলক্ষ্যে কেউ মুচকি হাসছে , আর এক বড় উপহার অপেক্ষা করে আছে আমার সমস্ত আক্ষেপ মুছে দেবার জন্যে। সে উপহার পেলাম এই ছোট্ট মানুষটার নিষ্পাপ দৃষ্টিতে, যখন সে চুপ করে বসে মা দুগ্গার দুষ্টু লোক কে শাস্তি দেবার গল্প শুনলো। শাস্তি, দুষ্টু মানুষ—এই বড় বড় কথাগুলো যে এত সরলভাবে বোঝানো যায়, তা ওকে বলতে গিয়েই শিখলাম।এই ছোট্ট দেড় বছরের মানুষটা



কতটা কি  বুঝলো কে জানে, নিজে থেকে বই টেনে নিলো, অনেক্ষন ধরে ছবি দেখলো পাতা উল্টে উল্টে আর তারপরে নমঃ করলো। কানায় কানায় ভরে উঠলো আমার মন।যেকোনো গল্প শোনানো শুরু হয় বোধহয় এমন করেই ।মণ্ডপে গিয়ে দাঁড় করাতে পারিনি , ছবি তুলতে পারিনি বলে যে দুঃখ ছিল তা কখন উধাও হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। মনে মনে বললাম, ঠাকুর , আজ যা শুরু হলো তা যেন ধরে রাখতে পারি, ওর ওই নিষ্পাপ চোখ দুটোতে আমি যেন আসল পুজোকে চেনাকে পারি। যেন বোঝাতে পারি,   রীল আর ক্যামেরার ঝলকানি তে পুজো হয়না, পুজো হয় শিউলি গন্ধে , নীল আকাশের ওই সাদা মেঘের ভেলায়, আশ্বিনের মিঠে রোদে , আনন্দমেলার কাড়াকাড়িতে আর অনেক অনেক গল্পের মধ্যে। আমরা যেন গল্প তৈরি করতে পারি। 


No comments:

বাইরে ঝলমলে রোদ্দুর ভরা একটা দিন , ভীষণ নীল আকাশ। আমার বাড়ির সামনের ম্যাপল গাছের পাতা প্রায় সব ই ঝরে পড়ে গেছে। দুদিনের জন্যে এত সৌন্দর্য্য ন...