Wednesday, 29 August 2018

"মোর লাগি করিওনা শোক
আমার রয়েছে কর্ম, রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয়নাই-
শূন্যেরে করিব পূর্ণ,
এই ব্রত রহিবে সদাই।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষায় থাকে
সেই ধন্য করিবে আমাকে
শুক্লপক্ষ থেকে আনি
রজনী গন্ধার বৃন্তখানি যে পারে সাজাতে
...................

...........

কোনোদিন কর্মহীন বসন্ত বাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস
ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ। ........" ........
...............................শেষের কবিতার এই শেষ কেন বারবার কানে বাজে। "শেষ নাই যার শেষ কথা তার কে বলিবে ". হে আমার মহিমাময়, আমায় আলো হয়ে ঘিরে থাকো, নতুন ভোরের আশ্বাস দাও। আমায় ভোর দেখাও।

Tuesday, 28 August 2018

ইমন কল্যাণ

অল্প জ্বরের অজুহাত সপ্তাহের শুরুতেই দিয়ে গেল হটাৎ ছুটির সুযোগ। হাতের কাজ আর তার সামনে রইলো মেঘলা দিনের অলস মধ্যাহ্ন। ঘুম ঘুম ঘোর লাগানো দুপুরবেলাটাতে কখন ঘুমিয়ে গেছিলাম। আর ঘুমিয়ে একটা স্বপ্ন দেখলাম। একটা বাড়ি, গঙ্গার ওপরে, এ বাড়ি কল্পনাতে আমি অনেক দেখেছি, কিন্তু স্বপ্ন তো নাকি যা দেখা হয়নি কোনোদিন, তাকে দেখা যায়না, তাহলে কেন দেখলাম। জানিনা। আর সেই নিয়ে ঠিক ভাবতেও ইচ্ছে করছেন। কিকারণে যে কল্পনাতে থাকা একটা জগৎ হটাৎ স্বপ্নে এসে ধরা দিয়ে গেল জানিনা। ঘুমোনোর কিছু আগে দেখছিলাম ব্যোমকেশ এর সত্যান্বেষণ। তাই গঙ্গার ছলাৎ ছলাৎ সেই সূত্র ধরে বা হয়তো কিছুদিন আগে আমার গঙ্গার জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে এই রুক্ষতার শহরে ফিরে আসার সূত্র ধরে, কানে বেজেই চলেছিল।

ঘুমের মধ্যেও সেই সুরের রেশ আমার পিছু ছাড়লনা, বরং নিয়ে গেলো কখনো না দেখা একটা বাড়িতে। ঘোরানো ঘোরানো আগেকার দিনের ব্রিটিশ আমলের সিঁড়ি। আমি যেন কি খুঁজছিলাম, তাই উঠেই  চলেছিলাম। অবশেষে পৌঁছলাম একটা ঘরে, অনেক ওপরে। তিনপাশে বড় বড় জানালা, নিচে তাকালেই দেখা যায়, স্রোতস্বিনী গঙ্গা। যার রং হতে পারে ঘোলা, কিন্তু ওই যে নিজের মহিমাতে যে অনায়াসে তুচ্ছ করে দিতে পারে, পাশ্চাত্যে আমার যেখানে থাকার কথা, তার সামনে দিয়ে বয়ে চলা স্প্রী কেও। না তাবলে আমি স্প্রী কে ছোট করছিনা, সে তার মতো করে সুন্দর। ভীষণ সুন্দর। কিন্তু আমাদের এই গরিব দেশের অজস্র না পাওয়ার মাঝখান দিয়ে অমন দরাজ মনে বয়ে চলা, কত ইতিহাস ধুয়ে নিয়ে আসা চোখের জল হয়তো মিশেছে এতে, প্রেমিকের না পাওয়ার বেদনা, প্রেমিকার বঞ্চনার হাহাকার, আবার কখনো বা হাত মিলে গেছে হাতে। একে অপরের আঙ্গুল জড়িয়ে নিয়ে ওই পবিত্রতাকে সাক্ষী রেখে স্বপ্ন দেখেছে বেঁচে থাকার। প্রদীপ ভাসিয়ে সুন্দরকে করা হয়েছে আহ্বান। বিগত কে করা হয়েছে স্মরণ। সেই আমার প্রাণের নদী। খুব কাছের। ওই স্বপ্নে দেখা সেই ঘরটা থেকে যেদিকে তাকানো যায়, শুধু সেই প্রাণের নদীকেই দেখতে পাওয়া যায় যেন। আর বেশি কিছু মনে পড়ছেনা ঘরটার, শুধু একটা বই ঠাস হয়ে থাকা কাঁচের আলমারি, একটা কাঁচের টেবিল, তাতে একটা ডায়েরি, গাঢ় নীল রঙের একটা পেন সোনালী দিয়ে কিছু লেখা। পেন টা খুব স্পষ্ট ছিল। আর একটা ফুলদানিতে একরাশ ফুল ছিল। আর যদিও কিছু দেখলামনা শুধু মনে পড়ছে চেয়ার টাতে খুব বসতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু স্বপ্নটাকে আরো একটু কল্পনার রঙে রাঙিয়ে আমি ঘরের কোণে রাখলাম একটা লম্বা ফ্লাওয়ার পট যাতে থাকুক একরাশ রজনীগন্ধা। আলো থাকুক দুরকম। একটা ভীষণ সুন্দর টেবিল ল্যাম্প। আর একটা হোক রাতের গভীরতা নিয়ে মায়াবী লণ্ঠন। পুরোনো, ব্রিটিশ আমলের কাজ থাকুক তাতে। রেকাবিতে অগোছালো পরে থাক জুঁই বা বেল। সযত্নে থাকুক আমার বেহালাও। যেদিন আকাশে এই গতকাল রাতের মতোই চাঁদ উঠবে। সমস্ত আকাশ বাতাস যখন শিহরিত হয়ে উঠবে, নদীতে তখন আসুক ভরা জোয়ার। ভাসিয়ে নিয়ে যাক ওই ডিঙি নৌকাকে। আর সেদিন ছাদের ওপরে চাঁদের আলোয় ভীমপলাশী, ভূপালী, বাগেশ্ৰী, বেহাগ, ইমন কল্যাণ, দরবারী কানাড়া, চন্দ্রকোশের সুর চাঁপার গন্ধের সাথে মিশে যাক। সেদিন ঝড় উঠুক। রাত্রি সেদিন শুধুই সুন্দর নয়, মদির হয়ে নামবে এই পৃথিবীতে। আর সুন্দরের পূজারী হয়ে নদীতে ভেসে যাবে অজস্র প্রদীপ।

আমাকে একবার একজন জিজ্ঞাসা করেছিল, চারপাশের পৃথিবীতে এত সমস্যা, হানাহানি খুনোখুনি, তুমি সেসব দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে শুধুই সুন্দরের গুনগান করতে থাকো কেন ? তোমার কিছুই যায় আসেনা? জানিনা। এর উত্তর এ অনেক কথাই বলা হয়তো যেতেই পারতো, আজ ও হয়তো যায় ও। কিন্তু না ইচ্ছে করলোনা।তাই সেদিনের মতো আজ ও বলি, আমি স্বার্থপর। তাই, প্রতিদিন যখন মানুষ মারছে, মরছে,  তখন আমি চোখ এর ওপরে রঙ্গীন স্বপ্নের পর্দা ফেলতে চাইছি। খুঁজছি ফুলের আলতো আদর, চোখ ভোরে নিতে চাইছি জ্যোৎস্না মাখা আলোতে অথবা সুরের মধ্যে বিভোর হতে চাইছি। কি করবো, চাইলেও কি এই চারপাশের রক্তাক্ত উন্মাদনা আমি বন্ধ করতে পারবো? পারবোনাতো। তার থেকে বরং যে মায়ায় প্রকৃতি আচ্ছন্ন করতে চায় আমাদের, নাহয় সব কিছু ভুলে সেই মায়ায় ভুললাম ই। এমন তো নয় যে এ মায়া ক্ষণিকের। আমরা কেউ দেখি বা না দেখি, সূর্য্য রোজ আকাশ লালে লাল হয়ে উঠবে, চাঁদ এর আলোয় আদিগন্ত চরাচর এক অসামান্য মায়ায় জ্বলজ্বল করবে। শুকতারা তার মিটিমিটি চোখ তুলে এমনি করেই তাকাবে, রোজ। আমরা দেখি বা না দেখি। তাই চারপাশের হিংসা,  মারামারি, ইঁদুর দৌড়, প্রতিদন্দ্বিতা, কে কাকে ফেলে আগে দৌড়ে যাবে, কে কত বেশি জীবনে সফল, এসবের তুল্য মূল্য বিচারে না গিয়ে নাহয় ওই যে চিরন্তন এই মায়ায় নিজেকে নাহয় জড়িয়ে রাখলাম আষ্টেপৃষ্ঠে, কি এসে যায় তাতে। সংসার পরিবর্তনশীল। সমস্ত কিছুই চক্রবৎ পরিবর্তন হয়ে চলে। শুধু পরিবর্তন নেই এই মায়ার। তাই একবার যদি এই মায়াতে মজে যেতে পারি, আমৃত্যু আমাকে অমৃতের সন্ধান পাওয়া থেকে কেউ বঞ্চিত করতে পারবেনা। তাইতো চাঁদ দেখতে দেখতে কখন পার হয়ে যায় বিনিদ্র রজনী , কখনো বা হাঁটা পথের শ্রান্তি ও মুখের হাসি কেড়ে নিতে পারেনা। বাবার অনুপস্থিতির বেদনাও কেমন যেন ওই সূর্যাস্তের সাথে এক হয়ে মিশে যায়, পুনরায় ফিরে পাবার সেই আগামীর ভোরের আশা নিয়ে।
তাই আমার সন্ধ্যার ইমন কল্যাণ বারবার সুর তোলে। জীবনের হাজার সমস্যার মধ্যেও জীবনকে স্বপ্ন দিয়ে সুন্দর করে সাজাতে চাই , করিনা? ক্ষতিকি ? যতদিন স্বপ্ন দেখতে পারি, দেখিনা? তারপরে যদি ওই ওপরে যে বসে আছে, একদিন যদি ইচ্ছে করে, আমার সব স্বপ্ন ভেঙে দিতে, দেবে, আমার কাছেতো সে মহাপ্রলয় থামাবারও যে কোনো উপায় নেই। সে যবে হবে হবে, তবে তার আগে পর্যন্ত আমি না হয় প্রাণ ভোরে নিশ্বাস নি। ভোর বেলাতে হালকা চাদর গায়ে দিয়ে দিলে, যেমন সেই চাদর টাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে মানুষে শান্তি আর স্বস্তি তে আবার ঘুমিয়ে পরে, আর সেই শান্তির রেশ লেগে থাকে ঘুম ভেঙে উঠে সারাদিনটার মধ্যে। সেইরকম ই আমার এই স্বপ্ন মাখা চাঁদের আলো কে আমি জড়িয়ে থাকতে চাই। আর চাই ওর ওই আদরটা থেকে যেন কেউ কোথাও না বঞ্চিত না হয়। ওই আদোরে জড়ানো শান্তি জড়িয়ে থাকুক , তোমাকে, আমাকে, সবাইকে। ওই স্বস্তির নিঃশ্বাসটা আমি অনুভব করতে চাই। খুব।

Friday, 24 August 2018

মালকোশ

জ্যোৎস্না রাত। চাঁদের ওই অর্ধচন্দ্রের থেকে আর একটু বেশি তাকানো টা মনে করিয়ে দিলো, কিছুদিন আগের শোনা ঝুলন পূর্ণিমার কথা। আর ঠিক দুদিন পরেই সেই পূর্ণিমা।  শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, এই সবুজ আদিগন্ত এর জ্যেৎস্নাস্নান দেখতে দেখতে কেমন যেন খুব শান্ত লাগলো। সামনে জঙ্গলের থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝি পোকার ডাক, ডিড ইউ ডু ইট পাখির হটাৎ চমকে দেওয়া, আমার অন্ধকার রাতের ব্যালকনি টাকে ভীষণ এক মুগ্ধতায় মুড়ে দিতে থাকলো। চুপ করে, একেবারে শান্ত করে এই মুহূর্ত গুলোকে সর্বান্তঃকরণে শুধু অনুভব করতে লাগলাম। 

সামনের পূর্ণিমা যখন আসবে, তখন আমি আর মনে হয় থাকবোনা আমার এই ব্যালকনি টায় দাঁড়িয়ে। জ্যোৎস্না ভেজা রাত কি এমন করেই আসবে? এই ব্যাল্কুনিটাতেও কি অন্য কেউ দাড়াঁবে? এইরকম পাগলের মতো না ঘুমিয়ে চাঁদ দেখবে, পাছে চাঁদ হারিয়ে যায় বলে? সত্যি কি বোকা বোকা সব কথা বলিনা? এই জন্যেই এত বকুনি খাই। কারোর জন্যে কি কিছু থেমে থাকে না থিম থাকা উচিত। আমরা সবাইতো নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্যে, আমাদের ওই সময়টুকুর জন্যে আমাদের জন্যে রাখা কাজটুকু শেষ করতে আসি। আমার বলে কি কিছু হয়, যে সব সময় আমার বলি? আমার ঘর, গাছ, আমার চাঁদ, জ্যোৎস্না রাত, শীতের শিশির, চাঁপার গন্ধ। কিছুই যে কারোর নয়। খুব স্বার্থপর তো আমি।  শুধু আমি আর আমি। এইটুকু লেখার মধ্যে কতবার বললাম, আমি আমি আর আমি। তাইনা? আচ্ছা, এত জানি, তবু আমার বললাম কেন একে। যা আমার কিছুই নয়, তার ওপরে এত অধিকার বোধ দেখাই কেন ? এতো আমার ভারী অন্যায়, আমার এই একান্ত স্বভাব বিরুদ্ধ কাজে শুধু যে কিছু অভ্যাস এ বাঁধা পরে চলেছি সবাই। এরপর হটাৎ যদি কেউ এসে বলে, কোন অধিকারে তুমি এত অধিকার দেখাও? কি বলবো আমি তখন? একবার মনে হলো, বলি, বেশ করেছি, ওই চাঁপারা তো রোজ ই ফোটে, ওই আকাশ তো রোজ লালে লাল হয়ে জাগায় আর চাঁদনী রাত ও তো এক ই ভাবে ঘোর লাগায়, তুমি কেন মাখলেনা ওই চাঁদের আদর। তাইতো ওই আদরের লোভে আমি জেগে আছি আজ। 

কিন্তু না, এ যে শুধুই কথার পৃষ্ঠে কথা জোড়া হবে। আমার বলে যে সত্যি ই কিছু হয়না। বড় ক্ষনিকের এই সব কিছু। সমস্ত কিছুর মধ্যেই হয়তো আমাদের সমস্ত স্বত্বা লীন হয়ে থাকে, মিশে থাকে। তাই আমি সবের মধ্যেই আছি কিন্তু আমার কিছুই নয়। বিশ্বজোড়া শুধুই যে মায়ার ফাঁদ। তবে এ মায়া থেকে আমি পালাতে চাইনা, চাইনা এ মায়া ছিন্ন করতে। সংসারের মধ্যে থেকে আমি এক খুব সাধারণ নারী হয়ে সবকিছুর মধ্যে থেকে মায়া খুঁজে নিতে ভালোবাসি। সুখ নয়, দুঃখ নয়, যেন এই সুন্দরের কাছে ম্লান হয়ে যায় সমস্ত চাওয়া পাওয়া। শুধু মনে হয় এই মায়ায় যেন এমনি করে আজীবন সবকিছু সবসময় সুন্দর হয়ে সবাইকে জড়িয়ে থাকুক। আর এই নিস্তব্ধ রাতের গভীরতার সাথে একাত্ম হয়ে গিয়ে মনে মনে আবৃতি করতে ইচ্ছে হয় স্বামীজীর সেই বিখ্যাত শব্দ সম্ভার -

"ভ্রান্ত সেই যেবা সুখ চায়, দুঃখ চায় উন্মাদ সে জন—
মৃত্যু মাঙ্গে সেও যে পাগল, অমৃতত্ব বৃথা আকিঞ্চন।
যতদূর যতদূর যাও, বুদ্ধিরথে করি আরোহণ,
এই সেই সংসার-জলধি, দুঃখ সুখ করে আবর্তন।
পক্ষহীন শোন বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার
বারংবার পাইছ আঘাত, কেন কর বৃথায় উদ্যম?
ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল;
দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম-অগ্মিশিখা করি আলিঙ্গন।
রূপমুগ্ধ অন্ধ কীটাধম, প্রেমমত্ত তোমার হৃদয়;
হে প্রেমিক, স্বার্থ-মলিনতা অগ্নিকুণ্ডে কর বিসর্জন।
ভিক্ষুকের কবে বলো সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল ?
দাও আর ফিরে চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।
অনন্তের তুমি অধিকারী প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,
'দাও, দাও'-সেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান।
ব্রহ্ম হ'তে কীট-পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়,
মন প্রাণ শরীর অর্পণ কর সখে, এ সবার পায়।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।।"

 আর আজ এখন আবার সেই খুব সত্যি আর খুব সুন্দর কথাটা মনে করে আজকের নিশিযামিনীকে বিদায় জানালাম ।   

asato mā sad gamaya,
tamaso mā jyotir gamaya,
mṛtyor mā amṛtaṃ gamaya,
Om shanti~ shanti~ shanti hi~~

Lead me from falsehood to truth,
Lead me from darkness to light,
Lead me from death to the immortality
Om peace peace peace
আমাকে অসত্য থেকে সত্যের পথে আনো , 
আমাকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাও 
আমাকে মৃত্যু থেকে অমরত্বের পথ দেখাও 
ওঁম শান্তি শান্তি শান্তি 
 
আমাদের চারপাশের সবকিছু, সমস্ত সম্পর্ক, যা কিছু পার্থিব বা অপার্থিব সব কিছু খুব সুন্দর। খুব সত্যি। হয়তো কখনো কখনো সময়ের টানা পোড়েনে তাতে তিক্ততার ছোঁয়া লাগে। হয়তো পারিপার্শ্বিকের চাপে তার মধ্যে অসুন্দরের ছায়া এসে পরে। কিন্তু এসব কিছুই এই চাঁদের কলংকের মতোই। ঠিক সময়ে, যখন জ্যোৎস্নায় চরাচর ভিজে নরম হয়ে যাবে তখন আর ওই কলঙ্ক চোখেই পড়বেনা, তার সবকিছু খুব স্নিগ্ধ, নরম আলোর মতো করে জড়িয়ে থাকবে আমাদের। কখনো তা চাঁদনী রাতের আদর হয়ে আমাদের রোমাঞ্চিত করে যাবে, কখনো তা দিন শুরুর নরম সোনালী রোদ্দুর হয়ে উজ্জীবিত করবে, কখনো বা কর্মরত মধ্যাহ্নের জানলা দিয়ে বাইরে দেখার আবেশ আনবে আবার কখনো তা দিনশেষে ঘরে ফেরার প্রিয় স্পর্শ দেবে। আর সমস্ত কিছুর মধ্যে বারংবার উপলব্ধি দিয়ে যাবে সেই গভীর স্নেহ, মমত্ব, ভালোবাসা আর শান্তির।

চাঁদ ঢলে গেছে, মালকোশের সুরের মতো, রেশ পরে আছে তার। আর বাতাসে আনমনে ভেসে বেড়াচ্ছে চাঁপার গন্ধ। শ্বেত শুভ্র পাপড়ির মাঝে হালকা হলুদ আলো দেওয়া নরম ভালোবাসা। 


Wednesday, 15 August 2018

অপরাহ্নের আলো

অপরাহ্নের আলোয় সেদিন আকাশে ঘোর লেগেছিলো। মেঘের আড়াল থেকে ঠিকরে বেরোনো সোনার টুকরো, গঙ্গার ছলাৎ ছলাৎ এর সাথে মিশে গিয়ে কেমন বাক্যহারা করে ফেলেছিলো। হটাৎ চোখে আসা সবুজ মনে করিয়ে দিয়ে গেল, ছোটবেলার মাধবীলতা আর অপরাজিতায় মোড়া আমাদের বাড়িতে ঢোকার সেই গেট টার কথা। অযত্ন রক্ষিত কিন্তু কি অপরূপ সুন্দর। চোখ বন্ধ করে বাড়ি বলে ভাবলেই প্রথমেই ভেসে আসে গেট এর কথা। আর তারপরেই মনে হয়, সামনের ঘরের সোফার ওপরে হাতে কোনো একটা বই নিয়ে পা দুটোকে ক্রস করে বসে আছে আমার বাবা। ঐভাবে বসাটা আমার বাবার থেকেই শেখা। চেয়ারে বসলে ঐভাবে। আর মাটিতে বা বিছানায় বসলে কখনো পদ্মাসনের ভঙ্গিতে কখনো বা ওই যে যেইভাবে সেতার বাজায় , সেইভাবে।

সেই দিনও মনে পড়লো ওই গেট এর কথা। গেট টা ঠেলে সত্যি ই কি কেউ ভেতরে এসে দাঁড়ালো। একে অপরের হাত ধরে, দুজনের ই কি অভিমানী মনের কোণে ঘুমিয়ে থাকা অজস্র ইচ্ছেরা হটাৎ ছেলেমানুষি সুরে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো? ছাতা না খুলে সেদিন গায়ে মাখলাম বৃষ্টির জল। বইয়ের গন্ধ নাকে নিয়ে আদর করে ঘরে আনলাম কিছু জানা কাহিনী, কিছু অজানা তথ্যের সম্ভার। আর কালো কফির গন্ধ আমাকে কেমন যেন বেহিসেবি করে তুললো সেদিন। দেয়া নেওয়া, জামাখরচ আর সব কিছুর হিসেব ভুলে গিয়ে শুধু শুনতে ইচ্ছে করছিলো। কিকথা? কিজানি। কিন্তু শুনলাম কত কথা। হালকা মজা, গল্প, কিছু সুর, আবার কিছু কাঠিন্যের আবডালে আবদার রক্ষার তাগিদ। অনুভব করলাম। আর এই সব কিছুর মধ্যে বোকার মতো সত্যি ই ভুলে গেলাম হিসেব। কর্তব্য। যে কর্তব্যে এই কয়েকবছর নিজেকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছি, কোনো কোথাও চুলচেরা হিসেবে এতটুকু শৈথিল্য যে কোনোদিন হতে দেয়নি, সেই আমি ই সেদিন সত্যি ই দেনা পাওনার সব হিসেব, কর্তব্য ভুলে চুপ করে বসে ছিলাম। আর তারপর অপরাহ্নের আলোয় ভেসে যাওয়া ডিঙি নৌকা, মনের মাঝে বয়ে চলা নির্বাক শান্তির সাথে মিশে গিয়ে আমাদের চারপাশের সমস্ত কিছুকে যেন এক অপরূপ বাঁধনে বেঁধে ফেললো। সেদিন ছিল ভাঁটা।

তবে সেই "বন্ধনহীন গ্রন্থি"র টান অনুভব করলাম, আজ। আজ ছিল ভরা জোয়ার। জোয়ারে উথাল পাতাল গঙ্গা আমাদের পাশ দিয়ে বয়ে যেতে যেতে খুব আদর মাখিয়ে সারাদিনের ওই কয়েকটা ঘন্টার মদিরাতা তুলে ধরছিল। ওই যে পায়ে পা মিলিয়ে রৌদ্রতপ্ত দুপুরে হেঁটে বেড়ানো। আড়চোখে দেখতে পাওয়া মাটির লস্যির ভাঁড়ে আবেশ মাখানো সলাজ চুমুক। অনেকজনের মাঝে খোলা আকাশের নিচে একসাথে ভাগ করে খাবার খাওয়া। এই সব সব কিছু আমার কাছে একেবারে প্রথম। এই সবকিছুর মধ্যে দিয়ে হটাৎ করে যেন চারপাশের পৃথিবীটার বয়স অনেকটা কমে গেছিলো। খুব মিষ্টি লেগেছে আদর মেশানো হালকা ধমকের সুরে বলা 'খেয়ে নাও' . ওই সুর মনে এসে এখনো ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে দিয়ে গেল। ওই সুর আর এই কয়েকদিনের সখ্যতা হটাৎ যেন বাবার হাত ধরে রাস্তা পার হওয়া থেকে হটাৎ বড় হয়ে যাওয়া দায়িত্ব কর্তাব্যপরায়ণ মেয়েটাকে আবার কেউ আদর করে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিলো। অজস্র জটিলতা আর দায়িত্ব কর্তব্যের ঘেরাটোপে থাকা দুটি মন একটু বেশি উচ্ছল হয়ে উঠেছিল কি আজ ? কিজানি, হবে হয়তো। তবে আনকোরা আমার মনে ভেসে এসেছিলো আজ বেহাগের সুর। উচ্ছলতা সেখানে স্থির শান্তির সাথে মিশে গিয়েছিলো। গঙ্গার ছলাৎ ছলাৎ বারবার বলছিলো সব কিছুকে দুচোখ ভোরে নিতে। আর বলছিলো এই যে মুহূর্তরা ভিড় করে আসছে, তৈরি হচ্ছে একের পর এক মুহূর্ত। আবার তাও ভেসে চলে যাচ্ছে, এইরকম ই সময় সব কিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। পরে থাকে ওই মুহূর্তরা। আর আজ হটাৎ একি অসম্ভব এক মুহূর্তে, আমার পরিমিত, কর্তাব্যপরায়ণ আমির ভীষণ বেহিসেবি হয়ে আত্মপ্রকাশ, আমার আমিকেই ভীষণ লজ্জায় ফেলে দিলো।
আজ সকালে বেরোতে যাবো, হটাৎ দেখলাম, গেট এর পাশে হয়ে থাকা অপরাজিতা গাছে এক গাঢ় নীল অপরাজিতা। বৃষ্টিস্নাত, সবুজের মাঝে নীল। কি স্নিগ্ধ। কি সুন্দর। ফুল তুলতে আমি ভালোবাসিনা। কষ্ট হয়, কিন্তু তাও এর মধ্যের ওই রোমাঞ্চিত গাঢ় বার্তা পৌঁছে দিতে ইচ্ছে হোলো, অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে। অনেক ভালোলাগার আর অনেক ভালোবাসায় মুড়ে ওকে আলতো করে তুলে রেখেছিলাম ব্যাগ এর ভেতরে। সারাদিনের সব কিছুর মাঝে যখন হারিয়ে ফেললাম মনের মাঝে গুছিয়ে রাখা কিছু ইচ্ছেকে। তখন বুকের মধ্যেটা হটাৎ ছটপট করে উঠলো, মনে হলো কি করে দি, কেমন করে পৌঁছে দি আমার ওই আলতো আদরকে। হাতে থাকা অনেক কিছুকে এক নিমেষে কেমন যেন ভুলে গেলাম, দৌড়ে মাঝরাস্তার মধ্যে এসে হাতে তুলে দিলাম ওই শুখনো হয়ে যাওয়া নীল আদরকে। আর তারপরেই যেন একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরলো আমায়, কেন লজ্জা আর কিসের জন্যে তা, জানিনা। ভুলে গেলাম রাস্তার কথা, দাঁড়িয়ে থাকা হলুদ ট্যাক্সি। মনে হলো যেন ওই একটা ছোট্ট নীল ভালোবাসা আমার মনের অনেকটা কোথাও উন্মোচন করে দিলো। গাল আর কানের মধ্যে এক অদ্ভুত উষ্ণ অনুভূতি, আমাকে দাঁড়াতে দিলোনা, লজ্জা অথচ দিতে পারার এক অদ্ভুত আনন্দ আমাকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে এলো, সাহস হলোনা ফিরে তাকাতে। আর তারপর, সমস্ত রাস্তা কেমন যেন ওই হলদে অপরাহ্নের আলোতে আমায় স্তব্ধ করে নিয়ে এলো। বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি মনের গভীর অন্তস্থল পর্যন্ত আলোয় ভরিয়ে রেখেছিলো। অভ্যেস বশত একবার বিচারে বসেছিলাম ঠিক ভুলের দণ্ড হাতে। আমার গভীর ভালোলাগায় তা অনন্য ভাবে আমার কাছেই ফিরে এলো। দিতে আমি সবসময় ই খুব ভালোবাসি। কিন্তু ওই সামান্য একটা নরম পাপড়ির আলগোছ আদর দিতে পারার মধ্যে যে এত ভালোলাগা লুকিয়ে থাকতে পারে, ওই সুন্দরকে হাতে তুলে দিয়ে যে এমন পরিতৃপ্তি আসবে, এত প্রশান্তি, ভাবিনিত কখনো। বুঝিনি তো তা।

মনে হলো, ভরা গঙ্গার ছলাৎ ছলাৎ শুনতে পেলাম। গীতবিতানের পাতার পর পাতার এক একটা শব্দরাশি যেন নানান ভাবে নানান ছন্দে সুরে সুরে আমার চারপাশে এক অদৃশ্য মায়াজাল রচনা করে রাখলো। মনে হলো, ওই নীল অপরাজিতা আর ওই বুড়ো লোকটার সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমি যেন আমার সমস্ত না বলা কথাকে বলতে পেরেছি। সময়ের নিয়মে হয়তো একদিন পথ দুই পথিককে এক পথে কিছু সময় পাশাপাশি হেঁটে যেতে দিলো। এরপর হয়তো আবার পথের ই নিয়মে তা আলাদা করে দেবে ওই দুই মনকে। কিন্তু তবু ওই বুড়ো লোকটার অমোঘ সৃষ্টি তখনো সেতু হয়ে থাকবে সব কিছুর মধ্যে। হয়তো হলুদ আলোর নিচে বসে ওই বইটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আর কেউ নদী বলে ডেকে উঠবেনা। খোলা চিঠি, গোলাপওয়ালার হাত ধরে গোলাপের গন্ধ নিয়ে একরাশ জুঁই ফুলের নরম ইচ্ছে হয়ে পরে থাকবেনা হয়তো আর। হয়ত ওই অভ্যেস গুলো তখন আর দরকার হবেনা কারোর।
তবু আজকের যা কিছু তা তো আজকের ই। আমি জানবো এ আমার অনেক গভীরের খুব শান্তির আর ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ। এর মধ্যে আর যাই থাকুক কোনো মিথ্যের আবডাল নেই, নেই সত্যি গোপনের প্রয়াস। নেই কোনো বাঁধনের বাড়াবাড়ি বা অধিকারের দমবন্ধ তা। তুমি থেকো, তোমার মতো করে। যেদিন মনে হবে, সব ফেলে চলে যেও। তবু আজকের যা কিছু তা আজকের ই। মিথ্যে দিয়ে মনভোলানো র প্রয়োজন যেন কখনো না হয়ে পরে। আজকের অভ্যেস যেন কালকে রাস্তা না রোধ করতে আসে। প্রার্থনা করি স্বপ্ন দেখতে যেন আমি চিরকাল পারি। আর আজ আমার ওই স্বপ্নের একফালি তোমার কাছে পৌঁছে দিলাম। যেখানের আকাশ সবসময় নীল, শিরশিরে দখিনা বাতাস, শিলং পাহাড়ের মতো ঘন গাঢ় সবুজ আর জ্যোৎস্নার মতো স্নিগ্ধ। সেই সবটুকু আমি পৌঁছে দিলাম তোমার কাছে।
সময়ের সাথে সাথে আমাদের বোধ হয় উন্নত, পরিণত। আমরা তখন আমাদের না পূরণ হওয়া ইচ্ছেগুলোকে আর পুরান করার জন্যে না দৌড়ে, তাকে ভবিষ্যতের হাতে গচ্ছিত রেখে দি। আর প্রতিদিনের টানাপোড়েনে ওই যে সবার অলক্ষ্যে যে বসে আছে, সেই লোকটা যখন হটাৎ করে জোয়ার এনে দেয় , ভাসিয়ে দেবার সমস্ত উপকরণ সামনে রেখে মুচকি মুচকি হাসে, তখন যদি ভেসে না গিয়ে আমরা ঠিক আজকের মতোই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তার উচ্ছলতা দেখি। আর হাসিমুখে হাতে হাত রেখে একে অপরের অনুভবের মধ্যে অসংখ্য সুন্দর মুহূর্তের সঙ্গে আরো কিছু সুন্দর মুহূর্ত মিশিয়ে দি, তখন একদিন যখন ফিরে তাকাবো তখন জানি অজস্র ভালো খারাপ স্মৃতির মাঝে শুধুই ওই সুন্দর মুহূর্ত গুলো আমাদের ঠোঁটের ওপরে হাসির রেখা এনে দিয়ে যাবে। আর সেদিন ইচ্ছেপূরণের চাবিকাঠি হাতে আসুক বা না আসুক, সেদিন আমরা যত্ন নিয়ে খুব ভালোবেসে আজকের দিনের এই সমস্ত সুন্দর মুহূর্তকে ভাববো। হয়তো একসাথে, হয়তো আলাদাভাবে। আর ওই বুড়োলোকটার সৃষ্টি গুলো পরে থাকবে আমাদের মাঝে। তাবলে ভেবোনা যেন তুমি নিজের অযত্ন করতে পারবে, ওই যে সবুজ পাতা গুলো? ওগুলো কিন্তু মোটেও আমাকে মনে করানোর জন্যে নয়, ওগুলো শুধুই একজনের খোঁজ নেবার জন্যে। ওগুলো সামনে থাকলে আমি জানি, জল না নিয়ে একজন বেরোতেই পারবেনা। পারবেনা খাবার না খেয়ে অযত্ন করতে নিজের। আর সাবধানে রাস্তা চলতেই হবে তাকে। রাতে স্নানের পরে ভালো করে মাথাও মুছতেই হবে।
আর এইভাবেই আমাদের এই "বন্ধনহীন গ্রন্থি" দিয়ে এক অমোঘ বাঁধনে বাঁধলাম তোমায় আমি আজ। যাতে তুমি পাবে তোমার খোলা আকাশ, উড়ে বেড়াবার অবাধ গতি। তবে দিনশেষে ক্লান্তি এলে, থাকবো আমি দুহাত বাড়িয়ে। আর বাকি যা কিছু সব রইলো আমার বৃষ্টিস্নাত নীল অপরাজিতা আর ওই একটা বইয়ের মধ্যে। ঠিক যেভাবে ওই শুকিয়ে যাওয়া নরম পাপড়ি গুলোকে তুমি তোমার আদোরে জীবন্ত করে রেখেছিলে, সেইভাবে রেখো সবকিছু প্রাণবন্ত করে। আর অপরাহ্নের আলোতে তোমার কাছে, আমার কাছে গলে গলে পড়ুক আমাদের চিকন সবুজের মাঝে রক্ত নীল সোহাগ। আর খুব আদোরে, ভালোবাসায়, নরম হয়ে তোমাকে জড়িয়ে থাকুক তা। 

Sunday, 5 August 2018

ঐকান্তিক

সন্ধ্যে বেলাতে আমি সাধারণত কক্ষনো ঘুমাইনা। ঘুমোলেই কেন কিজানি ওই ঘুম চোখ খুলে দেখা অন্ধকার আমার মনে এক অদ্ভুত ভয় আর মনখারাপ নিয়ে আসে। তাই কখনো ঘুমাইনা। কিন্তু আজ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। নিচের ঘরে টিভি চলছিল, সিরিয়াল। মা দেখছিলো। তাই ওপর ঘরেই শুয়েছিলাম। একটা ফোন আসতে হটাৎ ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার ঘর। খোলা কাঁচের জানালা দিয়ে আধো আলো ছায়া, গ্রিল আর গাছের পাতার প্রতিচ্ছবি নিয়ে দেওয়ালে, মেঝেতে আঁকিবুকি কাটছিলো। কেমন একটা ভয় আর মনখারাপ এ হটাৎ চোখ দুটো জ্বালা করে উঠলো। গলার কাছটাতে কিসের একটা দলা সমস্ত মনটাকে আচ্ছন্ন করে দিলো। মনে হলো, কাঁদি , অনেক কাঁদি। কিন্তু ওই যে, জানিত যে আনন্দের মতো মনখারাপ ও একটা নেশার মতো, শেষকালে মনখারাপ করতে করতে এমন প্যানপ্যান করতে থাকবো যে সে আর শেষ ই হবেনা। তাই উঠে বসলাম।

ওই যে একজন মানুষ, যাকে আমি সবসময় মিস করি, যে মানুষ টা এসে যদি একবার মাথায় হাত রাখতো, তাহলে কোথায় সব মনখারাপ ভেসে চলে যেত, যে তার মান্তুর এতটুকু মনখারাপ, এতটুকু চোখের জল সহ্য করতে পারতোনা। সেই সেবারেও, মনোবিকাশ এ কি একটা প্রবলেম চলছিল, মনখারাপ ছিল আমার। বাড়ি ফিরতেই বাবা কোথায় আমার প্রিয় মেনি কে এনে আমার কোলে দিচ্ছে, কোথায় টিভি তে ছোট ভীম চালিয়ে দিচ্ছে আবার কোথাও বা মাকে বলছে, দেখোনা ও কি খাবে। সেই আকুলতা, কারোর মনখারাপ এ এইরকম আকুল হয়ে মন ভালো করার চেষ্টা, হটাৎ এক প্রায় অচেনা অথবা খুব চেনা এক ছোট্ট মানুষের মনখারাপ এর কথা আমার মনে এনে দিলো। মনে হলো ইশ যদি এখুনি কিছু ভাবে ওই ছোট্ট মানুষটার মন ভালো করে দেওয়া যেতে পারতো। জানিনা কেন আর কিভাবে আমার নিজের মনের ওঠা পড়ার সাথে আমি ওই এক ছোট্ট অচিনপাখির মনের কোথাও এক যোগ খুঁজে পাই। শুধু নাম এর মিল ই কি এই মেল্ এর জন্যে দায়ী? কি জানি। জানিনা। নাকি সেই অনেকদিন আগে আমার বাবার অংকের মাষ্টার মশাই, আমার সম্পর্কে আমার বাবা কে বলা সেই কথা? সেইটাই সত্যি? কি জানি। তখন আমি মাধ্যমিক দিয়েছি, বাবা ওনার কাছে নিয়ে গেছিলেন। কি শান্ত সৌম্য মূর্তি। কাছে গেলেই মনে হয়, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি। উনি আমার সাথে অনেক কথা বলেছিলেন। আর পরের সপ্তাহে বাবাকে ডেকে বলেছিলেন, তোর এই মেয়ের মধ্যে এক স্বভাব মা বসে আছে। বিশ্বজননী। বাবা হাসছিলো, বলছিলো আমার কুকুর বেড়াল, ছাগল ছানা ঘাঁটার কথা। উনি বলেছিলেন, শুধুই তা নয়, এই সময়ে যে ভয় থাকে, তোর মেয়ের জন্যে সেই ভয়ের কোনো দরকার নেই। ওর সারল্যের সুযোগ নিয়ে হয়তো অনেকে ওর কাছে আসার চেষ্টা করতে পারে, কারণ বয়সের তুলনায় অনেক বেশি সরল ও, কিন্তু ক্ষতি করতে পারবেনা। ওই যে ভেতরে বসে থাকা ওই জননী, সে ঠিক সময়ে বুঝে গিয়ে বেড়া দিতে পারবে। তোর মেয়ে বেড়া দিতে জানে। কথাগুলো হয়েছিল আমার সামনেই। ছোট থেকে মা এর কড়া শাসন ছিল, কখনো সামনে ভালো বলতোনা। তাই ওই সব প্রশংসা শুনে খুব লজ্জা হচ্ছিলো, তাড়াতাড়ি সেখান থেকে পালিয়ে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু সেই প্রশস্তি , বলতে গেলে সেই প্রথম এত বেশি প্রশস্তি সামনে বসে থেকে নিজে শুনলাম। তাই বোধয় কখনো ভুলিনি। আর মাঝেমাঝেই যখন বাবাকে খুব মিস করি বা কোনোকারণে ঠিক ভুল হাঁতড়াই , তখন ওই কথাগুলো মনে পরে, ওই কথাগুলোকে আঁকড়ে যেন আমি রাস্তা পাই, ঠিক টাকে চিনে নিতে পারি। আত্মবিশ্বাস এ আবার উঠে দাঁড়াতে পারি।
বাবাকে সবসময় ই খুব মিস করি। যখন এক হল ভর্তি লোকের সামনে presentation দিতে উঠি, তখন শুধু ওই একটা স্নেহ দৃষ্টির জন্যে বড় আকুল লাগে; বাড়িতে যখন প্রথম পিএইচডি এর থিসিস নিয়ে ঢুকেছিলাম বা সেই খুব শীত এ যখন আগাগোড়া গরম জামাকাপড়ে মুড়ে পিএইচডি ডিফেন্স করে নামতেই মা বলেছিলো, আমার এই তুলোর বল টা এত ইংরাজি তে কথা বলতে পারে? তখন মা মুখে ওই আদরের কথা শুনে খুব লজ্জা পেয়েছিলাম, আনন্দও। কিন্তু চোখ আর মন খুঁজছিলো শুধু একটাই হাসি মুখ। মা এর পাশে সেই একজনকেই খুব খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো। বাবা থাকলে শুধু আমাদের চোখে চোখে হাসি বিনিময় হতো। ওই হাসির ভাষা শুধু আমদের দুজনের। আমরা দুজনেই জানি ওই ভাষার মানে। ওই একটা হাসি মুখের জন্যে কাহন কখনো সব শূন্য মনে হয়। সেই যে, সবসময় যে মানুষটার হাত ধরে রাস্তা পার হয়েছি। সেই মানুষটা তো জানতেই পারেনা এখন তার মান্তু কত বড় হয়ে গেছে , একা একা কারোর হাত না ধরে, কত রাস্তা সে পার হতে পারে এখন। কতবার আমার বন্ধুবর টি বলে, আর কবে একা রাস্তা চিনবি? আর কবে একা একা যাবি। এখন তো সত্যি ই আমি কতকিছু একা একা করি।

গতকাল সন্ধ্যে থেকে মনের মধ্যে এক অদ্ভুত মনখারাপ বারবার চিনচিন করে উঠছিলো। আর সেই চিনচিনে ব্যাথা সমস্ত রাত্রি, ঘুমের মধ্যে, চোখের জলের মধ্যে দিয়ে জানান দিয়ে যায় তার উপস্থিতি। আজ সকালে রাস্তায় বেরিয়েও সে পিছু ছাড়েনি, সঙ্গে ছিল সমান তালে। আর তাই যখন সাঁত্রাগাছিতে নেমে উবের বুক করতে যাবো, তখন হটাৎ মনে হলো, সবার মধ্যে যাই। within  crowd . দিল্লিতে মেট্রোতে গেছি অবশ্য। তবে, আমি কোনোদিন ই কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এ যাইনি।  এমন কি শেয়ার পর্যন্ত কখনো করিনা। শুধু আমি কেনো খুব কম লোক ই দিল্লিতে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এ যায় বোধহয়। কিন্তু কোলকাতা তে এলে কেন কিজানি, একটা এমনি ট্যাক্সি করতে গেলেও আমি থমকে যাই। কিজানি, হয়তো এটা আমার নিজের জায়গা, ভরসা টা এখানে অনেক বেশি? তাই জন্যে? বা আরো একটা প্রচ্ছন্ন কারণ ও থাকতে পারে, কোলকাতাতে যখন একসময় নিজের পা এ দাঁড়াবার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তখন হাতে এই এত টাকা ছিলোনা। তখন সাঁতরাগাছির ওই সাদা সাদা বাস গুলোতে করেই আমি যেতাম। তাও ওই বাস গুলোকেও আমার বিলাসিতা লাগতো, বাবা জোর করে ধমক দিতো তাই ওই বাস গুলো করতাম। আর আমার ভিড় এ যাতায়াত করতে কষ্ট হতো। ঐটা নিয়ে বাবার খুব টেনশন ছিল, তাই বাবার কথা মানতাম। আর ট্রেন তো ছোট থেকেই আমার অভ্যেস, কারণ আমাদের এই ছোট্ট খুব ছোট্ট জায়গাটাতে কোনো বাস ৰূট এখনো হয়নি। এইভাবেই আমার বড় হওয়া। সবার মাঝে, সবার কষ্ট দেখে, সেটার অনুভব ভেতরে দিয়ে অথচ আবার খুব আলাদা ভাবে আমাদেরকে আমাদের মা বাবা বড় করেছে। এখন সেটা বুঝতে পারি। যখন ট্রেন এ বাস এ , নিজেদের পাড়ায় বা নিজের প্রফেশন এ চারপাশের মানুষের চোখে একটা এক্সট্রা সম্ভ্রম দেখতে পাই, যখন একটা একটু বেশি attention, একটু বেশি cautiously, একটা অন্য respect  নিয়ে মানুষ কথা বলতে এগিয়ে আসে, তখন বুঝি এ আমার মা বাবার দান।

যাই হোক, বাস এ গিয়ে উঠলাম। সেই সাদা বাস গুলো। প্রথম দিকের লেডিস সিট টাতে গিয়ে বসলাম। সামনে বাঁ দিকে যে বসার জায়গা, সেখানে একটা ছোট্ট ছেলে, কত বয়স হবে, হয়তো এই চার বছর মতন, তার মা এর কোলে বসেছিল। অনেক ক্ষণ থেকেই দেখছিলাম, চোখে কাজল কপালে কাজলের টিপ্ পড়া ওই পুচকেটা আমাকে এক দৃষ্টিতে মা এর কল থেকে ঝুঁকে ঝুঁকে দেখছে। চোখাচোখি হতেই আমার হাসির প্রত্যুত্তর ও দিলো সে, এক গাল হাসি দিয়ে। আড়চোখে দেখলাম। খুব অবাক হয়ে ও একবার আমার দিকে দেখছে, র একবার আমার হাত এর ঘড়িটা। বুঝলাম বড় ডায়াল টা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আস্তে করে একবার ছুঁলো , তারপর আবার দেখতে থাকলো। কিজানি কি দেখছিলো, ভাবলাম হয়তো এমন বিসদৃশ জিনিস ও আর দেখেনি, হাতের পলার পাশে এই এত্তবড় ডায়াল টা তাই বারবার দেখছে ওই ছোট্ট মানুষটা। তারপর আর একটা অদ্ভুত জিনিস করলো পুচকেটা। বাস তখন সেকেন্ড ব্রিজ এর ওপরে। আমি বাইরে দেখছিলাম। হটাৎ দেখলাম, হাতের ওপরে একটা আলতো স্পর্শ। চমকে তাকিয়ে দেখি, ওর ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুল দিয়ে আমার বাম হাতের ওপরটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। খুব সন্তর্পনে, সাবধানে। আমার মুখের দিকে তাকালো, আমার মুখের অবাক হাসিটাতে রাগ নেই বুঝে, একটু সাহস বাড়লো বোধহয়। অন্য সব আঙ্গুল গুলো তো ওর তুলনায় অনেকটাই বড় , তাই বোধহয়, কড়ে  আঙ্গুল টাকেই হলো পছন্দ। আলতো করে প্রথমে হাত দিলো, আর তারপরে আঙ্গুলটাকে ধরে রাখলো, সেই এক্সসাইড পর্যন্ত। আস্তে করে শিশুহাত সরিয়ে যখন নেমে যেতে হলো আমায়, তখন নামার সময় ও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলো। আমি নেমে হাঁটতে থাকলাম। পরে নেমে গিয়ে ভাবলাম, হয়তো কোলে নিলে ভালো হতো, কিন্তু হাত বাড়াইনি। কেন কিজানি। আমার কোলে ব্যাগ রাখা ছিল, তবু নেমে মনে হলো, কেন হাত বাড়ালামনা, হাত বাড়ালেই হয়তো আসতো, কিন্তু বাড়াইনি। ও ওর মা এর কোল এ থেকেই আঙ্গুলটা ধরে রইলো। আর আমিও নিজের জায়গায় থেকেই ওর ওই ধরে রাখাটাকে অনুভব বা উপভোগ করেছিলাম। ঐটুকুই হয়ে রইলো আমাদের পরিচয়। ঐটুকুতে আমার ওই আঙ্গুলটাকে জড়িয়ে রেখে কি ভাবলো আর কি পেলো ওই শিশুমন, আমি জানিনা। তবে এক অর্থবহুল আনন্দে আমার মন ভরিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে গতকাল রাতের মনখারাপ এর মেঘলা আকাশে সূর্য্যের হাতছানি দেখা দিতে থাকলো যেন। বুঝলাম, গন্তব্য এসে গেলে চলে যেতে হবে সবাইকেই। তবে ওই গন্তব্যে পৌঁছনোর কিছুটা পথ যদি কারোর সাথে একসাথে চলার থাকে, তাহলে সে পথ এর অনুক্ষণ গুলোর সবটুকু ভালোলাগা ওই পথিকের, দুই পাঠসাথীর। 

ঠিক করলাম, আজ একা একা ভিড়ের মধ্যে হাঁটবো। দিল্লিতে কিছুদিন আগে যেমন সরোজিনীতে ঘুরেছিলাম। সেইরকম।  তবে এটাতে গন্তব্য আছে। আর সেটা ছিল শুধুই ঘোরা। যাই হোক, দিন চলতে থাকলো। আমি বাস, মেট্রো তারপর আবার বাস এর পরে গন্তব্যে পৌঁছলাম। ক্লান্ত লাগেনি একটুও। অচেনাও না। যাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, সেই কি ভালো করে রাস্তা বলে দিলো। এখানে কাকু, জেঠু বলে এখনো কথা বলা যায় দেখলাম। দিল্লির মতো কথায় কথায় excuse me বলার দরকার হয়না। এখনো বাস যেখানে ইচ্ছে হাত দেখালেই থেমে যায়, stoppage এর তোয়াক্কা না করেই। যদিও সেটা সর্বত্র খুব নিন্দনীয়, তবু আমার তো বেশ ভালো লাগলো। বেশ প্রাণ আছে এখনো মনে হলো। রাজাবাজার থেকে কলেজ স্ট্রিট যাবার ছিল, তাড়া ছিল, তাই উবের ই করেছিলাম। কিন্তু বোকার মতো লোকেশন দিয়েছিলাম শুধুই কলেজ স্ট্রিট , তাই অনেকটা আগেই অন্য একটা রাস্তায় নামবে হলো। যদিও ওখান থেকে ২ মিন এর হাঁটা পথ বললো, কিন্তু আমার অবস্থাতো তথৈবচ, তাই, সেইটাই নিলো প্রায় ১০ মিন, যেতে যেতে দেখলাম পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে, মাত্র ৫টাকায় একটা এত্তবড় পেয়ারা। বিটনুন দিয়ে পেয়ারা খেতে খেতে হাঁটতে থাকলাম। ট্রাম রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলাম। আঃ কি মিষ্টি পেয়ারা ছিল, কি সুন্দর পেয়ারা খেতে খেতে হাঁটা যায় এখানে। বন্ধুবর টি থাকলে নিশ্চই বকুনি খেতাম আমি, কিন্তু আমি খুব জানি, ওই এইটুকু ধুলোবালি মাখা খাবার খেলে আমার কিছু হবেনা। বরং এইভাবে একা একা এইভাবে পেয়ারা খেতে খেতে রাস্তা হাঁটাটা না গেলেই আপসোস হতে পারতো পরে। ইউনিভার্সিটি র গেট এ এসে দেখি ফুচকা, একটু লোভ সামলালাম। কিন্তু কাজ শেষ করে বেরিয়েই শুরু করে দিলাম ফুচকা। খিদের মুখে পেয়ারা আর তারপর ফুচকা পেটের মধ্যে যাই তৈরি করুক না কোন , আমার গোটা দিনটাকে যেন এক অন্য আনন্দের স্রোতে ভাসিয়ে দিলো।

কলেজ স্ট্রিট আমার সবসময় ই খুব ভালো লাগে, দুপাশে অজস্র বই, নতুন পুরাতন মিলে মিশে কেমন এক অনন্য গন্ধ। হাতে সময় ছিলোনা আজ বেশি, এর পরের দিন এলে একটু বই দেখে যাবো। কত মানুষ চলছে। কত ছেলেমেয়ে। নতুন নতুন প্রেমের নেশা। হালকা চাহনি, একটু আলতো দেখা। বেশ লাগলো আশপাশের ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ওই মুখগুলোকে। আমার একটা অনেকদিনের ইচ্ছে আছে, ইচ্ছে পূরণ হয়নি এখনো। একটু ইতস্তত করে রাখলাম লিখে ওই ইচ্ছে খাতার পাতাতেই। সেটা হলো, পড়ার বইয়ের তাড়াতে নয়, মনের তারণাতে, আর ভালোলাগার তাগিদে, ওই অজস্র বইয়ের মধ্যে দিয়ে, কোনো বিশেষ কারোর হাত ধরে খুঁজবো কোনো প্রিয় বই। নতুন, পুরোনো বিভিন্ন বই এর মিশ্র গন্ধ এসে লাগবে আমাদের নাকে। আর তারপর এক কাপ কফির সঙ্গে কাটবে কিছুক্ষন। ওই কফিহাউসে বসে, নাহয় তর্কের ঝড় উঠুক, গল্পের আবেগ আর প্রাণের আনন্দে সুর মেলাক প্লিঙ্ক ফ্লয়েড, কাটি মেলুহা বা ওই বুড়ো লোকটা। মনে রাখার মতো, কিছু মুহূর্ত তৈরি হোক। আর আমরা বারবার ওই মুহূর্তে বাঁচি। বারবার জেগে উঠি। বারবার খুঁজি সুর। আর তারপর জীবনের প্রতিটা সুর, তাল, ছন্দ এক হয়ে মিশে গিয়ে যেন একাকার হয়ে মেলবন্ধন ঘটায়।
প্রেসিডেন্সির গেট এর সামনে একটা কদম গাছ আছে, আর তার একটু পরে বোধয় বকুল ওটা। দুটো গন্ধই নাকে এসে আমাকে উন্মনা করে দিয়ে এই স্বপ্নজাল বোনাচ্ছিলো। জাল ছিন্ন করলামনা, কিন্তু সময়ের হাতেতো বন্দি আমরা সবাই, তাই এগিয়ে চললাম। মনের মধ্যে রইলো এক স্থির, নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দ। এক নিশ্চিত শান্তি। আর অনন্ত ভালোলাগা। কারোর প্রতি কোনো অভিযোগ, কোনো অনুযোগ কিছু মাত্র নেই। কোনো আশাও নয়। আজকের এই আমার একলা ভ্রমণ একান্ত ভাবে আমাকেই আবার চিনিয়ে দিয়ে গেল। আজ দিন শুরু করেছিলাম, বুকের ভেতরে এক চাপা কষ্ট নিয়ে, কিন্তু দিন  শেষ করলাম এক অনাবিল আনন্দ নিয়ে। এটাই আমার পাওনা। হয়তো এটাই আমার সাধনাও। 

Thursday, 2 August 2018

মাছরাঙা

একটা ছোট্ট মাছরাঙা, যার ডানার ভেতরটা নীল, গাঢ় নীল রঙের। যখন উড়ে যায়, তখন সেই নীল, গাঢ় , মনভোলানো নীল রং চোখে পরে। আর যতক্ষণ কাছে থাকে, যেন চুপ করে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকে সমস্ত অনুক্ষণ। আমার কাছের সময়, যে সময়টা আমরা পেরিয়ে চলেছি, হটাৎ হটাৎ করে যেন সব ভাষা হারিয়ে ঐরকম ধ্যানমগ্ন হয়ে যায়। কথা ছিল কি? বলার ছিল কিছু? ছিল কি কিছু টানা পোড়েন ? কিছু বোঝাপড়া? হিসেব? ছিল হয়তো, কি এসে যায় তাতে। সেইসব জটিলতা, ওই ভরাগঙ্গার জোয়াড়ে যেন কোথায় ভেসে চলে গেল। মনে এলোনা আর। শুধু মনে হলো, এই ক্ষন, এই একটা একটা মুহূর্ত যেন ওই ভরা বর্ষার যৌবনমতী ধরিত্রীর মতো খুব স্নিগ্ধ, সবুজ হয়ে, তার সমস্ত আকুলতা নিয়ে বয়ে চলেছে। সেই আকুলতা কখনো কখনো অবোধ ইচ্ছে হয়ে ঢেউ তুলে দিয়ে যায় , আবার কখনো কখনো শিশুর আবদারে আদুরে নরম দুপুরের মতো হয়ে ছায়া চায়। সেই চাওয়া, সেই আকুলতাকে স্নেহে জড়িয়ে রাখা যায় কিন্তু ভুল বোঝা যায়না। 
আমার সেই চেনা মাটির গন্ধটা যেদিন থেকে পেয়েছি, সেদিন থেকেই এই চেনা আকাশ আমাকে প্রাণ ভরে বৃষ্টির শব্দ শুনিয়েছে। সেই বৃষ্টিতে চারপাশের চিরপরিচিত ছোট খাটো খাল বিল নদী সবাই যেন নবযৌবন ফিরে পেয়েছে। সেই নবযৌবনমতী নদীকে আজ কাছে থেকে দেখার কিছু মুহূর্ত এলো বীরপুরুষের হাত ধরে, ঘোড়ায় চড়ে। প্রাণ ভোরে দেখলাম সেই ভরা গঙ্গার উথাল পাথাল আজ নেই। ভাঁটা তো নয়, জোয়ার চলছিল যে...তাও , দুকূল ছাপিয়ে বয়ে চলা স্রোতসিনী কেমন ভাব গম্ভীর হয়ে বয়ে চলেছিল। চলার বোধেই শুধু নয়, যেন পরম মমতাতেও , চারপাশের সমস্ত কিছুকে বুকে করে নিয়ে এগিয়ে চলেছিল। সেই ভেসে চলা কচুরি পানা , আরো কত হাজারো জঞ্জাল, যাকে দেখে আমরা দূরে সরে যাই, নদী  কিন্তু তাকে ফেলে দেয়না , তাকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলে, আবার নতুন স্রোতে মুছিয়ে দেয় পুরোনো সব গ্লানি। আবার ভেসে চলা। চলার নিয়মে। 
সেই ভেসে যাওয়া, কিরকম যেন অদ্ভুত ভাবে আমার চারিদিকে ঘোর তৈরি করতে লাগলো। চিরপরিচিত হাওড়া ব্রিজ আর হুগলী সেতুকেও নতুন লাগছিলো। কেন লাগছিলো জানিনা, এখন সেটা খুঁজবোওনা। তবে ওই নদী যেন ওই মাছরাঙার হাত ধরে আমাকে কিছু কথা বলে গেল,  যেন কিছু মুহূর্ত তৈরি করে দিয়ে গেল। আর যেন বলে গেল যে আমাদের চারপাশে তৈরি হওয়া প্রতিটা মুহূর্তকে গ্রহণ করতে। প্রত্যেকটা মুহূর্ত আলাদা আলাদা গন্ধ নিয়ে আসে। এর ই নাম কি মুহূর্তে বাঁচা? কিজানি। জানিনা। তবে ওই যে আজ আবার সেই কথা কটা মনে হলো, আমাদের নিজেদের ইচ্ছেতে তো এই সংসারে গাছের একটা পাতাও নড়েনা , তাহলে কেন আমরা মিছেই ভেবে মরি। সময়ের সাথে সাথে যা চলে যাবার, তা ঐরকম ই ভেসে চলে যাবে। চাইলেও যাবে, না চাইলেও। আবার যা আসার তা আপনি সঙ্গে থেকে যাবে। জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গি ভাবে কখন জড়িয়ে যাবে। কিভাবে, আমরা তা এতটুকু টের ও হয়তো পাবনা। আপনা হতে আমার সব ভাবনা কোথায় হারিয়ে যেতে চাইলো। কঠোরতার হাত ধরে কখনো তাকে জোড় করে ধরে রাখার চেষ্টা ও করলাম বা। তারপর একসময় সবকিছু কেমন স্থির শান্ত হয়ে গেল। বৃষ্টিভেজা পৃথিবীতে ঘোর লাগলো আবার। কথা তখন বাহুল্য হয়ে গেল। ভাষা পেলোনা তার ঠিক সুরটা। কথা বললেই তখন তা মনের সমস্ত ভাবকে গোপন করে শুধু রোজকারের রোজনামচা হয়ে যাচ্ছিলো। তাই শব্দ কে ছুটি দেওয়া হলো। সামনে তখন শুধু একটানা ভেসে চলার আহ্বান। মাথার ওপরে শঙ্খচিলের উড়ে চলা। ভেসে যাওয়া ডিঙি নৌকার স্বপ্ন দেখার হাতছানি। আর ভরা গঙ্গার মমতা মাখানো মৃদু হাসি। 












ইচ্ছেনদী

আমার ল্যাব টা মাউন্ট sinai এর ১০ তলায়, আর আমার ওয়ার্কিং ডেস্কটা একদম জানালার ধারে , বিশাল জানালা। মনে হয় মেঘ গুলো এখুনি ঢুকে পড়বে এর মধ্যে। ...