Wednesday, 30 May 2018

এক ই চাঁদ

হাওয়া যখন মাতাল হোলো,
উছলে পড়লো আলো।
তুমি বললে কেমন আছিস,
আমি বললাম ভালো।

একটাই চাঁদ মাথার ওপরে,
শিরশিরানি হাওয়া।
কেমন করে যায় মিলে ,
এক ই চাওয়া পাওয়া।
অনেক কিছু চাইনা , শুধু
একটু খানি আলো
না পেলেও ক্ষতি নেই কিছু
শুধু থেকো তোমরা ভালো।
চাঁদের আলোয় যাচ্ছে ভেসে
দিগন্ত, চরাচর।
হিসেবের খাতা চলো বন্ধ করি
কিছু নেই দরকার।
চাওয়া, পাওয়া, পাওয়া, না-পাওয়া
থাক পরে থাক ওই কোণে।
আমরা নাহয় পাড়ি ই দিলাম
ওই জোছনা ভেজা 'বনে ' .
চাঁপার গন্ধে পথ চিনে নি,
বেলি দোলাক মাথা।
দখিনা হাওয়া আজ পাগলপারা ,
একই আকুলতা।
তোমার টবের গোলাপ যখন
তাকালো মুচকি হেসে ,
চাঁদের আদর জড়ালো গায়ে
বড্ডো ভালোবেসে ,
ঠিক তখন ই চাঁদকে আগলে রেখে বুকে
বললো শুকতারা।
আছি আমি, রইলাম ও,
চলতে থাকিস, কেউ হবিনা পথহারা।

এক ই চাঁদ, এক ই তারা
একটাই ওই আকাশ
দূরে হোক, কাছে হোক
সেই এক ই মধুর আভাষ।






Wednesday, 23 May 2018

সন্ন্যাসী

 ছাদে ছিলাম। কতক্ষন ঠিক জানিনা। ঘড়ি, মোবাইল, facebook , সোশ্যাল মিডিয়ার হাজার রকমের বিভ্রান্তিতে আমরা নিজেরা নিজেদের সাথে সময় কাটাতে ভুলেই যাই কখনো কখনো। মাঝেমাঝে তাই নিজেকে কিছুক্ষনের জন্যে এই সব কিছু থেকে বের করে নিয়ে আসা দরকার হয়ে পরে। তাই কিছুক্ষনের জন্যে নিজেকে এই সব কিছু থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে আমার ওই একান্ত আপনার সময়টা একান্ত ভাবে শুধু নিজেকে দিয়েছিলাম। সমস্ত আকাশ আবীর রঙে রাঙিয়ে আমার দিনের দিবাকর বিদায় নিলেন। ওই দূরে পাহাড়টার ওপারে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। তারপর দেখলাম। আর নেই। পরে আছে লালে লাল আকাশ। 

গত কালের অস্থিরতা, আজকের কি এক অপেক্ষার সাথে মিশে আমার মনকে করে তুলেছিল অশান্ত। ওই স্থির, ধ্যানমগ্ন প্রকৃতি, আসতে আসতে লাল রঙের রেশ মুছে গিয়ে যখন সন্ধ্যার গভীরতা কে তুলে ধরতে লাগলো, দূরে ওই পাহাড়ের চূড়ার ওপরএর মন্দির থেকে ভেসে আসা ওই ক্ষীণ কিন্তু গভীর শান্তিময় সন্ধ্যারতির শব্দ ভেসে এলো। তখন বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক ঢেউ উঠলো। যেন দামামা বেজে উঠলো। তারপর ধীরে ধীরে সেই শব্দ সমস্ত কোলাহল স্তব্ধ করে দিয়ে, অনন্ত সুন্দরের মতো আপনার মুখখানি তুলে ধরলো। আকাশে তখন এক মঙ্গলময় চাঁদ স্মিত হেসে তাকাচ্ছে। মনে হলো আমার সমস্ত দিনের জমে থাকা অজস্র প্রশ্ন, গ্লানি, ব্যাথা, বেদনা, অপূর্ণতা সব কিছু থেকে আমি যেন বেরিয়ে আসতে পারলাম , সদ্য স্নান করার পর যেমন শীতল, সুন্দর বোধ হয়, সেইরকম মনে হলো যেন ওই সন্ধ্যা নামার মুহূর্তে ওই অস্তগামীর আভায়, চাঁদের স্মিত হাসিতে অবগাহন করে উঠলাম। 

বুকের মধ্যে যখন সেই গভীর প্রাপ্তি নিয়ে নিচে এলাম, তখন হটাৎ আবার প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম। শান্তি, সেই পরম প্রাপ্তির প্রতিধ্বনি। জানিনা কেন নিজের সমস্ত চেতনা এইভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এ কিসের আহ্বান। এ কিসের ইঙ্গিত। এ কি পরীক্ষা।  তবে যাইহোক, বড় পবিত্র এই প্রতিধ্বনি। আর সেখান থেকেই আরো এক বাসনার কথা ভেসে এলো, 'ভাবছি সন্ন্যাস নেবো'। ঠিক এইরকম ই কিছু তখন অনেক বছর আগে, আমি যখন কলেজ এ পড়ি মনে হয়েছিল। সবসময় মনে হতো, এ জীবনের কি মানে, কি লক্ষ্য এই জীবনের। কেন আমরা এসেছি এই পৃথিবীতে, শুধুই কি চাকরির জন্যে পড়াশুনো, টাকা রোজগারের জন্যে চাকরি, ভালো থাকার জন্যে বিয়ে, সংসার, আমার আর আমার, গাড়ি , বাড়ি।..তারপর।...তারপর কি? বাবাকে বলেছিলাম আমি বিয়ে করবোনা। বাবা বললো কেন। আমি বলেছিলাম না যদি না করি, বাবা বলেছিলো না সেটাও করতেই পারিস। কিন্তু না বুঝে শুধু মোহে পরে কিছু ভাববিনা। আমি ঠিক জানতামনা, বলেছিলাম, জানিনা বাবা, তবে মনে হয় আমি যেন সন্ন্যাসি হয়ে যাই। বাবা রামকৃষ্ণকথামৃত পরে আমাকে সন্ন্যাসী হওয়া নিয়ে রামকৃষ্ণ কি বলেছেন জানাতে বলেছিলো। পড়েছিলাম। সব হয়তো বুঝিনি। কিছু বোঝা নিয়ে কিছু না বোঝা নিয়ে সেই থেকে আজ পর্যন্ত মনের মধ্যে থেকে গেছে, যে সংসারে থেকেও সন্ন্যাসী হওয়া যায়। রামকৃষ্ণ এর সেই উপমা নিজেদের যদি হাঁসের মতো তৈরি করতে পারি, হাঁস যেমন শুধু দুধ টুকু খায় জল টুকু ফেলে দিয়ে। সেইরকম। সংসারের মধ্যেও দুধ আর জল মিশে থাকে, সেই জল মিশ্রিত দুধ থেকে আমাদের শুধু দুধ টুকু তুলে নিতে হবে। সেইটাই হলো সাধনা। সেই হলো আসল সন্ন্যাস। আমার অপর প্রান্ত থেকে যে সন্ন্যাস হবার কথা ভেসে এলো আজ, তাতে আমার ভীষণ ভাবে এই কথা মনে হলো। আর মনে হলো, তুমি ঠিক সেই পথেই আছো, পদ্ম পাতায় জল এর মতো সংসারের ওপর ভেসে থেকে তার মধ্যে থেকে অথচ তার সাথে ভেসে না গিয়ে স্বমহিমায় সূর্য্যের কিরণে জ্বলজ্বল করছো। তোমার সৃষ্টির নেশা, তোমার ভালোবাসা, স্নেহ তোমার চারপাশে মায়ার বলয় রচনা করে তোমাকে ঘিরে রাখবে। অসাধারন আমার মধ্যে কিছুই নেই, আমি খুব সাধারণ আর খুব সাধারণ ভাবে আমার চারপাশটাকে আমি দেখতে চাই। আমার চাওয়া, পাওয়া আর পাওয়া না পাওয়ার মাঝে এক অলিখিত সেতু বন্ধন আপনি হয়ে গিয়ে আমাকে পৌঁছে দিয়েছে এই চাঁদনী রাতের মাধুরীর খোঁজে। সেই মাধুরী মমতা হয়ে তোমাকে জড়িয়ে থাকুক , তোমার সব অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিক। কিন্তু তা যেন অন্য কোথাও অসুন্দরের ছায়া না ফেলে। 

এখন রাত হয়েছে। চাঁদএর আলো খুব নরম হয়ে, আদর হয়ে হয়তো জড়িয়ে রাখছে কাউকে। কেউ বা হয়তো সে আলো অবহেলায় সরিয়ে দিচ্ছে দূরে। হয়তো কেউ খুঁজছে আবার হয়তো কেউ পেয়েও হারাচ্ছে। কি বিচিত্র এই সংসার। আমাদের এই সংসারে প্রতিনিয়ত ঘটে চলে নানান ঘটনা। কত তার অর্থ, কত তার ইঙ্গিত। হয়তো কত ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তা আমাদেরকে প্রতিদিন একটু একটু করে আমাদের চলার পথের পাথেয় খুঁজে দেয়। আমাদের বোধ কে উন্নত করে। চলার পথে, কত ইচ্ছে, কত আশা অনেক সময় আমাদের সেই যাত্রাকে মেদুর করে তোলে। হয়তো পথের বাঁকে পৌঁছে আমরা চুপ করে ভাবতে থাকি, ফেলে আসা পথের কথা। হয়তো ভাবতে থাকি, আগামীর পথের কথা। তারপর আবার চলতে শুরু করি। পথ নিজেই পৌঁছে নিয়ে যায় আমাদের গন্তব্যে। সেই পথে, আমাদের শুভ কামনা, শুভ চেতনা আর অভিজ্ঞতা আমাদের পরিণত ভাবে ভাবতে শেখায়। তখন আমরা আমাদের না পূরণ হওয়া ইচ্ছে গুলোকে, পূরণ করার জন্যে না দৌড়ে, স্বপ্ন দিয়ে মুড়ে ভবিষ্যতের হাতে গচ্ছিত রেখে দি। আর মনে মনে ভাবি, কোনো একদিন যদি ভগবান আজকের এই পরীক্ষাতে পাশ করার জন্যে আমাদের পুরষ্কৃত করে আমাদের হাতে তুলে দেয় ওই ইচ্ছাপূরণের চাবিকাঠি। তখন সবাইকে ভালো রেখে, নিজেদের জন্যে রাখবো একটা দিন যেখানে আজকের যা কিছু তখন খুব যত্ন নিয়ে ভালোবেসে আলোচনা করবো। ঠোঁটের ওপরে হাসির রেখা হয়তো চাঁদ কে বাধ্য করবে কোপাই এর ওপর নিজের ছোয়া ফেলতে। আর সেদিন একরাশ চাঁপা ফুল তুলে রেখো আমার জন্যে। আমরা সেদিন নাহয় আমাদের ক্রমবর্ধমান ইচ্ছেখাতার ইচ্ছের লিস্ট গুলো নিয়ে বসবো। মনে পড়বে আদুরে অভিমান গুলোর কথা, মনে পড়বে সবুজ এর আনন্দ, নীলের গভীরতা, সাদার শুভ্রতার কথা। আর এখন সেই দূর ভবিষ্যতের সুখকর দিনের কথা মনের মাঝে রেখে এসো মনে করি ওই সন্ধ্যারাতির শব্দকে।  আর ওই সন্ধ্যারাতির শব্দ, ধূপের গন্ধ , ধুনোর আবেশের সাথে মিশে যখন স্থির, অচঞ্চল শান্তি নিয়ে আসবে। তখন ওই কর্পূর জলে হাত ডুবিয়ে, সেই শান্ত, শীতল জল এ ভেজা ঠান্ডা হাতে , অনুভব করবো আজকের সুন্দরতা কে, আগামীর সুন্দরতাকে, চিরকালীন সত্যি, চিরকালীন সুন্দরতা কে । আর সেই শীতল সুন্দরের অনুভব ছড়িয়ে পড়বে তোমার মধ্যে, আমার মধ্যে, আমাদের উত্তপ্ত, অশান্ত পৃথিবীকে শান্তকরে আগামীর আহ্বান শোনাবে। 

Friday, 18 May 2018

বিষয়ী

 সন্ধ্যে বেলায় বাড়ির উষ্ণতাটা ভীষণ মিস করি। ধুপ ধুনো কর্পূরের গন্ধ, তুলসী তলা, আমার সেই ছোট্ট প্রদীপটা, একসাথে চা খাওয়া, সারাদিনের সমস্ত রকম গল্প। কত আনন্দ কে যে যত্ন করে ধরে রাখা যেতে পারে, ওই ৪ দেওয়ালের মাঝে। 
আমার নিজের গৃহকোণটাকেও হয়তো চেষ্টা করি, ঐরকম ঝকঝকে, জমজমাট করে তুলতে, ঘষামাজা চলছে, একদিন নিশ্চই, mobile, netflix এর নানান সাসপেন্স, মার্ডার আর কমেডি শো থেকে বার হয়ে এসে আমার ছোট্ট ঘর এর সন্ধ্যাও সোনালি হয়ে গল্প গানে সেজে উঠবে। নিশ্চই হবে তা। অপেক্ষা করবো। তবে আজকে জানিনা কেন এই ঝোড়ো ভিজে হাওয়ার সন্ধ্যে বেলায় একলা আমার এই হোস্টেল এর ঘরটাতে বসে, ধূপের ধোয়াতে, ঝরে যাওয়া চাঁপা ফুলের গন্ধে খুব কান্না পাচ্ছে। বুঝলাম এসব ই ওই বদমাশ মনখারাপ টার কারসাজি। আবার আমার মধ্যে ঢুকে আমাকে তছনছ করে দেবার ইচ্ছে বুঝি। না কিছুতেই একে জিততে দিলে চলবেনা। কিছুক্ষন চালালাম যুদ্ধ। তারপর যেন আর যুদ্ধেরও ইচ্ছে হলোনা। কেমন এক বিষন্ন ক্লান্তিতে চুপ করে বসে রইলাম। মনে হলো জীবনে আমার বোধয় আর বিষয়ী হওয়া হলোনা। কতবার ভেবেছি হোস্টেল এর এই রুম টা ছেড়ে দেব। কতগুলো করে টাকা HRA তেই কেটে যায়, একটু নাহয় কষ্ট করে যাতায়াত করে নেবো। কিন্তু কাজটাও এমন আর আমার "বন্ধু'বরে"র কথায় আমার এই আলটুসি health টাও এমন যে কিছুতেই ওই যাতায়াত করা হয়ে ওঠেনা। শুধু যদি ১০টা ৫টার কাজ হতো, তাহলেও হয়তো কোনো কথা না শুনে জোর করে যাতায়াত ই করতাম, কিন্তু ওই যে স্বইচ্ছেতেই যে মাথার কাজ বেছেছি। তাই মাঝখান থেকে আমি এই  শহর ও শহরতলী র প্রায় দু খানা সংসার সামলাছি গত ৪ বছর ধরে, না আপসোস নয়, উপভোগ ই করি, তাইতো জোর করে নিজে হাতে রান্না করবো বলে রান্নার জন্যে কাউকে রাখতে দিইনি। তাইতো ক্লান্ত হয়ে ফেরার সময় ও বাজার করে নিয়ে যাই, কি কি রান্না করবো ভেবে ভেবে। HRA এর টাকাটা জমিয়ে রাখলে হয়তো অনেক কিছু করা যেত। নাহলে অন্তত পোস্টডক আর বিবাহিতের সুবিধে টা নিয়ে কোয়ার্টার টা তো নেওয়াই যেত। কিন্তু ওই যে বোকামি ই হয়তো। দুটোর কোনোটাই করা হয়নি। তার জন্যে কি আজ আপসোস হচ্ছে, না ঠিক আপসোস নয়, কিন্তু ভাবছি অনেক কিছুই জীবনে হয়তো করা যেত, কিন্তু হয়নি। তবে এটাও আমি মানি, আমি জানিও অনেক বছর পরে যখন একবার পিছন ফিরে তাকাবো তখন বুঝতে পারবো যে যা কিছু না হয়ে যা কিছু হয়েছে জীবনে বা যা কিছু না পেয়ে যা কিছু পেয়েছি জীবনে, ঐটাই হয়তো ওই সময়ের জন্যে আমাদের জন্যে একদম সঠিক। যদি জীবনে আমি যেমন যেমন যা যা চেয়েছি সব ই পেয়ে যেতাম, তাহলে হয়তো কখনো এইভাবে নিজের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতে পারতামনা। আমার এই ঘরে সন্ধ্যে এমন মদির হয়ে নেমে আসতোনা। বা ভোর ৪তে থেকে পাখির কাকলি আমাকে ডেকে তুলতোনা। আমার এই হোস্টেল জীবন আমাকে ভীষণ ভাবে নিজেকে চিনিয়েছে। চারপাশটাকে বুঝিয়েছে। হোস্টেল লাইফ আমি আগেও কাটিয়েছি। কিন্তু এই জীবনটা একদম অন্যভাবে আমার কাছে এসেছে। হয়তো এক পরিণত জীবন যাত্রা, যেটা কখনো ভাবিনি, সেটা এখানে এসে দেখেছি তাই। হয়তো এখানে এসে নিজেকে পরিচিত করেছি এক অদ্ভুত বাঁধাহীন বাঁধনএর সাথে, যে বাঁধন অন্য আর কারোর কাছে নয়, যার লাগাম নিজের ই কাছে থাকে। 

আজকের বিকেলের এই ঝড় জল আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলো গত পরশুর সেই অভিজ্ঞতার কথা। যখন ওই রাতের বেলা ঘরে না ফিরতে পেরে এক মেয়ে একা ল্যাব এ এক কাপ কফি নিয়ে সাক্ষী হলো ঝড়ের মধ্যে দিয়ে আসতে আসতে  কিভাবে অন্ধকার সরে গিয়ে শান্ত দিনের শুরু হয়। সেই মেয়ে যে এতটুকু জোড়ে হাওয়া চললেই জানলা দরজা বন্ধ করে বাবার কোলে গিয়ে আশ্রয় নিতো, সেই মেয়ে। চোখের সামনে সেদিন দেখলো সাধের চাঁপা ফুলের গাছটা ঝড়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে কিভাবে নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলো, সেই শ্বেতশুভ্র ভুল গুলো মাটিতে কাদাতে লুটোপুটি খেতে লাগলো আর ঝড় নিষ্ঠূর ভাবে সমস্ত গাছটাকে যেন তছনছ করে দিয়ে, ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে চলে গেলো। কাঁচের জানলার এপাশ থেকে করার কিচ্ছু ছিলোনা। ভয়ে দলা পাকানো কান্না নিয়ে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো, পারলোনা তাকে দুহাতে করে কাছে টেনে বুকের মধ্যে আগলে রাখতে। ধুলোর মধ্যে দিয়ে, প্রলয়ের মধ্যে দিয়ে, ঘরে ফিরে এসে দেখলাম, এতো বছরের সাধের ফুলদানি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে লুটোচ্ছে। বুদ্ধমূর্তি একপাশে হেলে, খাতায় আটকে গ্যাছে বলে শুধু কিছু হয়নি। কিন্তু গনেশের গায়ে ঝড় তার চিহ্ণ রেখে গ্যাছে। ধুলো বালিতে ভরা ঘর, ভাঙা ফুলদানি, বাইরে ঝড়ের শো শো শব্দ যেন কেমন এক অশুভ ইঙ্গিতে আমাকে একাকিত্বে ভয়ে, কান্নায় জর্জরিত করে ফেললো। 
ওই ফুলদানিটা প্রথম স্টাইপেন্ড পেয়ে কেনা ছিল। মা এর জন্যে শাড়ি, বাবার জন্যে শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় এর "ঐতিহাসিক সমগ্র" আর বন্ধুবর টির জন্যে একটা হাফ পাঞ্জাবী কিনে সেই প্রথম নিজের জন্যে কিনেছিলাম যাদবপুরের রাস্তার ধার থেকে ওই ফুলদানীটা। তারপর কলকাতার পাট চুকিয়ে দিল্লিতে আসার সময়ও তাকে সঙ্গে করে আনতে ভুলিনি। যখন যেভাবে যা পেয়েছি, তাই দিয়ে সাজিয়েছি ওই ফুলদানী। কৃষ্ণচূড়ার ডাল, নাম না জানা হলুদ ফুল, চাঁপার গুচ্ছ , বন্য ঘাস পাতা।জ্যোৎস্না রাতে সবকটা পর্দা সরিয়ে দেবার পরে যখন কাঁচের দেওয়াল দিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে চাঁদের আলো সমস্ত ঘরটাকে ভাসিয়ে দিয়ে যায়, সকালের প্রথম রোদে যখন ঝলমল করে ওঠে, শীত এর মিঠে রোদ বা গ্রীষ্মের ঝিম মারা দুপুর এ যখন কি এক আবেশ তৈরি হয়, তখন বারবার ওই সব কিছুর সাথে আমার ওই ফুলদানী হেসে উঠে আমার এই ঘরকে বারেবারে সাজিয়ে দিয়েছে। 

সেদিন ওই ভোর রাতে ফুলদানীর ভাঙ্গা টুকরো গুলোকে ফেলে দিয়ে এসে, ঘর পরিষ্কার করতে করতে বারবার যেন কি এক অশুভ আশঙ্কায় মন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিলো। তবে কি এমন কিছু ঘটতে চলেছে আমার নিজের বা আমার পরিচিত কারোর জীবনে, যা থেকে আমি তাকে বাঁচাতে পারবোনা? শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হবে, ওই ভেঙ্গে যাওয়া? বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো আমার খুব প্রিয়, ওই শ্বেত শুভ্র চাঁপা ফুল গুলোর অসহায় আর্তি। ভয় , গ্লানি , রাত্রি জাগার ক্লান্তি, অজানা আশংকা সব কিছুতে আমি যেন ভীষণ ভাবে শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিলো কোথাও কি পৌঁছে দেওয়া উচিত আমার এই ভাবনার কথা, সাবধান হওয়া উচিত কি অনেক বেশি। জানিনা। সবকিছু পরিষ্কার করে যখন স্নান করে ঘরে এলাম, দেখলাম ঝড় থেমে গেছে। সেই প্রলয় থেকে আসতে আসতে চোখ মেলে তাকাচ্ছে এই ধরিত্রী। চারপাশ ভীষণ রকমের শান্ত, স্থির, ঠান্ডা। সবে স্নান সেরেছিলাম। গা শিরশির করে উঠছিলো। একটা ধুপ জ্বালালাম। আর তারপর ছাদে গেলাম। পশ্চিম আকাশ থেকে তখনো কালো মেঘের ঘনঘটা কাটেনি, আর পুব আকাশ আসতে আসতে , ধীরে ধীরে গোলাপি, তারপর লালে ছোট্ট শিশুর মতো চোখ রগড়াতে রগড়াতে চোখ মেলে তাকাচ্ছে। সেই লাল রং ধীরে ধীরে সমস্ত আকাশকে ভরিয়ে দিতে লাগলো, কিছুক্ষনের মধ্যে কালোর চিহ্ন কোথায় মুছে গিয়ে, প্রলাপের চিহ্ন কোথায় সরে গিয়ে সোনালী আভাতে শুরু হলো নতুন দিন। কিছুক্ষন আগে যে আমি ভয়ে, ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে ছিলাম, কি এক জাদুকাঠিতে সেই আমি ই স্নাত, স্নিগ্ধ হয়ে স্থির হয়ে এই শান্ত আর বড় পবিত্র সেই ব্রহ্মহ মুহূর্তের সাক্ষী হলাম। শুনেছিলাম ব্রহ্মহ মুহূর্তের থেকে পবিত্র ক্ষণ নাকি আর হয়না। র আমি সেই ক্ষনে নিজের মনের এই অল্প কিছুক্ষনের তফাতে এমন পরিবর্তন এমন দুই বিপরীত ধর্মী অনুভবে ভীষণ ভাবে বিস্মিত হলাম। মনে হলো যে ঝড় আসার সে আসেই বোধয় জীবনে, তাকে এড়ানো হয়তো যায়না। কিন্তু সেই ঝড় ও থামে। প্রকৃতি তার আপন নিয়মে সে ঝড় থেকে নিজেকে থিতু করে। আর ঠিক সময়ে ওই নতুন দিনের সূচনা করার মতো সূর্যোদয় তার আপন মহিমায় উজ্জ্বল করে দেয় আমাদের জীবনকে। আবার। বারবার। শুধু আমাদের ওই অনুভব টাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, যাতে ওই যে যখন সূর্যোদয় হবে, তখন ও যেন আমরা ঝড়ে বিধ্যস্ত হয়ে বসে না থাকি, তখন যেন আমরা ঠিক ওই দিনের মতো শান্ত , স্থির , সুন্দর ভাবে ওই নবসূচনাকে অন্তরে স্থাপন করতে পারি। তাহলেই যতই ঝড় আসুক না কেন , কোনো কিছুই লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারবেনা। ছাদ থেকে ফিরে শুলাম একটু, চোখ ও বন্ধ হয়ে এসেছিলো, কিন্তু অর্ধ জাগরণে শুধু ওই কথাই মনে আনাগোনা করছিলো। পৌঁছে দিতে ইচ্ছে করছিলো কোথাও, নিজের সেই সদ্যপ্রাপ্তি কে। কিন্তু সেদিন সুর বারবার কেটে যাচ্ছিলো, তাল মিলছিলনা।  অবশেষে আবার সুর খুঁজে পেলাম। কিন্তু তখন আমার আর কিছু বিশদ ভাবে বলা হয়ে উঠলোনা। দরকার ছিলোনা। কারণ ঠিক আমার মনের কথার ই প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম যে "প্রকৃতি নিজের নিয়মে আবার সব ঠিক করে দেবে। সব কিছু আবার গুছিয়ে দেবে। " আজ সকালে ল্যাব এ যাবার সময় মনেই হলোনা আগে কখনো কিছু হয়েছে বলে। ...দেখলাম, পৃথিবী সত্যি ই গুছিয়ে নিয়েছে সব কিছু। আমার চাঁপার ও সব কুঁড়ি ঝরে যায়নি দেখলাম। আজ আবার ফুটেছে। 








Sunday, 13 May 2018

চাঁপা ফুল

কিছুদিন ধরে পুরোনো বেশ কিছু ছবি বারবার আমাকে পৌঁছে দিচ্ছিলো আমার ছোটবেলার দিনগুলোতে। আবৃতি, আঁকা, রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তী , আর এই সব ভাবতে ভাবতেই ২৫ শে বৈশাখ এসে গেছিলো। যদিও কোনো দিনকে কখনোই আলাদা করে পালন করার খুব একটা পক্ষপাতী আমি নই।  সব দিন ই তো সমান। কাউকে মনে করার জন্যে আলাদা করে বিশেষ একটা দিন হয়না ঠিক ই। তবু ওই যে অভ্যাস, ওই এতোবছরের অভ্যেস এর বশে কি যেন এক উৎসবে মদির হয়ে থাকে, আমার ওই দিনটা। এ বছর ও তার ব্যতিক্রম হলোনা দেখলাম। 
aiims যাবার সময় একটা রাস্তা পরে , যেখানে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া না সোনাঝুরি না কি রবি ঠাকুরের অমলতাস, তা ঠিক জানিনা, কিন্তু ওই লাল আর হলুদ ফুলে দুধার ভরে থাকে। বাস থেকে যতটা পারা যায়, দুচোখ ভোরে দেখি ওই লাল হলুদের মাঝে দুপুরের রোদে ঝলসানো নীল আকাশটাকে, আকাশ তখন যেন আর ঝলসে যায়না, বরং ওই রং এর মাঝে সেও খুব নরম হয়ে মুচকি মুচকি হেসে তাকায়। 

সেদিন, ওই দাড়িওলা বুড়ো মানুষটার জন্মদিনের দিন আর কি, কিছুইনা, তবু যেন কি এক উৎসব এর ছোঁয়ায় আমার রাস্তা ভরে ছিল, কাজের ফাঁকে বারবার মন ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো। দুপুর ১২ তা নাগাদ দেখলাম, আকাশে মেঘ জমেছে, হালকা নয় , কালো কালো আবেশ মাখানো মেঘ , আসতে আসতে এগিয়ে আসছে। বুঝলাম দাড়িওলা মানুষটা তার এই ভক্তটিকে খালি হাতে ফেরাবেনা। এই সুযোগের অপব্যবহার করা যায়না। অতএব মনটাকে আর ধরে বেঁধে না রেখে বেরিয়ে এসেছিলাম, বাড়ি ফেরার কিছুক্ষনের মধ্যে, কালো মেঘ আরো আরো ঘন হয়ে এলো। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছিলো। 
কি এক অদ্ভুত ভালো লাগায় সমস্ত শরীর মন আচ্ছন্ন হয়ে চোখে জল এনে দিয়েছিলো হটাৎ। আমাদের চারপাশে এতো এত কিছু আছে? আমাদের কে মাতিয়ে রাখার জন্যে, ভাসিয়ে দেবার জন্যে এত আয়োজন, তবু শুধু আমরা বলি পাইনি, পাইনি। কে বলেছে, পাইনি? সব পেয়েছি। সব কিছু পরিপূর্ণ হয়ে আছে।
বৃষ্টি তখনো আসেনি, কিন্তু একটা মাতাল করা ঠান্ডা হাওয়া দূরে কোথাও বৃষ্টি হবার খবর নিয়ে এলো, জানিনা কেন কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো আমি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি। ভীষণ এক অন্য রকম অনুভব এ অনেক্ষন চুপ করে শুধু বসে রইলাম। বুঁদ হয়ে বসেছিলাম। তারপর ওই ঠান্ডা হাওয়া সর্বান্তকরণে অনুভব করতে করতে বৃষ্টি এসে গেল, দু এক ফোঁটা বৃষ্টি গায়ে পড়তেই এক অসম্ভব শিহরণ অনুভব করলাম। তখন ই, ওই বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে, বোধয় "রাইসেনা বেঙ্গলি স্কুল " থেকে ভেসে আসছিলো "হে নুতন দেখা দিক আরবার , জন্মেরও প্রথম ও শুভক্ষণ "......হাওয়াতে সব কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলোনা, বারবার শব্দ ভেঙ্গে গিয়ে যেন তাকে আরো মধুর করে তুলছিলো। এখানে তখন শুনছিলাম "আমার এ ঘর বহু যতন করে, ধুতেও হবে, মুছতে হবে মোরে "..... 
সন্ধ্যে হওয়ার অনেক আগেই ওই মাতাল হাওয়া তার মাতলামি কাটিয়ে একদম শান্ত শিষ্ট ভালো মেয়ের মতো কনে দেখা আলোতে সেজে লাজুক চোখে তাকাতে লাগলো। প্রতিবারের মতো এবারেও রবি বুড়োর গলায় একটা রজনী গন্ধার মালা দেব ভেবেছিলাম। মালা পেয়েছিলাম , তবে সেটা এখানকার কি সব ফুলের। তাই সই। তাই দিয়েই প্রতিবারের মতো সাজিয়েছিলাম ওই আমার কাছে দাড়িওলা লোকটার যে প্রিন্টআউট টা আছে, তাকে। এখানে কোনো সেরকম বাঁধানো প্রতিকৃতি নেই, তবে, একটা প্রিন্ট আউট কে পিচবোর্ড এ আটকে অনেক আগে থেকেই একটা প্রতিকৃতি তৈরি করা আছে, এমন ই ভক্তির শ্রী আমার, যে কোনোদিন সেখান থেকে এক সাজানো গোছানো বাঁধানো প্রতিকৃতি আর ঘরে রাখা হয়ে ওঠেনি। 
সন্ধ্যে নামলো, বোধয় অন্যদিনের থেকে একটু তাড়াতাড়ি ই। ধুপ, ধুনো কর্পূরের গন্ধের মাঝে, অর্ধসতেজ রজনীগন্ধার স্টিক ফুলদানিতে রেখে, ঝরে যাওয়া গোলাপের পাঁপড়ি গুলোকে যত্নে রাখতে রাখতে হটাৎ অনুভব করলাম, দুপুরের সেই মাতাল ভালোলাগার বদলে হটাৎ কেমন এক শূন্যতা আসছে। মনখারাপ একদম আমার ভালো লাগেনা। কারণ জানি, ভালোলাগার মতো মনখারাপ ও একটা নেশার মতো, তখন ওই দুঃখের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে, এমন প্যানপ্যান করতে থাকবো যে হয়তো আশেপাশের কত সুন্দর জিনিস আমার অগোচরেই যাবে থেকে। অতএব তাড়াতাড়ি সেই মনখারাপ কাটানোর জন্যে একার জন্যেই বানিয়ে ফেললাম জেসমিন টি। যদিও সাধারণত একার জন্যে কখনো কোনোদিন কিছু বানাতে আমার ভালো লাগেনা, তবু ওই বেয়াড়া মনখারাপ টাকে তো কাটাতে হবে। নাহলে যে এখুনি নাছোড়বান্দা বেতালের মতো ঘাড়ে সরি মনে চেপে বসবে। হালকা ভিজে হাওয়াটা কিন্তু সেদিন খুব বেয়াদপি করলো, আমার এত আয়োজন বৃথা করে দিয়ে, জেসমিন টি এর সুগন্ধকে মিথ্যে প্রমান করে দিয়ে কেমন এক বিষন্ন ক্লান্তি দিয়ে আমার সন্ধ্যেকে ঢেকে দিতে লাগলো, কি যেন এক নেই, কি যেন এক খালি, কি যেন এক অপেক্ষার মাঝে খুলে বসলাম গীতবিতান আর সঞ্চয়িতা। হয়তো অভ্যেস বশত , হয়তো আশ্রয় পাবার জন্যে যেমন বহুবার ছুটে যাই ওই লোকটার লেখনী গুলোকে ছুঁতে, সেরকম ই। 
না, খালি হাতে কোনোদিন ই বোধয় কাউকেই ফিরতে হয়না, আমরা চেয়ে না চেয়ে অনেক সময় কত কিছু পাই, ভেবেই পাইনে এর ঋণ চুকাই কি করে। যেমন আজ আমি গরমে বিদগ্ধ দুপুরে পেলাম অঝোর ধারায় বৃষ্টির ছোঁয়া।  যেমন আমার সেদিনের অনেক বড় প্রাপ্তি হলো, IPL এর খেলা ছেড়ে উঠে এসে আমার পাশের মানুষটি যখন আমার সাথে গলা মেলালো, হোকনা সে এক দুটো লাইন, তবু তাওতো আমার ই পাওয়া। ওই অমলীন সদা হাস্যময় মুখের দিকে তাকিয়ে কোনোদিন কোনো দাবি নিয়ে আমি দাঁড়াবোই না। তাই যখন সে বলে আমি একটু খেলা দেখলে রাগ করবিনাতো , তখন বিনা বাক্যব্যায়ে আমি বলতে পারি, আমিও আসছি এখুনি দেখতে। আমি যে সত্যি ই কোনোদিন রাগ করিনি। করিনা। আর তাই বোধহয় গত কালের রবীন্দ্র সন্ধ্যার কাছে আবার আমি দুহাত বাড়িয়ে পৌঁছে যেতে পেরেছিলাম। হয়তো সেদিনের সেই বিষণ্ণতা থেকেই যাবে, তাও গত কালের পাওয়াটাও যে মিথ্যে নয়।
বুঝলাম, এই চাওয়া পাওয়ার হিসেব খুব গোলমেলে। ওই যে আমার ঠাকুর, ওই হিসেবটা বোধহয় শুধু সেই করতে পারে, আর কি যে তার মনে আছে, শুধু সেই জানে, নইলে কেন এভাবে আমার এতদিনের সযত্নে রক্ষিত চাঁপা ফুলে আজ এতদিন পরে আমি কারোর দুহাত ভরিয়ে দিতে পারি। কোন অমৃত বোধে কালকে JNU auditorium এ ঢুকেই স্ক্রিন এ দেখি সেই কটি লাইন, যাতে আমার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। 
যেন কত বিষ্ময়, কত পাওয়া না পাওয়ার বোধ থেকে আজকের এই নবজাগরণের বোধ আমাকে ঘিরে ফেলে। মনে হয় যেন আমার ই জন্যে, শুধু আমাকেই বোধি দেবে বলে, ওই বাণী আমার সামনে জ্বলজ্বল করছে। শুরু হলো, 'কতবার ও ভেবেছিনু'...'যে ছিল আমার স্বপন চারিনী '....আর তারপরে যখন ওই লাইন গুলো এলো, "কতবার যে নিভলো বাতি/ গর্জে এলো ঝড়ের রাতি"...বুঝলাম ওই দাড়িওলা বুড়োর এ এক নতুন অভিসন্ধি। সঙ্গে বোধহয় হাত মিলিয়েছিল ওই যে আমার ওই ঠাকুর। ওই যে সবার ওপরে থেকে যে মুচকি মুচকি হেসে চলেছে। সেই ঠাকুর। আমার বিধাতা। ভগবান। যে নামেই তাঁকে ডাকিনা কেন, সেই পরম মহিমাময় এর ইচ্ছা ছাড়া যে গাছের একটা পাতাও নড়েনা। 

আসলে, বারবার আমার যে কথা মনে হয়, আজ আবার সেকথা বলতে ইচ্ছে করছে, সংসার অন্তঃসার শূন্য নয়। এতে অনেক আনন্দ ছড়ানো আছে। আর আমাদের এই সংসার নামক আনন্দলোক এ ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনাই বুঝি ভীষণ অর্থবহুল। কিছুর মানে হয়তো আমরা বুঝি, আবার অনেক কিছুই হয়তো থেকে যায় আমাদের চিরপরিচিত বোধের অগোচরে। তখন শত মাথা ঠুকে কেঁদে মরে গেলেও সে কেনোর কোনো উত্তর পাওয়া যায়না। কখনো কখনো সেই উত্তর না পেয়ে ভীষণ এক ক্লান্তি বোধে আমাদের গতি আটকে দেয়। মনে হয় সত্যি বোধয় পিছিয়ে যাচ্ছি, থেমে যাচ্ছি, ভুল হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। সত্যি তখন মনে হয় "ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু" . আবার বুঝতে পারি, ওই প্রভুই যা করার করছেন, তিনি ই সব কিছুকে চালনা করে চলেছেন। কোনো এক গভীর বোধে, কোনো এক শুভ চিন্তায় , কোনো এক সুন্দরের জন্যে হয়তো আমরা বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন সময় এ , বিভিন্ন জনকে আমাদের চলার পথে খুঁজে পাই, কিছু জন হয়তো আমাদের সাথে আজীবন একসাথে পা মিলিয়ে চলে, আবার কেউ কেউ হয়তো আর পা না মিলিয়ে অন্য কোনো পথ খুঁজে পেয়ে সে পথে মিলিয়ে যায়। তবে যদি মনে করি ওই পা মেলানোটাও যেমন নির্দিষ্ট, তেমনি কতটা পথ কার সাথে চলা এ সব এ বুঝি আমার ওই ঠাকুরের ঠিক করে রাখা, তবে নিজে যেন নিশ্চিন্ত হয়ে যাই। মনে হয় দিলাম ই নাহয় সবকিছু ওই কালের নিয়মে ছেড়ে, যা কিছু হবে সব ভালোই হবে। তাঁর মহিমা বোঝার আমরা কে, মনে পরে যায়, সেই সুর 
"তুমি সুন্দর, যৌবনঘন রসময় তব মূর্তি,
দৈনভরণ বৈভব তব অপচয় পরিপূর্তি। 
নৃত্য গীত কাব্য ছন্দ  কলগুঞ্জন বর্ণগন্ধ -
মরণহীন চিরনবীন তব মহিমাস্ফূর্তি। । "
আর তখন ই দূরের ওই বৃষ্টি ভেজা মাতাল হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যায় আমার ভাবনা রাশিও। জলের ছিটে যেন এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় আমার সর্বাঙ্গ। সর্বান্তকরণে অনুভব করি সেই শিহরণ। আর কি এক আবেশে হারিয়ে যেতে যেতে মনে হয় যেন একরাশ চাঁপার গন্ধ পেলাম। 
সেই তীব্র সতেজ, সবুজের মাঝে উজ্জ্বল শুভ্রতার চাঁপা ফুল, যার মাঝখানটা হালকা হলুদ। 









ইচ্ছেনদী

আমার ল্যাব টা মাউন্ট sinai এর ১০ তলায়, আর আমার ওয়ার্কিং ডেস্কটা একদম জানালার ধারে , বিশাল জানালা। মনে হয় মেঘ গুলো এখুনি ঢুকে পড়বে এর মধ্যে। ...