লেখাটা শুরু করেছিলাম international womens day বিশ্ব নারী দিবস এর দিনে। যদিও কোনো কিছুকেই সম্মান বা পালন করার জন্যে যে শুধু বছরের একটা দিন ই বরাদ্দ এ আমি নিজে খুব একটা বিশ্বাস করিনা। তবে সমগ্র বিশ্ববাসির বিশ্বাস কে হেলায় উড়িয়ে দেব এ হেন অহংকার ও আমার নেই। তাই সেই ভাবনা কে সম্মান জানিয়ে আমি সুযোগ নিলাম আমার জীবনে উল্লেখ যোগ্য কয়েকজন নারী, যাদের জন্যে কোনো সময়ের এক নাক দিয়ে সর্দি পড়া , ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদা ছোট্ট কোঁকড়া ঝাঁকড়া চুলের কোনো এক মেয়ে আজকে কলমের এক আঁচড়ে অনেক কিছু বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছে, তাদের অনস্বীকার্য অবদানকে স্মরণ করার। এখন কথা হচ্ছে এই যে আমার চারপাশের মানুষের কাহিনী আমায় হটাৎ কেন বলতে শুরু করলাম। কি জানেন, এই রাজধানীর বুকে কাটিয়ে দিয়েছি প্রায় ৮টি বছর। রাস্তায় ঘাটে, অফিস আদালতে, নিজের কাজের জায়গাতে অনেক ভালো অভিজ্ঞাতা আমার নিশ্চই হয়েছে, তবু তার সাথে সাথে বারবার এত অসহিষুতা দেখেছি, যার থেকে আমার একটা কথাই খুব মনে হয়েছে। শিক্ষা, আদর্শ, মূল্যবোধ এই সব কথা গুলো শুধু মাত্র বইয়ের পাতার কতগুলো শব্দ নয়, যত্ন করে তাকে রক্তের সাথে মিশিয়ে দিতে হয়, আর তখন যখন একজন ছেলে বা মেয়ে বড় হয়ে ওঠে। তাকে তার লক্ষ্য থেকে মাথা উঁচু করে বাঁচা থেকে কেউ সরাতে পারেনা, ডিগ্রী কখনো কাউকে প্রকৃত শিখিও করতে পারেনা, প্রকৃত শিক্ষা করে এই যে শব্দ গুলো বললাম, এর বোধ গুলো। আর তখন ভিড় করে আসে আমার নিজের ছেলেবেলা, যখন আমার চারপাশের মানুষেরা আমার অজান্তে, হয়তো বা তাদের নিজের ও অজান্তে আমাকে মানুষ করে তোলার কর্মযজ্ঞে মেতে ছিলেন। এদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য মানুষটি আমার বাবা, কিন্তু তার কথা কোনো এক পাঠ্যে তো নয় ই আমার এক জীবনেও আমি সবটুকু বুঝে বলে উঠতে পারবো কিনা সন্দেহ। তাই সেই চেষ্টা না করে ওই যে বললাম, নারী দিবস। সেই পঞ্চনারীর কাহিনীতে আসি। ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠাতে একের পর এক ভিড় করে আছে কত মুখ। তার মধ্যে শুধু কয়েকজনকে বেছে নেওয়া সত্যি ই কঠিন।
তবু স্মৃতির ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে তুলে বয়সের ক্রমানুসারে তাকে একটু এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাজিয়ে নিলে প্রথমেই মনে আসে এক মাথা সাদা চুলে ভরা সবসময় মুখে একটা মিষ্টি হাসি মাখা পুতুল পুতুল এই মানুষটির। আমার পিসিমা। আমি শুধু পিসি বলেই ডাকি অবশ্য। অবিশ্বাস্য কথা কি জানেন, এই মানুষটিকে আজ পর্যন্ত কেউ কখনো রাগা তো দূরের কথা, উঁচু গলায় কথা বলতেও শোনেনি। পিসির কথা মনে হলেই তাই আমার মাতা বসুধার কথা মনে হয়। না এতটুকু বাড়িয়ে বলছিনা। ধরিত্রীর মতোই অসীম সহনশীলতা তাঁর। আলাদা করে সেরকম বিশেষ করে বকে ঝকে কিছু শেখাতে আসেননি উনি। তবে পিসির ওই ধীর কথা, স্থিরতা, ধৈর্য্য, স্নেহ মায়ায় ভরা কাজ, অকুন্ঠ ভাবে ভালোবাসা এইসব কখন যে কিভাবে অজান্তে আমার ভেতরে আমার ই অজান্তে একদম গেঁথে গ্যাছে বুঝতে পারিনি। আর ও একটা জিনিস এর জন্যে এই মানুষটা সবার শ্রধ্যেয়। সেটা হলো জানার তৃষ্ণা আর মনসংযোগ। এখনো সারাদিন এর সব কাজ নিজে হাতে করার পরে , রাতের বেলায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পরে , বই পরে , ভূগোলের ম্যাপ দ্যাখে , তারপরে শুতে যায়। আমি যখন বকি খুব কেন রেস্ট নাওনা এসব বলি, তখন বলে, সময় তো কমে আসছে, যতটা জেনে বুঝে নেওয়া যায়, কতটা তো এখনো বাকি। এই হলো আমার পিসি। আমরা যারা এই প্রজন্মের facebook , tinder, বিশ্ব সংবাদ এর দুনিয়াতে পুরো একটা পাতা টানা মন দিয়ে পড়ার ধৈর্য্য রাখিনা, সেই খানে ৭২ বছরের এই মানুষটি এখনো রান্না করে, যত্ন করে বাগান করে, গাছ গুলোকে নিজের ছেলে মেয়েকে মানুষ করার মতো করেই বারো করে, ফুল ফোটায়, আমার আদরের কুট্টুস মানে ঘঁটুবুড়ি কে দেখা শোনা করে, ছেলে বৌ নাতনি নিয়ে সংসার এর হাল ধরে শুধু নয়, শক্ত হাতে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পিসি মানেই সাদা হাস্যময় একটা মুখ, কোনো বিরক্তি নেই, কারোর কাছে কোনো প্রত্যাশা নেই, শুধু ভীষণ কৰ্তব্য বোধ আর ভালোবাসা। তাঁর এই ভালোবাসা থেকে ছেলে মেয়ে ভাইপো ভাইঝি থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী, রাস্তার কুকুর বিড়াল কেউ ই কখনো বঞ্চিত হয়নি। এই প্রসঙ্গে অনেক দিন আগের একটা কথা খুব এখানে লিখতে ইচ্ছে করছে। আমি তখন মাস্টার্স করছি gwalior থেকে। বাড়িতে থাকিনা। বাবা, মা ও নিজের নিজের কাজের জগতে ব্যস্ত। পিসি সদ্য retire করেছে, দু দিনের জন্যে খুব সম্ভাবত আমার ছোট পিসিমণির বাড়ি গেছিলো বেড়াতে। বাড়িতে ছিল তখন দাদা আর ভাই। দুজনেই বড়ো, ফলে মা বাড়িতে না থাকায় কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়, বরং নিজের পছন্দ মতো খাবার রান্না করে খাওয়া যাবে, এতে বেশ আনন্দই ছিল এদের মনে। অসুবিধে কারোর ই কোথাও হবার কথা ছিলোনা। কিন্তু অসুবিধে হয়েছিল একজনের। আমাদের পাশের বাড়িতে কোনো এক সময় শখের বশে একটি রাস্তার কুকুরকে পোষা হয়েছিল, পরে তাঁরা একটি বড় আলসেশিয়ান পুষলেন এবং যথারীতি বিদেশী অতিথির সামনে বুড়ো দেশী পশুটি ভীষণ ভাবে ব্রাত্য লাগলো। ওনারা তাঁকে বিদায় পুরোপুরি না দিলেও, চলে গেলে যে ভালো হয় সেটা বুঝিয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি। অবহেলা বোঝার ক্ষমতা সবার ই বোধহয় আছে, সেই অবহেলা এমন অভিমান এর জন্ম দিলো যে সারমেয় টি একটু একটু করে প্রথমে কম করতে করতে একেবারেই ওই বাড়ির অন্ন ত্যাগ দিলো। আমাদের বাড়িতে তখন আমার ছোটবেলার সাথী কুট্টুস, আদুরে সবার চোখের মণি। এ হেনো কুট্টুসের সাথে ওই অভাগীর কিভাবে গড়ে উঠলো এক অলিখিত সম্পর্ক। কুট্টুস থাকতো গেট এর এপারে আর ও থাকতো গেট এর ওপারে, কুট্টুস কে খাবার দেবার সময় হলে, মা বা পিসির কেমন একটা খারাপ লাগতো, ওকেও তখন দেওয়া হতো, প্রথম প্রথম সেই খাবার ও কিন্তু ও মুখ দিতোনা, পরে কিজানি দু বন্ধুর কি কথা হলো, কুট্টুস খেত এদিকে আর ও খেত ওদিকে। আস্তে আস্তে গেট এর barrier গোছানো হলো, কুট্টুসের নতুন বন্ধু স্থান পেলো বাড়ির ভেতরেই। এভাবে চলতে থাকলো, তবে পুরোনো প্রভুদেরও ও ভোলেনি, কর্তব্য করতে যেত প্রতিদিন ওখানে, দেখে আবার চলে আসতো। বেশ কয়েকবছর এভাবে কাটছিলো, বয়সের জন্যে ধীরে ভুলুর জীবনীশক্তি কমতে থাকে, অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বেশ। পিসি না থাকাকালীন অসুস্থতা খুব বেশি বাড়ে। কিন্তু শুধু বুঝি ওই মমত্ব মাখা হাতের আদরটার জন্যে শেষ নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করতে পারছিলোনা। যেদিন পিসি ফিরলো, সেইদিন ই ভুলু কোনোরকমে টলতে টলতে গেট এ এসে দাঁড়ালো, কুট্টুস এর অদ্ভুত ডাকে পিসির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো পিসি, ভুলু টলতে টলতে এসে দাঁড়ালো, দাঁড়ানোর শক্তিও ছিলোনা, পিসি ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই ও শুয়ে পড়েছিল আর অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে তারপর চিরদিনের জন্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। জীবনে অনেক ঘটনাই থাকে আমাদের জানার আমাদের বোঝার বাইরে, এও সেরকম ই একটা ঘটনা যেখানে প্রিয় মানুষের হাতের ছোঁয়া টার জন্যে ছিল একটা অবলা প্রাণের অপেক্ষা।
এই হচ্ছেন আমার পিসি। একদম বইয়ের পাতাতে যেমন পিসিদের গল্প শোনা যায় ঠিক সেরকম। ছোটবেলার রথ, চড়ক এর মেলা বা ঠাকুর দেখতে যাওয়া আমাদের ছোটদের এনার ই হাতে ধরে হয়েছে। সেই ছোটরা এখন সবাই অনেক বড় হয়ে গেছে , ভাইঝি রা তাঁর প্রাণের খুব কাছের। সেই দুই ভাইঝি ও একজন থাকে কানাডায়, একজন দিল্লী। বড় টির কথা পরে বলছি কিন্তু ছোট টিও বিয়ের পর থেকে এতই সংসারী হয়েছেন যে দুদণ্ড বাড়িতে এসে পিসির কাছে বসে কথা বলার তেনার সময় হয়না। একটা কথা খুব মনে পড়ছে এখন লিখতে গিয়ে, সেবারে যখন বাড়ি গেছিলাম, পিসি কেমন ভাবে একটা বলেছিলো, একটু আসবি আমার কাছে, কথা বলবো। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠেছিল। এখনো উঠলো। এইসব পিসি মাসি মা দিদিদের আদরের আবডালে বড় হয়ে ওঠা ছেলেবেলাটা যেন বারো বেশি নিশ্চিন্তে কেটেছে। তবু ওই যে মায়ার ওই বাঁধন ই আবার শিখিয়েছে সবাইকে বেঁধে রাখার মন্ত্র। আর সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই কর্ম কর্তব্যে অনড় থেকে এগিয়ে চলা। আমার বাবা পিসির ছোটবেলা আমাদের মতো সুখের আবডালে মোড়া ছিলোনা, সবদিন পেট ভর্তি ভাত ও সবসময় যে জুটতো তা নয়, শুধু আধপেটা খেয়ে বা না খেয়ে একটা কথাকেই দুভাই বোনে পণ করেছিলেন যে পড়াশুনা টা চালিয়ে যেতে হবে। গিয়েছিলেন। তখন নকশাল আমল। আমার পিসিমা সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে স্কুল কলেজ এর গন্ডি পেরিয়ে ইতিহাসের শিক্ষকতা নিলেন। কিন্তু নকশাল আমলের ওই উত্তেজনার মধ্যে একা যাতায়াত করার অসুবিধের কারণে তাঁর সুযোগ্য ভাই সেকালের লক্ষণ ভাই এর মতোন ই পিতৃক ভিটে ছেড়ে দিদির সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে এসে বসবাস শুরু করতে লাগলেন দিদির ই স্কুল এর খুব কাছে। অচিরেই দুই ভাই বোন তাঁদের স্বভাব সুন্দর প্রকৃতি দিয়ে চারপাশের মানুষ জনকে এক মায়ার বন্ধনে বেঁধে ফেললেন, শুরু হলো তাঁদের অপরকে স্বাক্ষর করার অভিযান। আশপাশের মানুষ জন দের ভালো রাখার প্রচেষ্টা, গ্রামের সবাইকে শিক্ষার আলো দেখানো, আর সেই আলোতে কিছুটা হলেও উন্নয়নের হাওয়া লেগেছিলো বৈকি, আমাদের ওই ছোট্ট রঘুদেববাটী বলে নলপুর এর জায়গাটাতে। অবশ্য ছোট ছোট ওই দু ভাই বোন এর সেই অভিযানের মূল কর্ণধার ছিলেন, একজন অত্যন্ত শ্রধ্যেয় মানুষ (পরবর্তী কালে আমার পিসেমশাই), যাঁকে ওই এলাকার আপামর জনতা মাষ্টারমশাই বলেই চিনতো।
কিছুদিন পরে তাঁদের সংসারে আরো একজন এলেন, আমার পিসির সুদর্শন ভাইটিকে ভালোবেসে, স্বইচ্ছাতে, সরকারি নার্স এর চাকরির চিঠি লুকিয়ে, কিছুটা মা বাবাকে জোর করিয়ে রাজি করিয়ে, হাজারটা তথাকথিত সুপাত্রকে হেলায় সরিয়ে, ভাই বোনের কিছুটা অগোছালো অভাবের সংসারে বিয়ে করে। অভাব এই কারণে তখন স্কুল টিচেরদের এখনকার মতন স্বচ্ছল মাইনে ছিলোনা। আর চাকরির চিঠি লুকিয়ে এই কারণে যে নার্সের ওই চাকুরীতে তখন তিন বছরে বিয়ে না করার শর্ত ছিল। বোকামি? তা হয়তো বা, কিন্তু পৃথিবীতে এখনো ঐরকম কিছু বোকা আছে বলে এই পৃথিবাটা এখনো ফলে ফুলে রঙে রসে ভোরে আছে। যাই হোক, তিনিতো এলেন, চুঁচুড়ার ইলেক্ট্রিক আলো, যানবাহনের আওয়াজ আর শহুরে আর পাঁচটা সুযোগ সুবিধে ছেড়ে, একেবারে খোদ গ্রাম বাংলায় দু ভাই বোনের কোনোরকমে চলা, অগোছালো এক সংসারের মধ্যে। বাপের বাড়ির আদুরে গাছে চড়া মেয়ে অভাব কাকে বলে জানতো, আর জানতো সেই অভাবে কিকরে স্থির থেকে সংসার চালাতে হয়, ফলে হাল ধরতে দেরি হলোনা। শুধু যে হাল ই ধরলো তাই নয়, একদম গুছিয়ে, শ্বশুর শাশুড়ি স্বামী ননদ নন্দাই নিয়ে সবার প্রিয় পাত্রী হয়ে সংসার শুরু করলেন। ততদিনে চাকুরীর চিঠিটি ধরা পরে গেছে। সবার থেকে জুটেছে একরাশ বকুনিও। তিনি বললেন ভাবছো কেন চাকরি নিনি তো কি হয়েছে, নার্সিং ট্রেনিং আর Dr Nun এর কাছে করা OT experience ব্যর্থ যেতে দেব নাকি? সেই গ্রামের মধ্যে তখন ডাক্তার বদ্যির ভীষণ অভাব। গ্রামের অসহায় বিনা চিকিৎসাতে মারা যাওয়া মানুষ গুলোর কাছে তাই সেই নববধূ হয়ে উঠলেন এক অনন্য জায়গা, যেখানে দিন নেই রাত নেই যখন ইচ্ছে ছেলে কোলে করে আসা যায়, ডাক্তার বাবু আসার আগে প্রিলিমিনারি ফার্স্ট এইড টা তো পাওয়া যাবে। ফলে মাথা ফাটা থেকে ডেলিভারি সব এ তেই ডাক আসতে লাগলো। আর এইভাবে ঠেকনো দিতে দিতে বুদ্ধিমতী বধূটি তাঁদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার বোধ, খাবার ঢাকা দিয়ে রাখা, বাচ্চার যত্ন নেওয়া, এইসমস্ত basic hygene concept .। সাথে সাথে চলতে থাকলো সংসার কে একটা সত্যিকারের সংসারের রূপ দেওয়া। বাইরে থেকে কেউ এলে অবাক হয়ে যেত। ঘরের মধ্যে আসবাবের প্রাচুর্য্য নেই, হয়তো বা আছে কিছু অভাবের ই ছোঁয়া, কিন্তু তার মধ্যেও কি পরিপাটি বিছানার চাদর। টেবিল এর ওপরে ফুলদানিতে একরাশ ফুল। শুনেছি প্রথম দিকে ওই টেবিল টাও যখন ছিলোনা, তখন মাটি আর কিসব দিয়ে যেন নিজেই টেবিল বানিয়ে ফেলেছিলেন, পাউডার এর কৌটোতে জল দিয়ে তাতে রাখা হতো কখনো কৃষ্ণচূড়া, কখনো গন্ধরাজ। দেখতে দেখতে দিন এগোয়। সেদিনের সেই নববধূ সমাদৃত হন মাতৃত্বে। আমার মা। ছুটির দুপুরবেলা গুলোতে যখন মা স্নান সেরে চুল খুলে চওড়া করে সিঁদুর পরে পরিপাটি করে ভাত বাড়তে বসত, আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম মুখের দিকে। আর মনে মনে বলতাম আমার বাবা আর মা দুজনে যেন ঠিক ঠাকুরের মতন। ভরা সংসারে মা এর তখন অনেক কাজ। একাধারে নার্স, শিক্ষিকা, মা, মামীমা, লেখিকা, আঁকিয়ে সমস্ত কিছু। শ্বশুড় শাশুড়ির শরীর নিয়েও তাঁর ছিল মহা সজাগ দৃষ্টি। আমার ঠাকুরদা তাঁকে নিজের মেয়ের থেকেও বোধয় বেশি ভালো বাসতেন , এই ছবিটা আমার হালকা ভাবে মনে পরে যে দাদু আমাদের নখ কেটে দিতে দিতে বাবাকে আর মা কে ডাকছেন, বৌমা এসো তো তোমাদের নখ গুলো কেটেদি। এ হেনো দাদুও চলে গেলেন, তখন আমি ক্লাস ২ তে, এক সপ্তাহের অন্তরে চলে গেলেন পিসেমশাই ও। যাঁকে বাবা মা দেবতা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন। সেই সময় যখন লোকে আমার পিসতুতো দাদা আর ভাই কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলছে ওরে তোদের কি হলো রে, আমার মা শক্ত হাতে চোখের জল মুছে নিয়ে, বাবা পিসি সবাইকে সামলে নিয়ে আমাদের চার ভাই বোন কে একসাথে মানুষ করেছেন। মা কিন্তু কখনো বলেনি তোদের কি হলো, মা বরং বলেছে তোদের মানুষ হবার সুযোগ এসেছে। তোরা যাদের ছেলে, তাদের মতন নিজেকে তৈরি করতে হবে। ছোটবেলায় হয়তো সেই কারণেই মাকে আমরা চার ভাই বোনে পেয়েছি ভীষণ কড়া একজন মানুষ হিসেবে। নিয়মে বাঁধা ছিল আমাদের জীবন। শুধু ভালো পড়াশুনো নয়, মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। এতটুকু রুডলি কথা বলার সাহস ছিলোনা কারোর। বাড়িতে অনেকটা সময় কাটতো আমার একা একা। মা মনের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন ছবি আঁকা, ডাইরি লেখা, নিজের কাজ নিজে করার অভ্যেস। নিজে নিজেই রুটিন বানাতাম গোটা দিনের। কখন তার মধ্যে নিজেকে ফিট করে ফেলতাম। দিদি অবশ্য একটু অন্যরকম ছিল, ওর ছিল গল্পের বই পড়ার নেশা। আমাকে ক্ষেপাত পুরো ল্যাজবিশিষ্ট ভালো মেয়ে। বাবা মা যা বলে তাই করে। রুটিন বানাতে কে বললো রে তোকে। সত্যি ই কেন যে আমার রুটিন এত ভালো লাগতো জানিনা। মাঝেমাঝে মা এর অত্যধিক কড়া শাসনে দম বন্ধ হয়ে আসতো। কেমন সবাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারে, দেরি করে বাড়ি ফেরে, অথচ আমাদের ক্ষেত্রে তো সেই নিয়ম নেই। মা এর ছিল সব কিছু হিসেবে বাঁধা। সেই কড়া শাসনের একটা নমুনা দিচ্ছি, আমি তখন higher secondery পরীক্ষা দিচ্ছি। লাস্ট দিনে মা যাবেনা, আর আমি ফুচকা খেয়ে ফিরবো। ডিল কমপ্লিট। মা ও রাজি। ফুচকা খাবার অনুমতি তখন ছিল ঠিক বছরে দুবার। একবার half yearly আর একবার annualy . যাই হোক, ফুচকাও খেলাম, গল্প ও করলাম। বন্ধু বান্ধব হাসি ঠাট্টায় যে সময়ে ফিরি, তার থেকে দেরি হয়ে গেলো প্রায় ৪০মিন. ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরলাম। এসে দেখি গেট এ তালা দেওয়া ভেতর থেকে মা বলছে যাও যেখানে ছিলে থাকো সেখানেই। পাড়ার লোকে হাসতে হাসতে দেখে দেখে গেলো রঞ্জিত বাবুর সাত চড়ে রা না কারা, তথাকথিত ভালো ছোট মেয়েটি স্কুলের শাড়ি পরে, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ভ্যা ভ্যা করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। অবশেষে বাবার হস্তক্ষেপে ভেতরে ঢোকা। ছোটবেলাতে অনেক অভিযোগ ছিল মায়ের প্রতি। মনে হতো মা তাদের স্কুলের ছেলে মেদের বেশি ভালোবাসে, কতবার মনে হয়েছে, সবার মা এরা কেমন বলে আমার মেয়ে তো কিছু কাজ করতে পারেনা, বা ও এক গ্লাস গড়িয়ে খেতে পারেনা। এইসব। সেখানে আমার মা এর ছিল কড়া নিয়ম। আমাদের বলা হতো তোমরা কেউ গাছতলাতেও থাকবেনা আবার হোটেলেও থাকবেনা, থাকতে হবে তোমাদের সংসারেই অতএব, আমি ইটা পারিনা ওটা পারিনা বা ইটা খাইনা, ওটা খাইনা, এইসব ন্যাকামো একদম করবেন আমার কাছে। আমরা দুবোনেই যখন ক্লাস সিক্স, জেনে গেছিলাম কিভাবে ডিম্ ভাজতে হয়, চা করতে হয় এইসব। রান্না, পড়াশুনা, আঁকা আবৃতি সব কিছু বাড়িতেই করেছি। আর একটা জিনিস শিখেছিলাম মার্ কাছে, যা আমাকে আমার বর্তমান দৈনন্দিন জীবনে ভীষণ সাহায্য করে। সেটা হলো মায়ের পরিপাটি বোধ, শুধু কাজ করলেই হবেনা, সেটাকে সুন্দরভাবে সুষ্ঠু ভাবে করতে হবে। ভাত বাড়া থেকে শুরু করে কিভাবে খাবার পরিবেশন করতে হয় বা কিসের পরে কি পদ কিভাবে সাজিয়ে রাখতে হয়, এসব মায়ের নিজের হাতে শেখানো। এমনকি বাইরে থেকে বাড়ি ঢুকে পায়ের জুতো খুলে সেটা জায়গায় রাখলাম নাকি তাকে ছড়িয়ে ফেলে রাখলাম সে ব্যাপারে ও মায়ের দৃষ্টি ছিল সজাগ। আর একটা ব্যাপারে মা ছিলেন সেকেলে, সেটা ছিল ছেলে মেয়ের অবাধ মেলামেশার ব্যাপারে মায়ের ছিল প্রবল আপত্তি। তবু, বড় হওয়ার সাথে সাথে বন্ধু বান্ধব এর সংখ্যা বাড়তে থাকে আমাদের, মা এর কড়া নিয়ম ছিল দুটোতে, এক রাস্তায় দাঁড়িয়ে কারোর সাথে গল্প করা চলবেনা আর দুই যদি কথা বলার দরকার ই থাকেন তাহলে বাড়িতে সবার সাথে সবার মাঝেই যা বলার বলতে হবে। তখন নতুন বন্ধু, নতুন প্রেম, সবসময় ই আবডাল খোঁজে মন। এমন সময়ে এহেন শাসনে যে সদ্য কিশোর কিশোরী মন গুলো বিদ্রোহী হয়ে উঠতো, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু আজ যখন পেছনে ফিরে তাকাই, বুঝতে পারি, সেদিনের সেই শাসনের মাহাত্ব। এইভাবে মা সামনে থেকে বা না থেকে কিভাবে আর কিকরে যেন আমাদের মধ্যে এক কর্মঠ, সক্রিয় , রুচিশীল আর শিক্ষিত মনন তৈরি করে দিয়েছেন, বুঝতেই পারিনি তখন। মাথার মধ্যে সবসময় ঘুরতো নিজের পায়ে দাড়াঁতে হবে, কিন্তু সেটা মাথা উঁচু করে আর শিক্ষাই হচ্ছে তার একমাত্র উপায়। বাড়ির বাইরে থাকতে হলো পড়াশুনার জন্যে, তখন দেখলাম কিভাবে মা এর শাসন অলক্ষ্যে আমাদের ঘিরে রাখে, অবাক হয়ে যেতাম নিজেকে দেখেই যখন দেখতাম মা সামনে নেই তবুও দু পা হেঁটে সিনেমা হল এ যেতে পারছিনা। ফোন করে অনুমতি নিয়ে তবে যেতাম। সত্যি বলতে কি মা কে একটু ভয় এর চোখেই দেখতাম। লেপটে থাকতাম আমি বাবার সাথে। সবসময় বাবা, বাবা আর বাবা। তবে পরে বুঝেছি, আমার বাবাও তাঁর সবটুকু মাহাত্ব নিয়ে কখনো হয়তো ঐভাবে থাকতে পারতেননা। যদি না মা এর তাঁর পাশে থাকতো। সেই বাবা যখন আমাদেরকে একেবারে অসহায় করে দিয়ে চলে গেল, সমস্ত দুনিয়া আমার চোখের সামনে সত্যি ই দুলে উঠেছিল। কথার কথা নয়, সেদিন বুঝেছিলাম পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া কাকে বলে। আমার মা কিন্তু নিজের স্বার্থের জন্যে একবারও আমাকে আটকে রাখেনি, একমাসের মধ্যে আমাকে নিজে সঙ্গে করে ইন্টারভিউ দিতে দিল্লী নিয়ে আসে। আর চার মাস পার থেকে একা আমার বাবার স্বপ্ন কে পূরণ করার কাজে নিজেকে নিমজ্জিত করে। আমার আর মা এর শুরু হয়েছিল সেই সময় থেকে একেবারে অন্য এক জীবনযাত্রা। আমাকে বাবা সত্যি ই প্রায় তুলো য় মুড়ে বড় করেছিল। সেখান থেকে বাস্তবের কাঠিন্য আমাকে কিছুই দেখতে হয়নি। পেতেও হয়নি তার ছোঁয়া। দায়িত্ব কাকে বলে জানতামনা। কিন্তু দেখলাম আমিও দায়িত্ব নিতে পারছি, অসুবিধে হচ্ছেনা সেগুলোকে সুষ্ঠু ভাবে পালন করতে আর আমাকে, মাকে এসবকিছুর মধ্যে সামলে রেখেছিলেন অন্য আর পাঁচজনের সঙ্গে আরো একজন মহিলা, সে হলো আমার বড় মাসি।
সবাই বলে আমি নাকি মাসির মতো শান্ত। হাঁ এই মানুষটিও আমার পিসিমার্ মতন ই শান্ত প্রায়। শুধু যে শান্ত তাই নয়, ভীষণ স্বপ্ন আর আবেগ প্রবণ। গাছের কচিপাতা দেখলে আমার যেমন ভালোলাগায় চোখে জল ভোরে যায়, আমার মাসিটিও তেমন ই। বাবা চলে যাবার পরে যখন কিছুতেই নিজেদের স্থির রাখতে পারছিলামনা, এই মানুষটি তখন কখনো গীতার উধৃতি তুলে, কখনো রামকৃষ্ণ সারদা মা এর উদ্ধৃতি তুলে কখনো বা বাবার নিজের বলা কথাকেই আবারো অন্যভাবে তার মানে বুঝিয়ে দিয়ে আমাদেরকে শান্ত করেছিল। দূরত্ব সত্যি ই কিছু বাধা হতে পারেনা, এটা মাসির থেকেই শেখা। মাসি ই বুঝিয়েছিল শিখিয়েছিলো কিভাবে নিজের মনের সবটুকু ওই ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে উজাড় করে দেওয়া যায়, কিভাবে যা আমাদের অধরা বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, তা আসলে আমাদের কাছেই থাকে। ইচ্ছে করলেই তাকে ছোঁয়া যায়, তার বোধ করা যায়, তার অনুভূতি নিয়ে বাঁচা যায়। শুধু সেই ভাবনাটাকে অন্তরে প্রতিষ্ঠা করে রাখতে হয়। আর এই মানুষটার কাছ থেকে দেখেছি অসীম ভালোবাসার অকুন্ঠ বোধ। মাসি নিজে মুখে কখনো বলে দেয়নি কিন্তু তার ওই ধীর স্থির ভাবে চলা, সবার জন্যে সত্যি কারের ভাবা, শুধু আমি আর আমার না করে, সবার মধ্যে বাঁচা, কারোর সাথে খারাপ ভাবে কথা না বলা দেখে আমি নিজেই নিজের জীবনে শত প্রতিকূলতা আর রাগের মধ্যেও নিজেকে স্থির শান্ত রেখে এক ই ভাবে কথা বলার চেষ্টা করি। মাসি নিজে অসুস্থ। তবু শত অসুস্থতার মধ্যেও নিজের মা আর শাশুড়িকে একসাথে রেখে সেবা করে যেতে ভোলেনি। দিদা আর ঠামু দুই বৃদ্ধাই প্রায় নব্বই এর ঘর ছুঁই ছুঁই করে ইহলোকের যাত্রা সমাপ্ত করেন। আর মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত দেখতাম মাসিকে তাঁরা কিভাবে চোখে হারান। পেশায় শিক্ষিকা আমার এই মাসির দুনিয়া দেখার খুব শখ। ঘুড়েছেও কম নয় একসময়। কিন্তু শরীরের জন্যে আজ সে একেবারেই শয্যাশায়ী। এই লেখাটা মূলত তাঁকে উজ্জীবিত করার জন্যেই আমার লেখা। এই বোনঝিটি তাঁর খুব কাছের। কত সিক্রেট প্ল্যান তাদের, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন। সে পঁচিশে বৈশাখ হোক বা নাহোক। এই দিল্লিবাসীনি যেদিন ই আসবে মাসির কাছে, বাড়ির ছাদে সেদিন বসবে গানের আসর। ফুলে ফুলে সাজানো হবে চারিদিক। গন্ধরাজ, জুঁই, বেল, রজনীগন্ধা। আর চাঁদনী রাত হতে হবে সেদিন। আমাদের আর এক বন্ধু এর সঙ্গী। অল ইন্ডিয়া রেডিওর চৈতি, আমার এক বোন। আমরা দুজনে মিলে সেদিন সবকিছু সাজাবো যতনে, অমূল রতনে আর দেখবো এভাবেই অধরা মাধুরী কে বাঁধা যায় কিনা ছন্দ বন্ধনে। জীবনে আমার এই মাসির মতন এইরকম কিছু মানুষের খুব দরকার যারা যে কোনো পরিস্থিতেই ভেঙে না পরে, আমাদের চারপাশের প্রকৃতির রূপ রং রস মাধুরী আরো বেশি করে গ্রহণ করে তার মধ্যে জীবনের রসদ খুঁজে পায়। এদের দেখে আমরা, যারা অল্পেই অস্থির, দিশেহারা, তারা নিজেদের আবার স্থির করতে পারি। বাঁধতে পারি। আর মাসির কথাতেই মাসির সম্পর্কে বলা শেষ করে বলি, ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে দুহাত জড়ো করে আবারো বলতে পারি, ঠাকুর আমায় স্থির রেখো, আমি যেন দিকভ্রান্ত না হয়ে পড়ি, নিজেকে যেন সত্যি আর সুন্দরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, এই জোড় দাও মনে। কি সুন্দর এই চাওয়া, বাড়ি নয়, গাড়ি নয়, বিষয় এর নেশা নয়, এক নিষ্কলুষ চাওয়া আমি সবসময় আমার পরিবারের মধ্যে দেখেছি। যে চাওয়ার বোধ, পারিপার্শিক বৈষয়িক সকল চাওয়ার বোধ থেকে অনেক ওপরে আমাকে উন্নীত করেছে। প্রার্থনা করি ঘরে ঘরে এইরকম মাসি পিসি মা এর উদাহরণ তৈরি হোক, আরো।
এর পরে আমার জীবনের চতুর্থ আর এক গুরুত্বপূর্ণ মহিলাকে আমি পাই, তিনি হলেন আমার শাশুড়িমা। খুব গর্ব করেই বলতে পারি যে শাশুড়ি বৌ এর সম্পর্ক সাধারণত যেমন তিক্ত হয়, সেইরকম আমাদের কোনোদিন ই হয়নি। বরং একটা মিষ্টি সম্পর্ক যেখানে মা তার মেয়েকে শাড়ি কেনার আবদার করতে পারে বা কেন তার বৌমা টি সাজেনা এমন অনুযোগ করতে পারে। ছেলে বৌ এর কাছ থেকে ফেরার সময় চোখের জলে ভাসায় আবার নিজেকে ছেলেকে হাঁরে , ও কত কাজ করে তুইও তো একটু ওকে হেল্প করতে পারিস এমন বলতে পারে। এ হেন্ মানুষকে শ্রদ্ধা না করে আমি পারিনা। বাইরে তিনি খুব একটা যাননি। ঘরের ভেতরেই তাঁর দুনিয়া শুরু ও শেষ হয়েছে, তবু এমন আধুনিক মনষ্কতা কজন মা এর মধ্যে পাওয়া যায়, আমি জানিনা, তবে আমি তো এই একজনকেই দেখেছি। এনার কাছ থেকে আমি শিখেছি সংসারের মূলমন্ত্র- ভালোবাসা। কিভাবে এই একটা জিনিসের ভিত্তি প্রস্তর দিয়ে সমস্ত সংসার নামক ইমরাতটিকে সযত্নে সোজা রাখা যায় সেটা। কার কি খাবার কখন দরকার, কখন ভালোলাগে বা কিভাবে তাকে সেটা ঠিক সময়ে দেওয়া যায়, এসমস্ত এমন ভাবেই তিনি বুঝে যান বা এতবছর বুঝে গেছেন যার ফলে তাঁর ছেলেরা কখনো খিদে কি বা ভালো খাবার এর অভাব কাকে বলে তার সেই বোধটা থেকেই বঞ্চিত থেকে গেছে।
আর সবার শেষে বলি আমার ছেলেবেলার সাথী, আমার সব কাজের ভাগীদার আমার থেকে মাত্র পাঁচ বছরের বড় আমার সহোদরা। আমার দিদির কথা। আমাদের বাড়ির প্রথম সন্তান। স্বাভাবিকভাবেই খুব ই আদুরে। ফর্সা টুকটুকে বই মুখে করে বসে থাকা, জেদি সুন্দরী সেই মেয়ে, যাকে জীবন সঙ্গিনী করে পাবার জন্যে আক্ষরিক অর্থেই হাপিত্যেশ করে বসে থেকেছে বহুজন। কিন্তু ওই যে, পারিবারের শিক্ষায় সেদিকে কোনোদিন ঘুরে তাকানোর কথা মনেও আসেনি। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে সম্পূর্ণ অন্য আদর্শবাদী এক পরিবার এর সাথেই যখন বৈবাহিক সূত্রে বাঁধা পারলো সে, এবং পদে পদে যখন দেখি এতদিনের শিক্ষা সম্মান ছোটথেকে বড় হবার সেই আদর্শবোধ গুলো পদে পদে দলিত হচ্ছে, হচ্ছে চুরমার। তখন আমার বহুবার ভীষণ রাগ হয়েছে, মনে হয়েছে চিৎকার করে বলি, দিদি এখুনি চলে যায় তুই আমার কাছে। কিন্তু না ওই যে বলেছিলামনা? জেদি? সেই জেদী আমার দিদি শিরদাঁড়া সোজা রেখে, হেরে না গিয়ে লড়াই শুরু করলো। কিন্তু লড়াইটা কিসের? আজকের দিনে আমাদের জেনারেশন খুব কষ্টে যা ভাবতে পারে, তার লড়াই, বলতে গিয়ে আমার হাসিও পাচ্ছে, রাগ ও হচ্ছে। একটা চরম বিপরীত আদর্শবাদের পরিবারকে তাদের মতো করে ভালোবাসে, ভালো থাকার লড়াই। তার জীবন যাত্রা থেকে আমি বুঝেছি সহ্য করা কাকে বলে, বুঝেছি প্রতিটা মানুষের নিজের স্বত্বা বাঁচিয়ে রাখা কতটা দরকার। দেখেছি কিভাবে একজন মেয়ে, শুধুমাত্র নিজের ওপরে ভরসা রেখে আর সংসারের ওপর মায়ায় সব কিছু সহ্য করে নিতে পারে। সবকিছু সহ্য করা ভুল কি ঠিক সে তর্ক থাক নাহয় এখন। হয়তো ঠিক নয়, হয়তো বা....জানিনা। তবে এইরকম মানুষ গুলো এখনো আছে বলেই অলিভিয়া স্পিনোলা রা বলতে পারে, তোমরা ? ইন্ডিয়ান মেয়েরা? সবাই এত নরম? সবার এত সহ্যশক্তি? তোমরা স্বামী সন্তান সংসারের জন্যে নিজেদেরকে নিঃশব্দে বলি দিতে পারো? আর আমি মুখটিপে হেসে বলতে পারি, এ তো কিছুইনা স্পিনোলা, আমাদের মেয়েরা আরো অনেক অনেক কিছু পারে, যা দিয়ে তারা বিশ্ব সংসারকে এক অন্যান্য জোড় এ বেঁধে রাখতে পারে, হিংসা নয়, রাগ নয় ঝগড়া নয়। শরীরী আবেদন নয়, ভালোবাসার অভিনয় নয়। সত্যিকারের প্রেম, সত্যি ভালোবাসা, অমোঘ কর্তব্যবোধ আর মায়া। এ আমাদের রক্তে , মজ্জায়।
পরিশেষে বলি, আমি খুব সাধারণ বাড়ি থেকে বড় হয়ে ওঠা একজন মানুষ। এই দিল্লির বুকে চারিদিকে যখন অজস্র অসহিঞ্ষুতা আর মূল্যবোধের অভাব দেখি, তখন খুব বেশি করে অনুভব করতে পারি, সঠিক বোধ নিয়ে মানুষের মতো করে বড় হবার কি অর্থ। সেই অর্থে আমি মানুষ হতে পেরেছি কিনা জানিনা, কিন্তু চারপাশের যে সব মানুষগুলোর জীবনাদর্শ আমাকে এখনো হয়ত বা ভবিষ্যতেও মাথা উঁচু করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে, খুব ইচ্ছে করলো তাদের সেই জীবনাদর্শের কথা সবার সামনে আনতে। কারণ এখন সময় আমাদের দেখে, শিখে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের এগিয়ে চলার। ওই যে কথায় আছেনা "If you want to change the world, start off by making your bed" তাই সেকথা মনে রেখেই আমার ঘরের আঙ্গিনা থেকেই শুরু করলাম মূল্যবোধের দৃষ্টান্ত। মানুষ হবার প্রথম বুনট।
তবু স্মৃতির ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে তুলে বয়সের ক্রমানুসারে তাকে একটু এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাজিয়ে নিলে প্রথমেই মনে আসে এক মাথা সাদা চুলে ভরা সবসময় মুখে একটা মিষ্টি হাসি মাখা পুতুল পুতুল এই মানুষটির। আমার পিসিমা। আমি শুধু পিসি বলেই ডাকি অবশ্য। অবিশ্বাস্য কথা কি জানেন, এই মানুষটিকে আজ পর্যন্ত কেউ কখনো রাগা তো দূরের কথা, উঁচু গলায় কথা বলতেও শোনেনি। পিসির কথা মনে হলেই তাই আমার মাতা বসুধার কথা মনে হয়। না এতটুকু বাড়িয়ে বলছিনা। ধরিত্রীর মতোই অসীম সহনশীলতা তাঁর। আলাদা করে সেরকম বিশেষ করে বকে ঝকে কিছু শেখাতে আসেননি উনি। তবে পিসির ওই ধীর কথা, স্থিরতা, ধৈর্য্য, স্নেহ মায়ায় ভরা কাজ, অকুন্ঠ ভাবে ভালোবাসা এইসব কখন যে কিভাবে অজান্তে আমার ভেতরে আমার ই অজান্তে একদম গেঁথে গ্যাছে বুঝতে পারিনি। আর ও একটা জিনিস এর জন্যে এই মানুষটা সবার শ্রধ্যেয়। সেটা হলো জানার তৃষ্ণা আর মনসংযোগ। এখনো সারাদিন এর সব কাজ নিজে হাতে করার পরে , রাতের বেলায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পরে , বই পরে , ভূগোলের ম্যাপ দ্যাখে , তারপরে শুতে যায়। আমি যখন বকি খুব কেন রেস্ট নাওনা এসব বলি, তখন বলে, সময় তো কমে আসছে, যতটা জেনে বুঝে নেওয়া যায়, কতটা তো এখনো বাকি। এই হলো আমার পিসি। আমরা যারা এই প্রজন্মের facebook , tinder, বিশ্ব সংবাদ এর দুনিয়াতে পুরো একটা পাতা টানা মন দিয়ে পড়ার ধৈর্য্য রাখিনা, সেই খানে ৭২ বছরের এই মানুষটি এখনো রান্না করে, যত্ন করে বাগান করে, গাছ গুলোকে নিজের ছেলে মেয়েকে মানুষ করার মতো করেই বারো করে, ফুল ফোটায়, আমার আদরের কুট্টুস মানে ঘঁটুবুড়ি কে দেখা শোনা করে, ছেলে বৌ নাতনি নিয়ে সংসার এর হাল ধরে শুধু নয়, শক্ত হাতে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পিসি মানেই সাদা হাস্যময় একটা মুখ, কোনো বিরক্তি নেই, কারোর কাছে কোনো প্রত্যাশা নেই, শুধু ভীষণ কৰ্তব্য বোধ আর ভালোবাসা। তাঁর এই ভালোবাসা থেকে ছেলে মেয়ে ভাইপো ভাইঝি থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী, রাস্তার কুকুর বিড়াল কেউ ই কখনো বঞ্চিত হয়নি। এই প্রসঙ্গে অনেক দিন আগের একটা কথা খুব এখানে লিখতে ইচ্ছে করছে। আমি তখন মাস্টার্স করছি gwalior থেকে। বাড়িতে থাকিনা। বাবা, মা ও নিজের নিজের কাজের জগতে ব্যস্ত। পিসি সদ্য retire করেছে, দু দিনের জন্যে খুব সম্ভাবত আমার ছোট পিসিমণির বাড়ি গেছিলো বেড়াতে। বাড়িতে ছিল তখন দাদা আর ভাই। দুজনেই বড়ো, ফলে মা বাড়িতে না থাকায় কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়, বরং নিজের পছন্দ মতো খাবার রান্না করে খাওয়া যাবে, এতে বেশ আনন্দই ছিল এদের মনে। অসুবিধে কারোর ই কোথাও হবার কথা ছিলোনা। কিন্তু অসুবিধে হয়েছিল একজনের। আমাদের পাশের বাড়িতে কোনো এক সময় শখের বশে একটি রাস্তার কুকুরকে পোষা হয়েছিল, পরে তাঁরা একটি বড় আলসেশিয়ান পুষলেন এবং যথারীতি বিদেশী অতিথির সামনে বুড়ো দেশী পশুটি ভীষণ ভাবে ব্রাত্য লাগলো। ওনারা তাঁকে বিদায় পুরোপুরি না দিলেও, চলে গেলে যে ভালো হয় সেটা বুঝিয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি। অবহেলা বোঝার ক্ষমতা সবার ই বোধহয় আছে, সেই অবহেলা এমন অভিমান এর জন্ম দিলো যে সারমেয় টি একটু একটু করে প্রথমে কম করতে করতে একেবারেই ওই বাড়ির অন্ন ত্যাগ দিলো। আমাদের বাড়িতে তখন আমার ছোটবেলার সাথী কুট্টুস, আদুরে সবার চোখের মণি। এ হেনো কুট্টুসের সাথে ওই অভাগীর কিভাবে গড়ে উঠলো এক অলিখিত সম্পর্ক। কুট্টুস থাকতো গেট এর এপারে আর ও থাকতো গেট এর ওপারে, কুট্টুস কে খাবার দেবার সময় হলে, মা বা পিসির কেমন একটা খারাপ লাগতো, ওকেও তখন দেওয়া হতো, প্রথম প্রথম সেই খাবার ও কিন্তু ও মুখ দিতোনা, পরে কিজানি দু বন্ধুর কি কথা হলো, কুট্টুস খেত এদিকে আর ও খেত ওদিকে। আস্তে আস্তে গেট এর barrier গোছানো হলো, কুট্টুসের নতুন বন্ধু স্থান পেলো বাড়ির ভেতরেই। এভাবে চলতে থাকলো, তবে পুরোনো প্রভুদেরও ও ভোলেনি, কর্তব্য করতে যেত প্রতিদিন ওখানে, দেখে আবার চলে আসতো। বেশ কয়েকবছর এভাবে কাটছিলো, বয়সের জন্যে ধীরে ভুলুর জীবনীশক্তি কমতে থাকে, অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বেশ। পিসি না থাকাকালীন অসুস্থতা খুব বেশি বাড়ে। কিন্তু শুধু বুঝি ওই মমত্ব মাখা হাতের আদরটার জন্যে শেষ নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করতে পারছিলোনা। যেদিন পিসি ফিরলো, সেইদিন ই ভুলু কোনোরকমে টলতে টলতে গেট এ এসে দাঁড়ালো, কুট্টুস এর অদ্ভুত ডাকে পিসির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো পিসি, ভুলু টলতে টলতে এসে দাঁড়ালো, দাঁড়ানোর শক্তিও ছিলোনা, পিসি ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই ও শুয়ে পড়েছিল আর অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে তারপর চিরদিনের জন্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। জীবনে অনেক ঘটনাই থাকে আমাদের জানার আমাদের বোঝার বাইরে, এও সেরকম ই একটা ঘটনা যেখানে প্রিয় মানুষের হাতের ছোঁয়া টার জন্যে ছিল একটা অবলা প্রাণের অপেক্ষা।
এই হচ্ছেন আমার পিসি। একদম বইয়ের পাতাতে যেমন পিসিদের গল্প শোনা যায় ঠিক সেরকম। ছোটবেলার রথ, চড়ক এর মেলা বা ঠাকুর দেখতে যাওয়া আমাদের ছোটদের এনার ই হাতে ধরে হয়েছে। সেই ছোটরা এখন সবাই অনেক বড় হয়ে গেছে , ভাইঝি রা তাঁর প্রাণের খুব কাছের। সেই দুই ভাইঝি ও একজন থাকে কানাডায়, একজন দিল্লী। বড় টির কথা পরে বলছি কিন্তু ছোট টিও বিয়ের পর থেকে এতই সংসারী হয়েছেন যে দুদণ্ড বাড়িতে এসে পিসির কাছে বসে কথা বলার তেনার সময় হয়না। একটা কথা খুব মনে পড়ছে এখন লিখতে গিয়ে, সেবারে যখন বাড়ি গেছিলাম, পিসি কেমন ভাবে একটা বলেছিলো, একটু আসবি আমার কাছে, কথা বলবো। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠেছিল। এখনো উঠলো। এইসব পিসি মাসি মা দিদিদের আদরের আবডালে বড় হয়ে ওঠা ছেলেবেলাটা যেন বারো বেশি নিশ্চিন্তে কেটেছে। তবু ওই যে মায়ার ওই বাঁধন ই আবার শিখিয়েছে সবাইকে বেঁধে রাখার মন্ত্র। আর সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই কর্ম কর্তব্যে অনড় থেকে এগিয়ে চলা। আমার বাবা পিসির ছোটবেলা আমাদের মতো সুখের আবডালে মোড়া ছিলোনা, সবদিন পেট ভর্তি ভাত ও সবসময় যে জুটতো তা নয়, শুধু আধপেটা খেয়ে বা না খেয়ে একটা কথাকেই দুভাই বোনে পণ করেছিলেন যে পড়াশুনা টা চালিয়ে যেতে হবে। গিয়েছিলেন। তখন নকশাল আমল। আমার পিসিমা সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে স্কুল কলেজ এর গন্ডি পেরিয়ে ইতিহাসের শিক্ষকতা নিলেন। কিন্তু নকশাল আমলের ওই উত্তেজনার মধ্যে একা যাতায়াত করার অসুবিধের কারণে তাঁর সুযোগ্য ভাই সেকালের লক্ষণ ভাই এর মতোন ই পিতৃক ভিটে ছেড়ে দিদির সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে এসে বসবাস শুরু করতে লাগলেন দিদির ই স্কুল এর খুব কাছে। অচিরেই দুই ভাই বোন তাঁদের স্বভাব সুন্দর প্রকৃতি দিয়ে চারপাশের মানুষ জনকে এক মায়ার বন্ধনে বেঁধে ফেললেন, শুরু হলো তাঁদের অপরকে স্বাক্ষর করার অভিযান। আশপাশের মানুষ জন দের ভালো রাখার প্রচেষ্টা, গ্রামের সবাইকে শিক্ষার আলো দেখানো, আর সেই আলোতে কিছুটা হলেও উন্নয়নের হাওয়া লেগেছিলো বৈকি, আমাদের ওই ছোট্ট রঘুদেববাটী বলে নলপুর এর জায়গাটাতে। অবশ্য ছোট ছোট ওই দু ভাই বোন এর সেই অভিযানের মূল কর্ণধার ছিলেন, একজন অত্যন্ত শ্রধ্যেয় মানুষ (পরবর্তী কালে আমার পিসেমশাই), যাঁকে ওই এলাকার আপামর জনতা মাষ্টারমশাই বলেই চিনতো।
কিছুদিন পরে তাঁদের সংসারে আরো একজন এলেন, আমার পিসির সুদর্শন ভাইটিকে ভালোবেসে, স্বইচ্ছাতে, সরকারি নার্স এর চাকরির চিঠি লুকিয়ে, কিছুটা মা বাবাকে জোর করিয়ে রাজি করিয়ে, হাজারটা তথাকথিত সুপাত্রকে হেলায় সরিয়ে, ভাই বোনের কিছুটা অগোছালো অভাবের সংসারে বিয়ে করে। অভাব এই কারণে তখন স্কুল টিচেরদের এখনকার মতন স্বচ্ছল মাইনে ছিলোনা। আর চাকরির চিঠি লুকিয়ে এই কারণে যে নার্সের ওই চাকুরীতে তখন তিন বছরে বিয়ে না করার শর্ত ছিল। বোকামি? তা হয়তো বা, কিন্তু পৃথিবীতে এখনো ঐরকম কিছু বোকা আছে বলে এই পৃথিবাটা এখনো ফলে ফুলে রঙে রসে ভোরে আছে। যাই হোক, তিনিতো এলেন, চুঁচুড়ার ইলেক্ট্রিক আলো, যানবাহনের আওয়াজ আর শহুরে আর পাঁচটা সুযোগ সুবিধে ছেড়ে, একেবারে খোদ গ্রাম বাংলায় দু ভাই বোনের কোনোরকমে চলা, অগোছালো এক সংসারের মধ্যে। বাপের বাড়ির আদুরে গাছে চড়া মেয়ে অভাব কাকে বলে জানতো, আর জানতো সেই অভাবে কিকরে স্থির থেকে সংসার চালাতে হয়, ফলে হাল ধরতে দেরি হলোনা। শুধু যে হাল ই ধরলো তাই নয়, একদম গুছিয়ে, শ্বশুর শাশুড়ি স্বামী ননদ নন্দাই নিয়ে সবার প্রিয় পাত্রী হয়ে সংসার শুরু করলেন। ততদিনে চাকুরীর চিঠিটি ধরা পরে গেছে। সবার থেকে জুটেছে একরাশ বকুনিও। তিনি বললেন ভাবছো কেন চাকরি নিনি তো কি হয়েছে, নার্সিং ট্রেনিং আর Dr Nun এর কাছে করা OT experience ব্যর্থ যেতে দেব নাকি? সেই গ্রামের মধ্যে তখন ডাক্তার বদ্যির ভীষণ অভাব। গ্রামের অসহায় বিনা চিকিৎসাতে মারা যাওয়া মানুষ গুলোর কাছে তাই সেই নববধূ হয়ে উঠলেন এক অনন্য জায়গা, যেখানে দিন নেই রাত নেই যখন ইচ্ছে ছেলে কোলে করে আসা যায়, ডাক্তার বাবু আসার আগে প্রিলিমিনারি ফার্স্ট এইড টা তো পাওয়া যাবে। ফলে মাথা ফাটা থেকে ডেলিভারি সব এ তেই ডাক আসতে লাগলো। আর এইভাবে ঠেকনো দিতে দিতে বুদ্ধিমতী বধূটি তাঁদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার বোধ, খাবার ঢাকা দিয়ে রাখা, বাচ্চার যত্ন নেওয়া, এইসমস্ত basic hygene concept .। সাথে সাথে চলতে থাকলো সংসার কে একটা সত্যিকারের সংসারের রূপ দেওয়া। বাইরে থেকে কেউ এলে অবাক হয়ে যেত। ঘরের মধ্যে আসবাবের প্রাচুর্য্য নেই, হয়তো বা আছে কিছু অভাবের ই ছোঁয়া, কিন্তু তার মধ্যেও কি পরিপাটি বিছানার চাদর। টেবিল এর ওপরে ফুলদানিতে একরাশ ফুল। শুনেছি প্রথম দিকে ওই টেবিল টাও যখন ছিলোনা, তখন মাটি আর কিসব দিয়ে যেন নিজেই টেবিল বানিয়ে ফেলেছিলেন, পাউডার এর কৌটোতে জল দিয়ে তাতে রাখা হতো কখনো কৃষ্ণচূড়া, কখনো গন্ধরাজ। দেখতে দেখতে দিন এগোয়। সেদিনের সেই নববধূ সমাদৃত হন মাতৃত্বে। আমার মা। ছুটির দুপুরবেলা গুলোতে যখন মা স্নান সেরে চুল খুলে চওড়া করে সিঁদুর পরে পরিপাটি করে ভাত বাড়তে বসত, আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম মুখের দিকে। আর মনে মনে বলতাম আমার বাবা আর মা দুজনে যেন ঠিক ঠাকুরের মতন। ভরা সংসারে মা এর তখন অনেক কাজ। একাধারে নার্স, শিক্ষিকা, মা, মামীমা, লেখিকা, আঁকিয়ে সমস্ত কিছু। শ্বশুড় শাশুড়ির শরীর নিয়েও তাঁর ছিল মহা সজাগ দৃষ্টি। আমার ঠাকুরদা তাঁকে নিজের মেয়ের থেকেও বোধয় বেশি ভালো বাসতেন , এই ছবিটা আমার হালকা ভাবে মনে পরে যে দাদু আমাদের নখ কেটে দিতে দিতে বাবাকে আর মা কে ডাকছেন, বৌমা এসো তো তোমাদের নখ গুলো কেটেদি। এ হেনো দাদুও চলে গেলেন, তখন আমি ক্লাস ২ তে, এক সপ্তাহের অন্তরে চলে গেলেন পিসেমশাই ও। যাঁকে বাবা মা দেবতা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন। সেই সময় যখন লোকে আমার পিসতুতো দাদা আর ভাই কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলছে ওরে তোদের কি হলো রে, আমার মা শক্ত হাতে চোখের জল মুছে নিয়ে, বাবা পিসি সবাইকে সামলে নিয়ে আমাদের চার ভাই বোন কে একসাথে মানুষ করেছেন। মা কিন্তু কখনো বলেনি তোদের কি হলো, মা বরং বলেছে তোদের মানুষ হবার সুযোগ এসেছে। তোরা যাদের ছেলে, তাদের মতন নিজেকে তৈরি করতে হবে। ছোটবেলায় হয়তো সেই কারণেই মাকে আমরা চার ভাই বোনে পেয়েছি ভীষণ কড়া একজন মানুষ হিসেবে। নিয়মে বাঁধা ছিল আমাদের জীবন। শুধু ভালো পড়াশুনো নয়, মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। এতটুকু রুডলি কথা বলার সাহস ছিলোনা কারোর। বাড়িতে অনেকটা সময় কাটতো আমার একা একা। মা মনের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন ছবি আঁকা, ডাইরি লেখা, নিজের কাজ নিজে করার অভ্যেস। নিজে নিজেই রুটিন বানাতাম গোটা দিনের। কখন তার মধ্যে নিজেকে ফিট করে ফেলতাম। দিদি অবশ্য একটু অন্যরকম ছিল, ওর ছিল গল্পের বই পড়ার নেশা। আমাকে ক্ষেপাত পুরো ল্যাজবিশিষ্ট ভালো মেয়ে। বাবা মা যা বলে তাই করে। রুটিন বানাতে কে বললো রে তোকে। সত্যি ই কেন যে আমার রুটিন এত ভালো লাগতো জানিনা। মাঝেমাঝে মা এর অত্যধিক কড়া শাসনে দম বন্ধ হয়ে আসতো। কেমন সবাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারে, দেরি করে বাড়ি ফেরে, অথচ আমাদের ক্ষেত্রে তো সেই নিয়ম নেই। মা এর ছিল সব কিছু হিসেবে বাঁধা। সেই কড়া শাসনের একটা নমুনা দিচ্ছি, আমি তখন higher secondery পরীক্ষা দিচ্ছি। লাস্ট দিনে মা যাবেনা, আর আমি ফুচকা খেয়ে ফিরবো। ডিল কমপ্লিট। মা ও রাজি। ফুচকা খাবার অনুমতি তখন ছিল ঠিক বছরে দুবার। একবার half yearly আর একবার annualy . যাই হোক, ফুচকাও খেলাম, গল্প ও করলাম। বন্ধু বান্ধব হাসি ঠাট্টায় যে সময়ে ফিরি, তার থেকে দেরি হয়ে গেলো প্রায় ৪০মিন. ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরলাম। এসে দেখি গেট এ তালা দেওয়া ভেতর থেকে মা বলছে যাও যেখানে ছিলে থাকো সেখানেই। পাড়ার লোকে হাসতে হাসতে দেখে দেখে গেলো রঞ্জিত বাবুর সাত চড়ে রা না কারা, তথাকথিত ভালো ছোট মেয়েটি স্কুলের শাড়ি পরে, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ভ্যা ভ্যা করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। অবশেষে বাবার হস্তক্ষেপে ভেতরে ঢোকা। ছোটবেলাতে অনেক অভিযোগ ছিল মায়ের প্রতি। মনে হতো মা তাদের স্কুলের ছেলে মেদের বেশি ভালোবাসে, কতবার মনে হয়েছে, সবার মা এরা কেমন বলে আমার মেয়ে তো কিছু কাজ করতে পারেনা, বা ও এক গ্লাস গড়িয়ে খেতে পারেনা। এইসব। সেখানে আমার মা এর ছিল কড়া নিয়ম। আমাদের বলা হতো তোমরা কেউ গাছতলাতেও থাকবেনা আবার হোটেলেও থাকবেনা, থাকতে হবে তোমাদের সংসারেই অতএব, আমি ইটা পারিনা ওটা পারিনা বা ইটা খাইনা, ওটা খাইনা, এইসব ন্যাকামো একদম করবেন আমার কাছে। আমরা দুবোনেই যখন ক্লাস সিক্স, জেনে গেছিলাম কিভাবে ডিম্ ভাজতে হয়, চা করতে হয় এইসব। রান্না, পড়াশুনা, আঁকা আবৃতি সব কিছু বাড়িতেই করেছি। আর একটা জিনিস শিখেছিলাম মার্ কাছে, যা আমাকে আমার বর্তমান দৈনন্দিন জীবনে ভীষণ সাহায্য করে। সেটা হলো মায়ের পরিপাটি বোধ, শুধু কাজ করলেই হবেনা, সেটাকে সুন্দরভাবে সুষ্ঠু ভাবে করতে হবে। ভাত বাড়া থেকে শুরু করে কিভাবে খাবার পরিবেশন করতে হয় বা কিসের পরে কি পদ কিভাবে সাজিয়ে রাখতে হয়, এসব মায়ের নিজের হাতে শেখানো। এমনকি বাইরে থেকে বাড়ি ঢুকে পায়ের জুতো খুলে সেটা জায়গায় রাখলাম নাকি তাকে ছড়িয়ে ফেলে রাখলাম সে ব্যাপারে ও মায়ের দৃষ্টি ছিল সজাগ। আর একটা ব্যাপারে মা ছিলেন সেকেলে, সেটা ছিল ছেলে মেয়ের অবাধ মেলামেশার ব্যাপারে মায়ের ছিল প্রবল আপত্তি। তবু, বড় হওয়ার সাথে সাথে বন্ধু বান্ধব এর সংখ্যা বাড়তে থাকে আমাদের, মা এর কড়া নিয়ম ছিল দুটোতে, এক রাস্তায় দাঁড়িয়ে কারোর সাথে গল্প করা চলবেনা আর দুই যদি কথা বলার দরকার ই থাকেন তাহলে বাড়িতে সবার সাথে সবার মাঝেই যা বলার বলতে হবে। তখন নতুন বন্ধু, নতুন প্রেম, সবসময় ই আবডাল খোঁজে মন। এমন সময়ে এহেন শাসনে যে সদ্য কিশোর কিশোরী মন গুলো বিদ্রোহী হয়ে উঠতো, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু আজ যখন পেছনে ফিরে তাকাই, বুঝতে পারি, সেদিনের সেই শাসনের মাহাত্ব। এইভাবে মা সামনে থেকে বা না থেকে কিভাবে আর কিকরে যেন আমাদের মধ্যে এক কর্মঠ, সক্রিয় , রুচিশীল আর শিক্ষিত মনন তৈরি করে দিয়েছেন, বুঝতেই পারিনি তখন। মাথার মধ্যে সবসময় ঘুরতো নিজের পায়ে দাড়াঁতে হবে, কিন্তু সেটা মাথা উঁচু করে আর শিক্ষাই হচ্ছে তার একমাত্র উপায়। বাড়ির বাইরে থাকতে হলো পড়াশুনার জন্যে, তখন দেখলাম কিভাবে মা এর শাসন অলক্ষ্যে আমাদের ঘিরে রাখে, অবাক হয়ে যেতাম নিজেকে দেখেই যখন দেখতাম মা সামনে নেই তবুও দু পা হেঁটে সিনেমা হল এ যেতে পারছিনা। ফোন করে অনুমতি নিয়ে তবে যেতাম। সত্যি বলতে কি মা কে একটু ভয় এর চোখেই দেখতাম। লেপটে থাকতাম আমি বাবার সাথে। সবসময় বাবা, বাবা আর বাবা। তবে পরে বুঝেছি, আমার বাবাও তাঁর সবটুকু মাহাত্ব নিয়ে কখনো হয়তো ঐভাবে থাকতে পারতেননা। যদি না মা এর তাঁর পাশে থাকতো। সেই বাবা যখন আমাদেরকে একেবারে অসহায় করে দিয়ে চলে গেল, সমস্ত দুনিয়া আমার চোখের সামনে সত্যি ই দুলে উঠেছিল। কথার কথা নয়, সেদিন বুঝেছিলাম পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া কাকে বলে। আমার মা কিন্তু নিজের স্বার্থের জন্যে একবারও আমাকে আটকে রাখেনি, একমাসের মধ্যে আমাকে নিজে সঙ্গে করে ইন্টারভিউ দিতে দিল্লী নিয়ে আসে। আর চার মাস পার থেকে একা আমার বাবার স্বপ্ন কে পূরণ করার কাজে নিজেকে নিমজ্জিত করে। আমার আর মা এর শুরু হয়েছিল সেই সময় থেকে একেবারে অন্য এক জীবনযাত্রা। আমাকে বাবা সত্যি ই প্রায় তুলো য় মুড়ে বড় করেছিল। সেখান থেকে বাস্তবের কাঠিন্য আমাকে কিছুই দেখতে হয়নি। পেতেও হয়নি তার ছোঁয়া। দায়িত্ব কাকে বলে জানতামনা। কিন্তু দেখলাম আমিও দায়িত্ব নিতে পারছি, অসুবিধে হচ্ছেনা সেগুলোকে সুষ্ঠু ভাবে পালন করতে আর আমাকে, মাকে এসবকিছুর মধ্যে সামলে রেখেছিলেন অন্য আর পাঁচজনের সঙ্গে আরো একজন মহিলা, সে হলো আমার বড় মাসি।
সবাই বলে আমি নাকি মাসির মতো শান্ত। হাঁ এই মানুষটিও আমার পিসিমার্ মতন ই শান্ত প্রায়। শুধু যে শান্ত তাই নয়, ভীষণ স্বপ্ন আর আবেগ প্রবণ। গাছের কচিপাতা দেখলে আমার যেমন ভালোলাগায় চোখে জল ভোরে যায়, আমার মাসিটিও তেমন ই। বাবা চলে যাবার পরে যখন কিছুতেই নিজেদের স্থির রাখতে পারছিলামনা, এই মানুষটি তখন কখনো গীতার উধৃতি তুলে, কখনো রামকৃষ্ণ সারদা মা এর উদ্ধৃতি তুলে কখনো বা বাবার নিজের বলা কথাকেই আবারো অন্যভাবে তার মানে বুঝিয়ে দিয়ে আমাদেরকে শান্ত করেছিল। দূরত্ব সত্যি ই কিছু বাধা হতে পারেনা, এটা মাসির থেকেই শেখা। মাসি ই বুঝিয়েছিল শিখিয়েছিলো কিভাবে নিজের মনের সবটুকু ওই ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে উজাড় করে দেওয়া যায়, কিভাবে যা আমাদের অধরা বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, তা আসলে আমাদের কাছেই থাকে। ইচ্ছে করলেই তাকে ছোঁয়া যায়, তার বোধ করা যায়, তার অনুভূতি নিয়ে বাঁচা যায়। শুধু সেই ভাবনাটাকে অন্তরে প্রতিষ্ঠা করে রাখতে হয়। আর এই মানুষটার কাছ থেকে দেখেছি অসীম ভালোবাসার অকুন্ঠ বোধ। মাসি নিজে মুখে কখনো বলে দেয়নি কিন্তু তার ওই ধীর স্থির ভাবে চলা, সবার জন্যে সত্যি কারের ভাবা, শুধু আমি আর আমার না করে, সবার মধ্যে বাঁচা, কারোর সাথে খারাপ ভাবে কথা না বলা দেখে আমি নিজেই নিজের জীবনে শত প্রতিকূলতা আর রাগের মধ্যেও নিজেকে স্থির শান্ত রেখে এক ই ভাবে কথা বলার চেষ্টা করি। মাসি নিজে অসুস্থ। তবু শত অসুস্থতার মধ্যেও নিজের মা আর শাশুড়িকে একসাথে রেখে সেবা করে যেতে ভোলেনি। দিদা আর ঠামু দুই বৃদ্ধাই প্রায় নব্বই এর ঘর ছুঁই ছুঁই করে ইহলোকের যাত্রা সমাপ্ত করেন। আর মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত দেখতাম মাসিকে তাঁরা কিভাবে চোখে হারান। পেশায় শিক্ষিকা আমার এই মাসির দুনিয়া দেখার খুব শখ। ঘুড়েছেও কম নয় একসময়। কিন্তু শরীরের জন্যে আজ সে একেবারেই শয্যাশায়ী। এই লেখাটা মূলত তাঁকে উজ্জীবিত করার জন্যেই আমার লেখা। এই বোনঝিটি তাঁর খুব কাছের। কত সিক্রেট প্ল্যান তাদের, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন। সে পঁচিশে বৈশাখ হোক বা নাহোক। এই দিল্লিবাসীনি যেদিন ই আসবে মাসির কাছে, বাড়ির ছাদে সেদিন বসবে গানের আসর। ফুলে ফুলে সাজানো হবে চারিদিক। গন্ধরাজ, জুঁই, বেল, রজনীগন্ধা। আর চাঁদনী রাত হতে হবে সেদিন। আমাদের আর এক বন্ধু এর সঙ্গী। অল ইন্ডিয়া রেডিওর চৈতি, আমার এক বোন। আমরা দুজনে মিলে সেদিন সবকিছু সাজাবো যতনে, অমূল রতনে আর দেখবো এভাবেই অধরা মাধুরী কে বাঁধা যায় কিনা ছন্দ বন্ধনে। জীবনে আমার এই মাসির মতন এইরকম কিছু মানুষের খুব দরকার যারা যে কোনো পরিস্থিতেই ভেঙে না পরে, আমাদের চারপাশের প্রকৃতির রূপ রং রস মাধুরী আরো বেশি করে গ্রহণ করে তার মধ্যে জীবনের রসদ খুঁজে পায়। এদের দেখে আমরা, যারা অল্পেই অস্থির, দিশেহারা, তারা নিজেদের আবার স্থির করতে পারি। বাঁধতে পারি। আর মাসির কথাতেই মাসির সম্পর্কে বলা শেষ করে বলি, ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে দুহাত জড়ো করে আবারো বলতে পারি, ঠাকুর আমায় স্থির রেখো, আমি যেন দিকভ্রান্ত না হয়ে পড়ি, নিজেকে যেন সত্যি আর সুন্দরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, এই জোড় দাও মনে। কি সুন্দর এই চাওয়া, বাড়ি নয়, গাড়ি নয়, বিষয় এর নেশা নয়, এক নিষ্কলুষ চাওয়া আমি সবসময় আমার পরিবারের মধ্যে দেখেছি। যে চাওয়ার বোধ, পারিপার্শিক বৈষয়িক সকল চাওয়ার বোধ থেকে অনেক ওপরে আমাকে উন্নীত করেছে। প্রার্থনা করি ঘরে ঘরে এইরকম মাসি পিসি মা এর উদাহরণ তৈরি হোক, আরো।
এর পরে আমার জীবনের চতুর্থ আর এক গুরুত্বপূর্ণ মহিলাকে আমি পাই, তিনি হলেন আমার শাশুড়িমা। খুব গর্ব করেই বলতে পারি যে শাশুড়ি বৌ এর সম্পর্ক সাধারণত যেমন তিক্ত হয়, সেইরকম আমাদের কোনোদিন ই হয়নি। বরং একটা মিষ্টি সম্পর্ক যেখানে মা তার মেয়েকে শাড়ি কেনার আবদার করতে পারে বা কেন তার বৌমা টি সাজেনা এমন অনুযোগ করতে পারে। ছেলে বৌ এর কাছ থেকে ফেরার সময় চোখের জলে ভাসায় আবার নিজেকে ছেলেকে হাঁরে , ও কত কাজ করে তুইও তো একটু ওকে হেল্প করতে পারিস এমন বলতে পারে। এ হেন্ মানুষকে শ্রদ্ধা না করে আমি পারিনা। বাইরে তিনি খুব একটা যাননি। ঘরের ভেতরেই তাঁর দুনিয়া শুরু ও শেষ হয়েছে, তবু এমন আধুনিক মনষ্কতা কজন মা এর মধ্যে পাওয়া যায়, আমি জানিনা, তবে আমি তো এই একজনকেই দেখেছি। এনার কাছ থেকে আমি শিখেছি সংসারের মূলমন্ত্র- ভালোবাসা। কিভাবে এই একটা জিনিসের ভিত্তি প্রস্তর দিয়ে সমস্ত সংসার নামক ইমরাতটিকে সযত্নে সোজা রাখা যায় সেটা। কার কি খাবার কখন দরকার, কখন ভালোলাগে বা কিভাবে তাকে সেটা ঠিক সময়ে দেওয়া যায়, এসমস্ত এমন ভাবেই তিনি বুঝে যান বা এতবছর বুঝে গেছেন যার ফলে তাঁর ছেলেরা কখনো খিদে কি বা ভালো খাবার এর অভাব কাকে বলে তার সেই বোধটা থেকেই বঞ্চিত থেকে গেছে।
আর সবার শেষে বলি আমার ছেলেবেলার সাথী, আমার সব কাজের ভাগীদার আমার থেকে মাত্র পাঁচ বছরের বড় আমার সহোদরা। আমার দিদির কথা। আমাদের বাড়ির প্রথম সন্তান। স্বাভাবিকভাবেই খুব ই আদুরে। ফর্সা টুকটুকে বই মুখে করে বসে থাকা, জেদি সুন্দরী সেই মেয়ে, যাকে জীবন সঙ্গিনী করে পাবার জন্যে আক্ষরিক অর্থেই হাপিত্যেশ করে বসে থেকেছে বহুজন। কিন্তু ওই যে, পারিবারের শিক্ষায় সেদিকে কোনোদিন ঘুরে তাকানোর কথা মনেও আসেনি। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে সম্পূর্ণ অন্য আদর্শবাদী এক পরিবার এর সাথেই যখন বৈবাহিক সূত্রে বাঁধা পারলো সে, এবং পদে পদে যখন দেখি এতদিনের শিক্ষা সম্মান ছোটথেকে বড় হবার সেই আদর্শবোধ গুলো পদে পদে দলিত হচ্ছে, হচ্ছে চুরমার। তখন আমার বহুবার ভীষণ রাগ হয়েছে, মনে হয়েছে চিৎকার করে বলি, দিদি এখুনি চলে যায় তুই আমার কাছে। কিন্তু না ওই যে বলেছিলামনা? জেদি? সেই জেদী আমার দিদি শিরদাঁড়া সোজা রেখে, হেরে না গিয়ে লড়াই শুরু করলো। কিন্তু লড়াইটা কিসের? আজকের দিনে আমাদের জেনারেশন খুব কষ্টে যা ভাবতে পারে, তার লড়াই, বলতে গিয়ে আমার হাসিও পাচ্ছে, রাগ ও হচ্ছে। একটা চরম বিপরীত আদর্শবাদের পরিবারকে তাদের মতো করে ভালোবাসে, ভালো থাকার লড়াই। তার জীবন যাত্রা থেকে আমি বুঝেছি সহ্য করা কাকে বলে, বুঝেছি প্রতিটা মানুষের নিজের স্বত্বা বাঁচিয়ে রাখা কতটা দরকার। দেখেছি কিভাবে একজন মেয়ে, শুধুমাত্র নিজের ওপরে ভরসা রেখে আর সংসারের ওপর মায়ায় সব কিছু সহ্য করে নিতে পারে। সবকিছু সহ্য করা ভুল কি ঠিক সে তর্ক থাক নাহয় এখন। হয়তো ঠিক নয়, হয়তো বা....জানিনা। তবে এইরকম মানুষ গুলো এখনো আছে বলেই অলিভিয়া স্পিনোলা রা বলতে পারে, তোমরা ? ইন্ডিয়ান মেয়েরা? সবাই এত নরম? সবার এত সহ্যশক্তি? তোমরা স্বামী সন্তান সংসারের জন্যে নিজেদেরকে নিঃশব্দে বলি দিতে পারো? আর আমি মুখটিপে হেসে বলতে পারি, এ তো কিছুইনা স্পিনোলা, আমাদের মেয়েরা আরো অনেক অনেক কিছু পারে, যা দিয়ে তারা বিশ্ব সংসারকে এক অন্যান্য জোড় এ বেঁধে রাখতে পারে, হিংসা নয়, রাগ নয় ঝগড়া নয়। শরীরী আবেদন নয়, ভালোবাসার অভিনয় নয়। সত্যিকারের প্রেম, সত্যি ভালোবাসা, অমোঘ কর্তব্যবোধ আর মায়া। এ আমাদের রক্তে , মজ্জায়।
পরিশেষে বলি, আমি খুব সাধারণ বাড়ি থেকে বড় হয়ে ওঠা একজন মানুষ। এই দিল্লির বুকে চারিদিকে যখন অজস্র অসহিঞ্ষুতা আর মূল্যবোধের অভাব দেখি, তখন খুব বেশি করে অনুভব করতে পারি, সঠিক বোধ নিয়ে মানুষের মতো করে বড় হবার কি অর্থ। সেই অর্থে আমি মানুষ হতে পেরেছি কিনা জানিনা, কিন্তু চারপাশের যে সব মানুষগুলোর জীবনাদর্শ আমাকে এখনো হয়ত বা ভবিষ্যতেও মাথা উঁচু করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে, খুব ইচ্ছে করলো তাদের সেই জীবনাদর্শের কথা সবার সামনে আনতে। কারণ এখন সময় আমাদের দেখে, শিখে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের এগিয়ে চলার। ওই যে কথায় আছেনা "If you want to change the world, start off by making your bed" তাই সেকথা মনে রেখেই আমার ঘরের আঙ্গিনা থেকেই শুরু করলাম মূল্যবোধের দৃষ্টান্ত। মানুষ হবার প্রথম বুনট।
No comments:
Post a Comment