জ্যোৎস্না রাত। চাঁদের ওই অর্ধচন্দ্রের থেকে আর একটু বেশি তাকানো টা মনে করিয়ে দিলো, কিছুদিন আগের শোনা ঝুলন পূর্ণিমার কথা। আর ঠিক দুদিন পরেই সেই পূর্ণিমা। শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, এই সবুজ আদিগন্ত এর জ্যেৎস্নাস্নান দেখতে দেখতে কেমন যেন খুব শান্ত লাগলো। সামনে জঙ্গলের থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝি পোকার ডাক, ডিড ইউ ডু ইট পাখির হটাৎ চমকে দেওয়া, আমার অন্ধকার রাতের ব্যালকনি টাকে ভীষণ এক মুগ্ধতায় মুড়ে দিতে থাকলো। চুপ করে, একেবারে শান্ত করে এই মুহূর্ত গুলোকে সর্বান্তঃকরণে শুধু অনুভব করতে লাগলাম।
সামনের পূর্ণিমা যখন আসবে, তখন আমি আর মনে হয় থাকবোনা আমার এই ব্যালকনি টায় দাঁড়িয়ে। জ্যোৎস্না ভেজা রাত কি এমন করেই আসবে? এই ব্যাল্কুনিটাতেও কি অন্য কেউ দাড়াঁবে? এইরকম পাগলের মতো না ঘুমিয়ে চাঁদ দেখবে, পাছে চাঁদ হারিয়ে যায় বলে? সত্যি কি বোকা বোকা সব কথা বলিনা? এই জন্যেই এত বকুনি খাই। কারোর জন্যে কি কিছু থেমে থাকে না থিম থাকা উচিত। আমরা সবাইতো নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্যে, আমাদের ওই সময়টুকুর জন্যে আমাদের জন্যে রাখা কাজটুকু শেষ করতে আসি। আমার বলে কি কিছু হয়, যে সব সময় আমার বলি? আমার ঘর, গাছ, আমার চাঁদ, জ্যোৎস্না রাত, শীতের শিশির, চাঁপার গন্ধ। কিছুই যে কারোর নয়। খুব স্বার্থপর তো আমি। শুধু আমি আর আমি। এইটুকু লেখার মধ্যে কতবার বললাম, আমি আমি আর আমি। তাইনা? আচ্ছা, এত জানি, তবু আমার বললাম কেন একে। যা আমার কিছুই নয়, তার ওপরে এত অধিকার বোধ দেখাই কেন ? এতো আমার ভারী অন্যায়, আমার এই একান্ত স্বভাব বিরুদ্ধ কাজে শুধু যে কিছু অভ্যাস এ বাঁধা পরে চলেছি সবাই। এরপর হটাৎ যদি কেউ এসে বলে, কোন অধিকারে তুমি এত অধিকার দেখাও? কি বলবো আমি তখন? একবার মনে হলো, বলি, বেশ করেছি, ওই চাঁপারা তো রোজ ই ফোটে, ওই আকাশ তো রোজ লালে লাল হয়ে জাগায় আর চাঁদনী রাত ও তো এক ই ভাবে ঘোর লাগায়, তুমি কেন মাখলেনা ওই চাঁদের আদর। তাইতো ওই আদরের লোভে আমি জেগে আছি আজ।
কিন্তু না, এ যে শুধুই কথার পৃষ্ঠে কথা জোড়া হবে। আমার বলে যে সত্যি ই কিছু হয়না। বড় ক্ষনিকের এই সব কিছু। সমস্ত কিছুর মধ্যেই হয়তো আমাদের সমস্ত স্বত্বা লীন হয়ে থাকে, মিশে থাকে। তাই আমি সবের মধ্যেই আছি কিন্তু আমার কিছুই নয়। বিশ্বজোড়া শুধুই যে মায়ার ফাঁদ। তবে এ মায়া থেকে আমি পালাতে চাইনা, চাইনা এ মায়া ছিন্ন করতে। সংসারের মধ্যে থেকে আমি এক খুব সাধারণ নারী হয়ে সবকিছুর মধ্যে থেকে মায়া খুঁজে নিতে ভালোবাসি। সুখ নয়, দুঃখ নয়, যেন এই সুন্দরের কাছে ম্লান হয়ে যায় সমস্ত চাওয়া পাওয়া। শুধু মনে হয় এই মায়ায় যেন এমনি করে আজীবন সবকিছু সবসময় সুন্দর হয়ে সবাইকে জড়িয়ে থাকুক। আর এই নিস্তব্ধ রাতের গভীরতার সাথে একাত্ম হয়ে গিয়ে মনে মনে আবৃতি করতে ইচ্ছে হয় স্বামীজীর সেই বিখ্যাত শব্দ সম্ভার -
"ভ্রান্ত সেই যেবা সুখ চায়, দুঃখ চায় উন্মাদ সে জন—
মৃত্যু মাঙ্গে সেও যে পাগল, অমৃতত্ব বৃথা আকিঞ্চন।
যতদূর যতদূর যাও, বুদ্ধিরথে করি আরোহণ,
এই সেই সংসার-জলধি, দুঃখ সুখ করে আবর্তন।
পক্ষহীন শোন বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার
বারংবার পাইছ আঘাত, কেন কর বৃথায় উদ্যম?
ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল;
দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম-অগ্মিশিখা করি আলিঙ্গন।
রূপমুগ্ধ অন্ধ কীটাধম, প্রেমমত্ত তোমার হৃদয়;
হে প্রেমিক, স্বার্থ-মলিনতা অগ্নিকুণ্ডে কর বিসর্জন।
ভিক্ষুকের কবে বলো সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল ?
দাও আর ফিরে চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।
অনন্তের তুমি অধিকারী প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,
'দাও, দাও'-সেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান।
ব্রহ্ম হ'তে কীট-পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়,
মন প্রাণ শরীর অর্পণ কর সখে, এ সবার পায়।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।।"
আর আজ এখন আবার সেই খুব সত্যি আর খুব সুন্দর কথাটা মনে করে আজকের নিশিযামিনীকে বিদায় জানালাম ।
- asato mā sad gamaya,
- tamaso mā jyotir gamaya,
- mṛtyor mā amṛtaṃ gamaya,
- Om shanti~ shanti~ shanti hi~~
- Lead me from falsehood to truth,
- Lead me from darkness to light,
- Lead me from death to the immortality
- Om peace peace peace
আমাকে অসত্য থেকে সত্যের পথে আনো ,
আমাকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাও
আমাকে মৃত্যু থেকে অমরত্বের পথ দেখাও
ওঁম শান্তি শান্তি শান্তি
আমাদের চারপাশের সবকিছু, সমস্ত সম্পর্ক, যা কিছু পার্থিব বা অপার্থিব সব কিছু খুব সুন্দর। খুব সত্যি। হয়তো কখনো কখনো সময়ের টানা পোড়েনে তাতে তিক্ততার ছোঁয়া লাগে। হয়তো পারিপার্শ্বিকের চাপে তার মধ্যে অসুন্দরের ছায়া এসে পরে। কিন্তু এসব কিছুই এই চাঁদের কলংকের মতোই। ঠিক সময়ে, যখন জ্যোৎস্নায় চরাচর ভিজে নরম হয়ে যাবে তখন আর ওই কলঙ্ক চোখেই পড়বেনা, তার সবকিছু খুব স্নিগ্ধ, নরম আলোর মতো করে জড়িয়ে থাকবে আমাদের। কখনো তা চাঁদনী রাতের আদর হয়ে আমাদের রোমাঞ্চিত করে যাবে, কখনো তা দিন শুরুর নরম সোনালী রোদ্দুর হয়ে উজ্জীবিত করবে, কখনো বা কর্মরত মধ্যাহ্নের জানলা দিয়ে বাইরে দেখার আবেশ আনবে আবার কখনো তা দিনশেষে ঘরে ফেরার প্রিয় স্পর্শ দেবে। আর সমস্ত কিছুর মধ্যে বারংবার উপলব্ধি দিয়ে যাবে সেই গভীর স্নেহ, মমত্ব, ভালোবাসা আর শান্তির।
চাঁদ ঢলে গেছে, মালকোশের সুরের মতো, রেশ পরে আছে তার। আর বাতাসে আনমনে ভেসে বেড়াচ্ছে চাঁপার গন্ধ। শ্বেত শুভ্র পাপড়ির মাঝে হালকা হলুদ আলো দেওয়া নরম ভালোবাসা।
No comments:
Post a Comment