Wednesday, 31 January 2018

মেলবন্ধন

আজকে এক অন্যরকম টানে আমি ল্যাব থেকে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে রুম এ ফিরি। শুধু মনে হচ্ছিলো আজকের সূর্যাস্ত টা যেন miss না হয়ে যায় , কেন মনে হচ্ছিলো জানিনা, কিন্তু কি জানি এক অদ্ভুত মায়ায় আমাকে ল্যাব থেকে উপরে সোজা ছাদে নিয়ে গেলো। এতো তারতারি আসছিলাম যে হাঁপিয়ে গেছিলাম। কিন্তু গত কালের যে ধ্যানমগ্ন বিদায় ক্ষণের সাক্ষী হওয়ার জন্যে এতো উতলা হয়ে আসছিলাম, তাকে পেলামনা। সূর্য অস্ত হয়েছিল।

বিদায়কালে দুহাত ভরে নিজের সমস্ত আদর যেন সূর্যদেব ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পশ্চিমের আকাশে। আকাশে আজ বোধয় ছিল হালকা কিউমুলাস মেঘ। আবীর মাখা দিগন্ত জুড়ে তারা যেন মুক্তির আনন্দে ডানা মেলে উড়ে চলেছিল। পশ্চিম আকাশে যখন এই অসাধারন কর্মকান্ড চলছে পুব আকাশে তখন ধীরে ধীরে আপনার স্মিত শান্ত মুখ তুলে তাকিয়েছে চন্দ্রমা। কি অসাধারন কি অস্মভব সুন্দর সে দৃশ্য। একদিকে লালে লাল আকাশ এ অস্তমিত দিবাকর আর অপরদিকে রুপোর থালার মতো শশিরেখা, জানান দিচ্ছে মধুনিশির। ইমন আর মালকোষ যেন হটাৎ একসঙ্গে একসুরে বাঁধা পড়লো। এ কি সৌন্দর্য্য, এ কি মেলবন্ধন, এ কি অপূর্ব ভালোবাসা। এমন সৌন্দর্য্য কি শুধু একা উপভোগ করা যায়? বাতাসে যে আজ মাতন লেগেছে। আসন্ন বসন্তের খবর পাতায় পাতায় শিহরণ তুলেছে। চারিদিকের এতো মায়া , এতো মধু , এতো প্রেম এ কি শুধুই আমার একার। "যাও  মেঘদূত , দিও প্রিয়ার ও হাতে, আমার বিরহলিপি লেখা কেয়া পাতে "....--জানি আবার এক ই ভাবে সন্ধ্যা হবে, নিশি অবসানে ম্লান স্তিমিত ইন্দুকে বিদায় জানিয়ে ঝলমলিয়ে উঠবেন 'ভানু '...আবার সেই জ্যোতির্ময় ও দিবাবসানে চন্দ্রমার স্মিত হাসি দেখে নেবেন বিদায়। তবু আজকের যে ক্ষণ যে মায়া তা যে ঠিক এই মুহূর্তের জন্যেই। ...."আর কি কখনো কবে / এমন ও সন্ধ্যা হবে " -

Monday, 29 January 2018

রোদ্দুর

সেই গত সপ্তাহ থেকে শুধু মেঘ, বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা। আমার রোদ্দুর এর জন্যে বড্ডো মনকেমন  করছিল। 
আজ সকাল বেলাতে কুয়াশা থাকলেও দিন বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে সমস্ত কুয়াশা কেটে গিয়ে আকাশ ঝলমল করে উঠলো রোদ্দুর। জানলার বাইরের রোদ ঝলমল ঘন গাঢ় নীল আকাশ আর ওই সবুজের গালিচা অনেক্ষন থেকেই আমাকে উস্কাছিলো বাইরে বেরোনোর জন্যে। শেষে আর পারলামনা, মাথাটা যন্ত্রনা তে ফেটে যাচ্ছিলো। না তেমন কিছুই নয়, মাথা থাকলে ব্যাথা তো হবেই। seasonchange, কুয়াশা, ঠান্ডা লাগা, জ্বর জ্বর ভাব ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই আদুরে রোদ্দুরের জন্যে সে সব কিছু তুচ্ছ করাই যায়। রাস্তার দুধারের ঝরা পাতা যেন শীত কে বিদায় সম্ভাষণ জানাছিল। মনে পরে গেলো সেই ছোটবেলার পড়া "আমলকি বন্ কাঁপে যেন তার বুক করে দুরু দুরু / পেয়েছে খবর পাতা খসানোর সময় হয়েছে শুরু" যদিও রবি ঠাকুর এটা শরৎ কালের জন্যে লিখেছিলেন , কিন্তু আমি কি করব, আমার এটাই এখন খুব appropriate মনে হচ্ছে। সব কিছু কি আর সব সময় বাঁধা নিয়মে চলে। 

চারপাশে আজ ছিল অনেক রঙের সমারোহ। না বসন্তের মাতাল করে দেওয়া বাঁধাহীন উন্মত্ত রং নয় এ। এ যেন প্রকৃতির নীরব কান্নার পরে শান্ত সমাহিত হয়ে সূর্যাস্ত দেখা। সেখানে কোনো চাওয়া নেই, পাওয়া নেই, প্রত্যাশা নেই। কথা নেই, বার্তালাপ নেই। শুধুই যেন যাওয়া আসার মাঝে এক স্থির, শান্ত, ধ্যানমগ্ন ভাবমূর্তি। রাস্তার দুধারে পথের পরে কেমন যেন মায়াময় হয়ে ঝরেছিলো হালকা হলুদ হয়ে আসা শুখনো পাতা। দুপাশের গাছ, কোথাও কোথাও সেখানে ম্লান হয়ে আসা সবুজ আবার কোথাও বা নতুন এর আগমন এ গর্বিত কচি পাতা। আর ওই দূরে, যেখানে বৃক্ষরাজি তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে জয় করে এসেছে সব বদল, সেখানে নেই কোনো আসা যাওয়া। অনেক পরিবর্তন, আগমন বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে আজ তারা স্থির, অচঞ্চল, ধ্যানমগ্ন, নিষ্পলক। কেমন এক গাঢ় গম্ভীর গায়ের রং ওদের, যা মনের মধ্যে এক সম্ভ্রম নিয়ে আসে, মনে হয় বাবার মতো, দাদুর মতো, বড়দের মতো। সবার মাথার ওপরে দাঁড়িয়ে, সবাইকে রক্ষা করে চলেছে। বড় বেশি করে যাদের আমি রোজ খুঁজি। বড় বেশি করে যাদের অভাব আমি রোজ অনুভব করি। 

দিন যতই দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে পৌঁছতে শুরু করলো, নিজেকে ল্যাব এ আটকে রাখা আর সম্ভব হলোনা আমার। বিকেল ৫টার একটু পরেই বেরিয়ে এলাম। বাইরে বেরিয়েই যেন শিহরণ খেলে গেলো। কি এক অদ্ভুত , উন্মনা হাওয়া আমায় জানান দিয়ে গেলো বসন্ত আসছে। এই কয়েক বছরে এখানে দেখলাম যে বাংলার বাইরে হলেও বাংলার সমস্ত ঋতু গুলো অনেক বেশি সুস্পষ্ট ভাবে এখানে ধরা পরে। বসন্ত আসা, তার থাকা, চলে যাওয়া এই সমস্ত কিছু বড় মধুর ভাবে এখানে আমাদের জানান দেয়। এক ভীষণ অন্যরকম, গ্রীষ্মের ছোঁয়া লাগানো অথচ শিরশিরানি শীত শীত অনুভব যেন আমার সমস্ত মন টাকে একেবারে জড়িয়ে ধরে রাখলো। ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি পর্দা সরিয়ে দিতেই পড়ন্ত বিকেলের একরাশ আদর আমার বিছানার ওপর উছলে উঠলো। অপূর্ব এক মাদকতা তখন সমস্ত ঘর জুড়ে। ব্যালকনির ঠিক নিচ দিয়ে উড়ে গেলো দুটো ময়ূর। ও হ্যাঁ , আজ তো আমি নীলগাই ও দেখেছি দুপুরে হাঁটার সময়। আবার দেখলাম। দূরের জঙ্গল টা দিয়ে দল বেঁধে কোথায় গেলো , ঘরে ফিরলো কি? কি জানি, তাই বোধহয় হবে। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতেই আবার সেই মনকেমন করা, বাঁধন হারা হাওয়া। দূরে সূয্যি তখন পাটে বসেছেন। ধ্যানমগ্ন পৃথিবী। সবাই যেন একদম চুপ করে, শান্ত হয়ে, স্থির হয়ে সাক্ষী হতে চলেছে পশ্চিম আকাশে ঘটে যাওয়া সেই চির পুরাতন চির নতুনের মহা কর্মযজ্ঞের। আপনা হতে হাত জড়ো হয়ে গেলো। 

                                 "ॐ असतो मा सद्गमय ।,
                                 तमसो मा ज्योतिर्गमय ।,
                                 मृत्योर्मा अमृतं गमय ।,
                               ॐ शान्तिः शान्तिः शान्तिः ॥"

      "Lead me from falsehood to truth
Lead me from darkness to light,
Lead me from death to the immortality
         ওঁম শান্তি শান্তি শান্তি "

















Sunday, 28 January 2018

কবিতার শেষ

আজ এই রবিবারের মধ্যাহ্নে , এক অভিনব নেশায় আমার মন হয়েছে আচ্ছন্ন। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার শক্তি যেন আর নেই, হয়তো ইচ্ছাও নেই।  বুঁদ হয়ে আছি সেই নেশায় আমি, কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছিনা, শিলং পাহাড়ের ওপর থেকে।..

আচ্ছা রবি ঠাকুর তো অমিত কেতকী আর লাবণ্য শোভনলাল এর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেই হলেন ক্ষান্ত, ঠিক যেমন সমস্ত সিনেমা তে প্রেম থেকে বিয়েতে পূর্ণতা লাভের মধ্যেই ঘটে "মধুরেণ সমাপয়েৎ"...তারপরে নায়ক নায়িকার জীবন নিয়ে পাঠক বা দর্শক কেউ আর মাথা ঘামায়না।..কিন্তু জানতে তো ইচ্ছে হয়...কেমন আছেন সেই মানুষগুলো।..জীবন যে কাব্য নয়...প্রতিদিনের ঘাত প্রতিঘাত এ  কিভাবে বেঁচে থাকছে সেই অনুপম প্রেম।...হটাৎ করে যদি আবার কখনো 'মিতা' আর 'বন্যা' এর দেখা হয়...কেমন হবে সেই দেখা হওয়া?...

এই পর্যন্ত পরেই সমস্ত রবীন্দ্রপ্রেমী নিশ্চই এ আমাকে রৈরৈ করে মারতে আসছেন, দুঃসাহস যে অতীব , রবীন্দ্র চরিত্রের ওপর কলম চালানো? মাপ করবেন, রবীন্দ্র চরিত্র অবিনশ্বর, তার ওপর কলম চালানো আমার স্বপ্নাতীত। .এ শুধু আমার নিজের মনের এক জিজ্ঞাসা , আমার নিজের রবীন্দ্রনাথ এর ভাঙা গড়া , সামনে থাকলে জোর দেখিয়ে বলতাম, গড়ুন তো আপনার অমিত লাবণ্য কে আবার, এখানকার মতো করে, এই দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্যে একটু বসন্তের হাওয়া বইয়ে দিয়ে জাননা। ...

শেষের কবিতা যেখানে শেষ, মনে করা যাক এ লেখা সেখান থেকে হলো শুরু।..শুধু তখনকার সময় কাল থেকে অমিত কেতকী, শোভনলাল লাবণ্য আরো সমস্ত চরিত্রকে একদম উৎপাটিত করে নিয়ে আসা হলো একদম এখানকার কঠোর বাস্তবে। বিয়ের পরে বেশ কয়েক বছর হয়েছে অতিবাহিত। যে যার জীবনে নিজের নিজের মতন করে তাঁরা হয়েছেন স্থির। সুখী রাখতে পেরেছেন পাশের মানুষ গুলোকে, না শুধু সুখী রাখাই নয়, বরং তাঁদের সুখ কে কেন্দ্রে বসিয়েই বেয়ে চলেছেন এ জীবন তরী। ১০ টা ৫ টার কর্মজীবন এবং সংসারের বিভিন্ন দরকারি অদরকারী খুঁটিনাঁটির মধ্যেও আছে এক নৈসর্গিক আনন্দ, সে আনন্দে গা ভাসাতে দেরী করেনি কেউ ই।  শোভনলাল, নাহ শোভনলাল কে বরং যুগোপযোগী করে শুভ করে দেওয়া যাক, এতো বড় নামের ভার আমার এ নগন্য লেখা হয়তো বা না সইতেও পারে। 
তা যেকথা বলছিলাম শুভ, লাবণ্যের শুভ , একজন সত্যি কারের ভালোমানুষ। একটু কাজপাগল, একটু অগোছালো, অল্পেতে রেগে যাওয়া কিন্তু একজন মানুষ হিসাবে সত্যি ই অসামান্য। শুভ, লাবণ্য কে কাছে পাবার পরে তার ওপর আপন জীবনের সমস্ত দায় দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে হয়েছিল একেবারে নিশ্চিন্ত। লাবণ্য এতটুকুও বিরক্ত হয়নি তাতে, বরং স্নেহের সঙ্গে নিজের মনের সমস্ত মাধুরী মিশিয়ে দিয়ে সে দায়িত্ব পালন করে চলেছে, এ যে তার বিবাহিত জীবনের এক পরম পাওয়া। ওই যে পাশের মানুষ টা , যে তার নিজের মনের সব কথা ঠিক গুছিয়ে বলে উঠেতে পারেনা, শুধু আশা করে লাবণ্য নিজে তার সব কিছু বুঝে নিয়ে তাকে গুছিয়ে দেবে, ওই মানুষটার প্রতি যত দিন গ্যাছে  লাবণ্য তত তার ভালোমন্দ খারাপ লাগা ভালোলাগার সাথে ওতপ্রোত ভাবে গ্যাছে জড়িয়ে। শেষে বিয়ের ৩/ ৪ বছর পরে আসে পাশের লোকেরা এমনকি শুভর মা পর্যন্ত বলতে লাগলো, ছেলেটা যে একেবারে কুঁড়ে হয়ে যাবে, ওকেও কিছু কিছু দায়িত্ব নিতে দিও।  আর সে ছেলে পরম নিশ্চিন্তে নিজের সমস্ত দায়  আর একজনের ওপর দিয়ে নিজের কাজের মধ্যে দিলো ডুব। ওর তাতেই আনন্দ। লাবণ্য সেটা জানতো। তাই ওর কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী হয়ে, সহধর্মিনী হয়ে পাশে থেকেছে, স্ত্রী র সমস্ত ইচ্ছে বা অধিকার নিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কোনোদিন ই। শুধু যখন চাঁদনী রাতে সমস্ত আকাশ বাতাস আমোদিত হয়ে চাঁদ উঠতো, তখন কখনো বা শোভনলাল এর ঘুমন্ত কপালে আলতো ঠোঁটের ছোঁয়ায়  আবার কখনো বা তার কর্মরত গালে একটু আদর ঢেলে লাবণ্য চলে যেত ছাদে। আকাশ তখন তার অকৃপণ হাতে নিজের সমস্ত মাধুরী কে অশ্রু জলের রূপে ঢেলে দিতো লাবন্যকে। সেই সুধা আকণ্ঠ পান করে সে ফিরে পেতো তার প্রাণশক্তি। আবার শুরু করতে পারতো আপন কর্মযজ্ঞ। শুভ বুঝতো, কোথাও লাবণ্য অধরা থেকে গ্যাছে তার কাছে, কিন্তু কিভাবে সেই লাবণ্য কে ধরতে পারবে, বুঝে উঠতে পারতোনা। সেই লাবণ্য কে বোধহয় শুভ ধরতেও চাইতোনা, মনে হতো ধরলেই বোধয় সব স্বপ্ন ভেঙে যাবে, তার থেকে প্রতিদিনের নানান কাজের সাথে যুক্ত যে লাবণ্য সে যেন অনেক বেশি নিজের অনেক কাছের অনেক সহজলভ্য। সেই লাবণ্য এর সান্নিধ্যেই সে পেয়েছে শান্তি। তবে অধরা কে ধরার একটা কষ্ট ও তাকে কুরে কুরে খায় মাঝে মাঝে। এ বেদনা লাবণ্যের মন কে খুব স্পর্শ করতো, বুঝে উঠতে পারতোনা, কিভাবে তা সে দূর করবে, কিন্তু এখানে যে তার কিছু করার ও ছিলোনা, নিজেকে তো সে লুকিয়ে রাখতে চায়নি তার কাছের মানুষটির কাছ থেকে, বরং অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছে, কখন সে সব বুঝবে, খুঁজে পাবে তাকে বেহালার করুন সুরে , diary এর ছেঁড়া পাতায়, কবিতার মধ্যে, গাছের পাতার মধ্যে, সবুজের স্নিগ্ধতার মধ্যে, সূর্যের কিরণের মধ্যে, দূর থেকে ভেসে আসা মন্দিরের ঘন্টার শব্দে বা বিষন্ন বিকেলের মসজিদের আজানের মধ্যে। অপেক্ষা যখন অন্তহীন এর দিকে পা বাড়ায়, লাবণ্য তখন নিজেকে ভুলে থাকার চেষ্টা করে। আর বারবার তার ভালোলাগার ঝাঁপি উপুড় করে দিয়ে শুভর কাছে প্রমাণ করে তার ভালো থাকার কথা। আর এভাবেই চলে দুজনের যৌথ সংসার। ভালোবাসা, বিশ্বাস, ভরসা, নির্ভরতা কোনো কিছুর ই অভাব সেখানে ছিলোনা, নেই ও। একটা সম্পর্ক অটূট বাঁধনে বেঁধে রাখতে গেলে যা যা দরকার সব কিছুই আছে , ছিল, থাকবেও। শুধু দুজনের মধ্যের একজন মানুষের মনের একটা অংশ কে প্রতিদিন যেন নিশ্বব্দে দিতে হচ্ছিলো প্রাণ। কিন্তু এ সত্যি এমনকিছুই নয়, যেখানে অনেক মানুষের কাছে বেঁচে থাকাটাই হচ্ছে এক সংগ্রাম, সেখানে এতটুকু কষ্টের ভার কি সত্যি ই খুব বেশি? না সত্যি ই এভার অসহনীয় নয়। একথা লাবণ্য ভীষণ ভাবে স্বীকার করতো এবং এই সত্যি কে সে মন থেকে মেনে চলতো। জীবন চলতে থাকে। ... হয়তো সবসময় জীবনের তাগিদে নয়, কখনো কখনো তা চলতে থাকে জীবিকার তাগিদে। কিন্তু চলে। ...

এমন সময় হটাৎ ই একদিন লাবণ্য খুঁজে পায় তার অমিত কে। না, পাবে বলে কোনোদিন সে ভাবেওনি, চায়েওনি। অমিত যে এভাবে লুকিয়ে ছিল, এভাবে যে কখনো সামনে আসতে পারে, একথা সে জেনে হয়েছে ততোধিক বিস্মিত। অমিত ছিল লাবণ্যের অনেক কাছেই, হাত বাড়ালেই হয়তো ছোঁয়া যেত, কিন্তু হাত বাড়ানো তো দূরের কথা কখনো ফিরে ও তাকানোর অবসর হয়নি লাবণ্যের সেদিকে। একালের অমিত, একালের লাবণ্যের দৃষ্টি সম্মুক্ষে থেকেও ছিল চিরকাল দৃষ্টির অগোচরে। না পেরেছে অমিত তাকে দেখতে, না পেয়েছে লাবণ্য তাকে দেখতে। এমন সময় সৃষ্টিকর্তার কি এক অলীক খেয়ালে, অদৃশ্য জাদুকাঠিতে, দুটি নিষ্পাপ শিশু চোখের বেদনা র অনুভব, বন্যা কে এনে দিলো মিতার জীবনে। একেবারেই নিঃশব্দে, গোপনে। 
যে মন টাকে এতদিনের সাধনায় সযতনে লাবণ্য রেখেছিলো সকলের অগোচরে, যা ছিল তার একান্ত গোপন, কষ্টের বহু সঞ্চিত ধন , আজ কিকরে তা ধরা পরে গেলো আর একজনের কাছে। ধরা দিতে লাবণ্য চায়নি, কিন্তু শত চেষ্টাতেও তাকে আটকে রাখতে পারলো কই। কিছুদিন এর জন্যে, নীল আকাশ আরো একটু গাঢ় হয়ে নেমে এসেছিলো পৃথিবীর বুকে। চন্দ্রমা, যেন হয়েছিল আরো স্নিগ্ধ। লাবণ্য ভুলেই গেছিলো, গোপন কুঠুরিতে বন্ধ হয়ে থাকা তার সেই আর একটি মনের কথা, নিত্য দিনের নিঃশেষ দায়িত্বের মধ্যে ভেবেছিলো সে আজ বুঝি আর বেঁচে নেই। এখন বুঝলো সে বেঁচে ছিল। খোলা আকাশ দেখে ডানা ঝাপটিয়ে বেরিয়ে পড়লো। লাবণ্য আর আগের মতো তাকে শিকলে বাঁধলনা। অনেক দিন পরে বেহালার ভাঙ্গা ছর এ আবার রজোন দেওয়ার তাগিদ অনুভব করলো সে, ছিঁড়ে যাওয়া ছর কে সারানোর জন্যে মন উন্মুখ হয়ে রইলো। প্রতিদিনের ভোর হওয়া, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি নামার মধ্যে যে আনন্দ এতদিন সে আনন্দ ছিল ওর একান্ত আপনার, সে আনন্দ অন্য কারোর সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে এতো খুশি আছে, এতো সুখ আছে ? না আগে সত্যি ই কখনো বোঝেনি, যে সবুজের মধ্যে সে পা ফেলে হাঁটে, অন্য কেউ ও যদি অনেক দূর থেকে সেই সবুজের সতেজতা অনুভব করতে পারে, তার মধ্যে এতো আনন্দ আছে। ছিল ? আকাশ বাতাস যেন কি এক মধুর বাঁশির নাম না জানা সুরে সমস্ত বোধকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো। ঘোর লেগেছিলো বোধয় সব কিছুতে। সেই ঘোরে প্রতিদিনের নিত্য নৈমিত্তিক কাজ যেন আরো আরো সুন্দর হয়ে উঠলো। সব কিছু এক অপরূপ লালিত্যে ভিজিয়ে দিতে থাকলো যেন। রোজকারের হাতের কাজ, ঘর গোছানো, এমনকি রান্না ঘরের শিশি কৌটো, জামাকাপড় ও যেন হেসে উঠতে লাগলো। 

লাবণ্যের মনে হলো এই ঘোরের মধ্যে নিজের সব থেকে পাশে থাকা মানুষটাকেও তো আনা দরকার, নাহলে এ আনন্দ যে কিছুতেই পরিপূর্ণতা পাচ্ছেনা ! আর সেই ভাবনাই লাবন্যকে তার স্বপ্নের জগৎ থেকে এক ঝটকায় টেনে নিয়ে এলো বাস্তবের কঠিন মাটিতে। শুভকে লাবণ্য চাইলো কিছুটা হলেও তার এই আনন্দের ভাগ দিতে। লাবন্যকে নিয়ে শুভর মধ্যে কোনোদিন ই অনিশ্চয়তার লেশ মাত্র ও ছিলোনা, বরং লাবণ্য  যে একান্ত ভাবে শুধু তার ই এর এক অনুপম গর্ব ছিল ওর মধ্যে। লাবণ্য সে গর্ব উপভোগ করতো। ওদের একে অপরকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। লাবণ্য চাইতো শুভর যেন স্বপ্নপূরণ হয় আর শুভ চাইতো লাবণ্য যেন অনেক অনেক বড় হয়, অনেক নাম হয়, খ্যাতি হয়। লাবণ্যের খ্যাতির মোহো কোনোদিন ই ছিলোনা, তার শুধু একান্তিক চাওয়া ছিল ওই রোদ্দুর যেন তার আপন সংসারে ঝলমল করে ওঠে আর ওই জ্যোৎস্না যেন আরো সুন্দর আরো স্নিগ্ধ হয়ে তার ঘরে উঁকি দিয়ে যায়। না, তার এই ভাবনার কথা অনেক চেষ্টাতেও সে পৌঁছে দিতে পারেনি শোভনলাল এর মধ্যে। এ নিয়ে তার কোনো অনুযোগ নেই। কোথাও একটু কষ্ট ছিল, আজ আর তাও নেই। তবু তার বড় ইচ্ছে হলো, তার নিত্য ভাললাগার সঙ্গী করে নিতে তার সব থেকে কাছের মানুষটিকে, বড্ডো ইচ্ছে হলো কুয়াশার মধ্যে একসাথে জঙ্গলে ঘুরে আসতে বা সারা রাত জেগে ভোর হওয়া দেখতে, অথবা এই নরম আদুরে শীত এ ঝাড়লণ্ঠনের তলায় কিংবা প্রদীপের আলোয় ফুলের গন্ধের মাঝে, শুধু দুজনে রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে রাত জাগতে। বা প্রিয় কোনো লেখার মধ্যে বুঁদ হয়ে যেতে। ভুল করে ফেললো সেখানেই, শোভনলাল এর এতটুকু দোষ নেই এতে, আপন বোঝাপড়া, সমঝোতার সংসারে লাবণ্য কেনই বা এ চিন্তা নিয়ে এলো, মনে হলো মেয়েটা দূরে চলে যাচ্ছে, নিজের কর্ম ক্ষেত্র থেকে বহুদূরে নিজেকে নিয়ে চলে যাচ্ছে, প্রথমে রাগ হয়ে গেলো তারপর কষ্ট হলো, ওকে না বোঝার একটা কষ্ট কুরে কুরে খেতে লাগলো নিজেকে। বললো সে কথা লাবণ্য কে। 
ঝড় উঠেছিল সেদিন বন্যার মনে। ঠিক ভুল, খারাপ ভালোর দোলা চলে নিজেকে অস্থির করে ফেলেছিলো, নিজের জীবন থেকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়েছিলো তার মিতা কে। কিন্তু এ কি হলো, চারিদিক এমন শূন্য হয়ে গেলো কেন, এতো খালি, এতো নিরাশা আগে তো আসেনি। স্বভাব বিরুদ্ধ প্রগলভতায় সেদিন সে বুঝতে পেরেছিলো তার মনোজগতে তার মিতার অবাধ বিচরণের কথা। শিউরে উঠেছিল লাবণ্য, স্বীকার করেছিল নিজের কাছে, তার মিতার কাছেও। 
আসতে আসতে, অন্য আর পাঁচ টা দিনের মতো সেদিন ও গোধূলী নেমেছিল পৃথিবীর বুকে, অস্থির লাবণ্য আশ্রয় নিয়েছিল তার চির নিশ্চিন্তের আশ্রয় ঠাকুর ঘরে। খালি হাতে ফিরতে হয়নি তাকে। ধুপ, ধুনো , ফুল চন্দনের মধ্যে দিয়ে তার আপন হাতের সযতনে রচিত সংসারের মধ্যে দিয়ে নেমে এলো এক অপূর্ব স্থির শান্তি। অনেক না বোঝা কথা সেদিন বুঝেছিলো সে। বুঝতে পেরেছিলো সব সম্পর্ক কোথাও আপন আপন মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে আছে, এর মধ্যে কোনো গ্লানি নেই, কোনো মালিন্য নেই। কোনো কলুষতা নেই। বড় পবিত্র এ সব কিছু। এর মধ্যে কোথাও কোনো ভান নেই। শোভনলালের প্রতি অপরিসীম স্নেহ অনুভব করেছিল সে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ওর না বোঝাকে আর কখনো ভুল বুঝবোনা। নিজের মনের এই সমস্ত বোধ উজাড় করে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল অমিতর  কাছে , কিন্তু অমিত ও তাকে ছুতে পারলোনা। ভুল বুঝলো লাবন্যকে। নিজেকে কোনোদিন ই কারোর কাছেই তুলে ধরতে পারেনি লাবণ্য, সেদিন ও পারলোনা। আর শোভনলাল এর নিন্দা, সে তার কাছে নিজে হাতে বিষপানের সমান। না, কিছু বোঝাবার বা কিছু খুলে বলা তার কাছে হয়েছিল  নিষ্প্রয়োজন। শুধু আর্জি জানিয়েছিল তাকে বুঝতে না পারুক যেন ভুল না বোঝে। কিন্তু বোঝেনি। তার নিজের মিতার তাকে না বোঝা, চাবুকের মতো এসে পড়লো তার কাছে। রাত পেরিয়ে ভোর হলো। লাবণ্য বুঝলো তার কাছ থেকে ভোর হওয়ার খবর না পেলেও চলবে অমিতর। একদিন হটাৎ ই যে 'বন্যা' আর 'মিতা' কে পথ এক সুরে 'মিতা' করে দিয়েছিলো, হটাৎ করে ওই একটা রাত তাদের এনে ফেললো সহস্র যোজন দূরে। লাবণ্য অপেক্ষায় ছিল। তাদের নিজেদের জগৎ টার কাছে যেতে বারবার ইচ্ছে হচ্ছিলো। এর পরের আরো এক রাত পেরিয়ে ভোর হলো- সেই ভোর হওয়ার একটি শব্দ ও যখন অমিতর কাছ থেকে লাবণ্যের কাছে এসে পৌঁছালোনা, তখন ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিলো বন্যা। রাতের শিশিরে কুয়াশার মধ্যে ঠান্ডার মধ্যে অনেক্ষন বসে ছিল সে, ভোরের আশায়। ভোর হলো। আলাদা আলাদা ভাবে। কুয়াশা সিক্ত অশ্রু সিক্ত, ঠান্ডায় ম্লান বেদনায় ক্লান্ত, রিক্ত লাবণ্য এর কাছে ধরা দিলো এ সকাল। অন্যভাবে। সুন্দর কে দেখা একটা নেশার মতো, সেই সুন্দরকে ভাগ করে নিতে পারা বোধহয় আরো বড় এক নেশা। সেই নেশায় বুঁদ হয়ে গেছিলো সে, ঘোর ভাঙছে, বড় ভয় ছিল। ভেবেছিলো ঘোর ভাঙুক , কিন্তু তা যেন সুন্দরকে খণ্ড না করে দেয়। অসুন্দরের ভার আর অনাদরের ভার বহন করবার শক্তি নেই লাবণ্যের। কোনোদিন ই ছিলোনা তা। তাই সমস্ত শক্তি দিয়ে আজ সারাদিন সে যেন শুধু বলে চললো।....সুন্দর হোক , সুন্দর হোক , সুন্দর হোক.......

সুন্দর হয়ে তারকাছে আবার সব কিছু দেখা দেবে কিনা।..আমার সত্যি জানা নেই। ...তবে এভাবেই বোধহয় শেষের কবিতা শেষ হলো.....এ লেখার তাই নাম দিলাম "কবিতার শেষ"। 

ইচ্ছেনদী

আমার ল্যাব টা মাউন্ট sinai এর ১০ তলায়, আর আমার ওয়ার্কিং ডেস্কটা একদম জানালার ধারে , বিশাল জানালা। মনে হয় মেঘ গুলো এখুনি ঢুকে পড়বে এর মধ্যে। ...