অপরাহ্নের আলোয় সেদিন আকাশে ঘোর লেগেছিলো। মেঘের আড়াল থেকে ঠিকরে বেরোনো সোনার টুকরো, গঙ্গার ছলাৎ ছলাৎ এর সাথে মিশে গিয়ে কেমন বাক্যহারা করে ফেলেছিলো। হটাৎ চোখে আসা সবুজ মনে করিয়ে দিয়ে গেল, ছোটবেলার মাধবীলতা আর অপরাজিতায় মোড়া আমাদের বাড়িতে ঢোকার সেই গেট টার কথা। অযত্ন রক্ষিত কিন্তু কি অপরূপ সুন্দর। চোখ বন্ধ করে বাড়ি বলে ভাবলেই প্রথমেই ভেসে আসে গেট এর কথা। আর তারপরেই মনে হয়, সামনের ঘরের সোফার ওপরে হাতে কোনো একটা বই নিয়ে পা দুটোকে ক্রস করে বসে আছে আমার বাবা। ঐভাবে বসাটা আমার বাবার থেকেই শেখা। চেয়ারে বসলে ঐভাবে। আর মাটিতে বা বিছানায় বসলে কখনো পদ্মাসনের ভঙ্গিতে কখনো বা ওই যে যেইভাবে সেতার বাজায় , সেইভাবে।
সেই দিনও মনে পড়লো ওই গেট এর কথা। গেট টা ঠেলে সত্যি ই কি কেউ ভেতরে এসে দাঁড়ালো। একে অপরের হাত ধরে, দুজনের ই কি অভিমানী মনের কোণে ঘুমিয়ে থাকা অজস্র ইচ্ছেরা হটাৎ ছেলেমানুষি সুরে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো? ছাতা না খুলে সেদিন গায়ে মাখলাম বৃষ্টির জল। বইয়ের গন্ধ নাকে নিয়ে আদর করে ঘরে আনলাম কিছু জানা কাহিনী, কিছু অজানা তথ্যের সম্ভার। আর কালো কফির গন্ধ আমাকে কেমন যেন বেহিসেবি করে তুললো সেদিন। দেয়া নেওয়া, জামাখরচ আর সব কিছুর হিসেব ভুলে গিয়ে শুধু শুনতে ইচ্ছে করছিলো। কিকথা? কিজানি। কিন্তু শুনলাম কত কথা। হালকা মজা, গল্প, কিছু সুর, আবার কিছু কাঠিন্যের আবডালে আবদার রক্ষার তাগিদ। অনুভব করলাম। আর এই সব কিছুর মধ্যে বোকার মতো সত্যি ই ভুলে গেলাম হিসেব। কর্তব্য। যে কর্তব্যে এই কয়েকবছর নিজেকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছি, কোনো কোথাও চুলচেরা হিসেবে এতটুকু শৈথিল্য যে কোনোদিন হতে দেয়নি, সেই আমি ই সেদিন সত্যি ই দেনা পাওনার সব হিসেব, কর্তব্য ভুলে চুপ করে বসে ছিলাম। আর তারপর অপরাহ্নের আলোয় ভেসে যাওয়া ডিঙি নৌকা, মনের মাঝে বয়ে চলা নির্বাক শান্তির সাথে মিশে গিয়ে আমাদের চারপাশের সমস্ত কিছুকে যেন এক অপরূপ বাঁধনে বেঁধে ফেললো। সেদিন ছিল ভাঁটা।
তবে সেই "বন্ধনহীন গ্রন্থি"র টান অনুভব করলাম, আজ। আজ ছিল ভরা জোয়ার। জোয়ারে উথাল পাতাল গঙ্গা আমাদের পাশ দিয়ে বয়ে যেতে যেতে খুব আদর মাখিয়ে সারাদিনের ওই কয়েকটা ঘন্টার মদিরাতা তুলে ধরছিল। ওই যে পায়ে পা মিলিয়ে রৌদ্রতপ্ত দুপুরে হেঁটে বেড়ানো। আড়চোখে দেখতে পাওয়া মাটির লস্যির ভাঁড়ে আবেশ মাখানো সলাজ চুমুক। অনেকজনের মাঝে খোলা আকাশের নিচে একসাথে ভাগ করে খাবার খাওয়া। এই সব সব কিছু আমার কাছে একেবারে প্রথম। এই সবকিছুর মধ্যে দিয়ে হটাৎ করে যেন চারপাশের পৃথিবীটার বয়স অনেকটা কমে গেছিলো। খুব মিষ্টি লেগেছে আদর মেশানো হালকা ধমকের সুরে বলা 'খেয়ে নাও' . ওই সুর মনে এসে এখনো ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে দিয়ে গেল। ওই সুর আর এই কয়েকদিনের সখ্যতা হটাৎ যেন বাবার হাত ধরে রাস্তা পার হওয়া থেকে হটাৎ বড় হয়ে যাওয়া দায়িত্ব কর্তাব্যপরায়ণ মেয়েটাকে আবার কেউ আদর করে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিলো। অজস্র জটিলতা আর দায়িত্ব কর্তব্যের ঘেরাটোপে থাকা দুটি মন একটু বেশি উচ্ছল হয়ে উঠেছিল কি আজ ? কিজানি, হবে হয়তো। তবে আনকোরা আমার মনে ভেসে এসেছিলো আজ বেহাগের সুর। উচ্ছলতা সেখানে স্থির শান্তির সাথে মিশে গিয়েছিলো। গঙ্গার ছলাৎ ছলাৎ বারবার বলছিলো সব কিছুকে দুচোখ ভোরে নিতে। আর বলছিলো এই যে মুহূর্তরা ভিড় করে আসছে, তৈরি হচ্ছে একের পর এক মুহূর্ত। আবার তাও ভেসে চলে যাচ্ছে, এইরকম ই সময় সব কিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। পরে থাকে ওই মুহূর্তরা। আর আজ হটাৎ একি অসম্ভব এক মুহূর্তে, আমার পরিমিত, কর্তাব্যপরায়ণ আমির ভীষণ বেহিসেবি হয়ে আত্মপ্রকাশ, আমার আমিকেই ভীষণ লজ্জায় ফেলে দিলো।
আজ সকালে বেরোতে যাবো, হটাৎ দেখলাম, গেট এর পাশে হয়ে থাকা অপরাজিতা গাছে এক গাঢ় নীল অপরাজিতা। বৃষ্টিস্নাত, সবুজের মাঝে নীল। কি স্নিগ্ধ। কি সুন্দর। ফুল তুলতে আমি ভালোবাসিনা। কষ্ট হয়, কিন্তু তাও এর মধ্যের ওই রোমাঞ্চিত গাঢ় বার্তা পৌঁছে দিতে ইচ্ছে হোলো, অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে। অনেক ভালোলাগার আর অনেক ভালোবাসায় মুড়ে ওকে আলতো করে তুলে রেখেছিলাম ব্যাগ এর ভেতরে। সারাদিনের সব কিছুর মাঝে যখন হারিয়ে ফেললাম মনের মাঝে গুছিয়ে রাখা কিছু ইচ্ছেকে। তখন বুকের মধ্যেটা হটাৎ ছটপট করে উঠলো, মনে হলো কি করে দি, কেমন করে পৌঁছে দি আমার ওই আলতো আদরকে। হাতে থাকা অনেক কিছুকে এক নিমেষে কেমন যেন ভুলে গেলাম, দৌড়ে মাঝরাস্তার মধ্যে এসে হাতে তুলে দিলাম ওই শুখনো হয়ে যাওয়া নীল আদরকে। আর তারপরেই যেন একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরলো আমায়, কেন লজ্জা আর কিসের জন্যে তা, জানিনা। ভুলে গেলাম রাস্তার কথা, দাঁড়িয়ে থাকা হলুদ ট্যাক্সি। মনে হলো যেন ওই একটা ছোট্ট নীল ভালোবাসা আমার মনের অনেকটা কোথাও উন্মোচন করে দিলো। গাল আর কানের মধ্যে এক অদ্ভুত উষ্ণ অনুভূতি, আমাকে দাঁড়াতে দিলোনা, লজ্জা অথচ দিতে পারার এক অদ্ভুত আনন্দ আমাকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে এলো, সাহস হলোনা ফিরে তাকাতে। আর তারপর, সমস্ত রাস্তা কেমন যেন ওই হলদে অপরাহ্নের আলোতে আমায় স্তব্ধ করে নিয়ে এলো। বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি মনের গভীর অন্তস্থল পর্যন্ত আলোয় ভরিয়ে রেখেছিলো। অভ্যেস বশত একবার বিচারে বসেছিলাম ঠিক ভুলের দণ্ড হাতে। আমার গভীর ভালোলাগায় তা অনন্য ভাবে আমার কাছেই ফিরে এলো। দিতে আমি সবসময় ই খুব ভালোবাসি। কিন্তু ওই সামান্য একটা নরম পাপড়ির আলগোছ আদর দিতে পারার মধ্যে যে এত ভালোলাগা লুকিয়ে থাকতে পারে, ওই সুন্দরকে হাতে তুলে দিয়ে যে এমন পরিতৃপ্তি আসবে, এত প্রশান্তি, ভাবিনিত কখনো। বুঝিনি তো তা।
মনে হলো, ভরা গঙ্গার ছলাৎ ছলাৎ শুনতে পেলাম। গীতবিতানের পাতার পর পাতার এক একটা শব্দরাশি যেন নানান ভাবে নানান ছন্দে সুরে সুরে আমার চারপাশে এক অদৃশ্য মায়াজাল রচনা করে রাখলো। মনে হলো, ওই নীল অপরাজিতা আর ওই বুড়ো লোকটার সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমি যেন আমার সমস্ত না বলা কথাকে বলতে পেরেছি। সময়ের নিয়মে হয়তো একদিন পথ দুই পথিককে এক পথে কিছু সময় পাশাপাশি হেঁটে যেতে দিলো। এরপর হয়তো আবার পথের ই নিয়মে তা আলাদা করে দেবে ওই দুই মনকে। কিন্তু তবু ওই বুড়ো লোকটার অমোঘ সৃষ্টি তখনো সেতু হয়ে থাকবে সব কিছুর মধ্যে। হয়তো হলুদ আলোর নিচে বসে ওই বইটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আর কেউ নদী বলে ডেকে উঠবেনা। খোলা চিঠি, গোলাপওয়ালার হাত ধরে গোলাপের গন্ধ নিয়ে একরাশ জুঁই ফুলের নরম ইচ্ছে হয়ে পরে থাকবেনা হয়তো আর। হয়ত ওই অভ্যেস গুলো তখন আর দরকার হবেনা কারোর।
তবু আজকের যা কিছু তা তো আজকের ই। আমি জানবো এ আমার অনেক গভীরের খুব শান্তির আর ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ। এর মধ্যে আর যাই থাকুক কোনো মিথ্যের আবডাল নেই, নেই সত্যি গোপনের প্রয়াস। নেই কোনো বাঁধনের বাড়াবাড়ি বা অধিকারের দমবন্ধ তা। তুমি থেকো, তোমার মতো করে। যেদিন মনে হবে, সব ফেলে চলে যেও। তবু আজকের যা কিছু তা আজকের ই। মিথ্যে দিয়ে মনভোলানো র প্রয়োজন যেন কখনো না হয়ে পরে। আজকের অভ্যেস যেন কালকে রাস্তা না রোধ করতে আসে। প্রার্থনা করি স্বপ্ন দেখতে যেন আমি চিরকাল পারি। আর আজ আমার ওই স্বপ্নের একফালি তোমার কাছে পৌঁছে দিলাম। যেখানের আকাশ সবসময় নীল, শিরশিরে দখিনা বাতাস, শিলং পাহাড়ের মতো ঘন গাঢ় সবুজ আর জ্যোৎস্নার মতো স্নিগ্ধ। সেই সবটুকু আমি পৌঁছে দিলাম তোমার কাছে।
সময়ের সাথে সাথে আমাদের বোধ হয় উন্নত, পরিণত। আমরা তখন আমাদের না পূরণ হওয়া ইচ্ছেগুলোকে আর পুরান করার জন্যে না দৌড়ে, তাকে ভবিষ্যতের হাতে গচ্ছিত রেখে দি। আর প্রতিদিনের টানাপোড়েনে ওই যে সবার অলক্ষ্যে যে বসে আছে, সেই লোকটা যখন হটাৎ করে জোয়ার এনে দেয় , ভাসিয়ে দেবার সমস্ত উপকরণ সামনে রেখে মুচকি মুচকি হাসে, তখন যদি ভেসে না গিয়ে আমরা ঠিক আজকের মতোই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তার উচ্ছলতা দেখি। আর হাসিমুখে হাতে হাত রেখে একে অপরের অনুভবের মধ্যে অসংখ্য সুন্দর মুহূর্তের সঙ্গে আরো কিছু সুন্দর মুহূর্ত মিশিয়ে দি, তখন একদিন যখন ফিরে তাকাবো তখন জানি অজস্র ভালো খারাপ স্মৃতির মাঝে শুধুই ওই সুন্দর মুহূর্ত গুলো আমাদের ঠোঁটের ওপরে হাসির রেখা এনে দিয়ে যাবে। আর সেদিন ইচ্ছেপূরণের চাবিকাঠি হাতে আসুক বা না আসুক, সেদিন আমরা যত্ন নিয়ে খুব ভালোবেসে আজকের দিনের এই সমস্ত সুন্দর মুহূর্তকে ভাববো। হয়তো একসাথে, হয়তো আলাদাভাবে। আর ওই বুড়োলোকটার সৃষ্টি গুলো পরে থাকবে আমাদের মাঝে। তাবলে ভেবোনা যেন তুমি নিজের অযত্ন করতে পারবে, ওই যে সবুজ পাতা গুলো? ওগুলো কিন্তু মোটেও আমাকে মনে করানোর জন্যে নয়, ওগুলো শুধুই একজনের খোঁজ নেবার জন্যে। ওগুলো সামনে থাকলে আমি জানি, জল না নিয়ে একজন বেরোতেই পারবেনা। পারবেনা খাবার না খেয়ে অযত্ন করতে নিজের। আর সাবধানে রাস্তা চলতেই হবে তাকে। রাতে স্নানের পরে ভালো করে মাথাও মুছতেই হবে।
আর এইভাবেই আমাদের এই "বন্ধনহীন গ্রন্থি" দিয়ে এক অমোঘ বাঁধনে বাঁধলাম তোমায় আমি আজ। যাতে তুমি পাবে তোমার খোলা আকাশ, উড়ে বেড়াবার অবাধ গতি। তবে দিনশেষে ক্লান্তি এলে, থাকবো আমি দুহাত বাড়িয়ে। আর বাকি যা কিছু সব রইলো আমার বৃষ্টিস্নাত নীল অপরাজিতা আর ওই একটা বইয়ের মধ্যে। ঠিক যেভাবে ওই শুকিয়ে যাওয়া নরম পাপড়ি গুলোকে তুমি তোমার আদোরে জীবন্ত করে রেখেছিলে, সেইভাবে রেখো সবকিছু প্রাণবন্ত করে। আর অপরাহ্নের আলোতে তোমার কাছে, আমার কাছে গলে গলে পড়ুক আমাদের চিকন সবুজের মাঝে রক্ত নীল সোহাগ। আর খুব আদোরে, ভালোবাসায়, নরম হয়ে তোমাকে জড়িয়ে থাকুক তা।
সেই দিনও মনে পড়লো ওই গেট এর কথা। গেট টা ঠেলে সত্যি ই কি কেউ ভেতরে এসে দাঁড়ালো। একে অপরের হাত ধরে, দুজনের ই কি অভিমানী মনের কোণে ঘুমিয়ে থাকা অজস্র ইচ্ছেরা হটাৎ ছেলেমানুষি সুরে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো? ছাতা না খুলে সেদিন গায়ে মাখলাম বৃষ্টির জল। বইয়ের গন্ধ নাকে নিয়ে আদর করে ঘরে আনলাম কিছু জানা কাহিনী, কিছু অজানা তথ্যের সম্ভার। আর কালো কফির গন্ধ আমাকে কেমন যেন বেহিসেবি করে তুললো সেদিন। দেয়া নেওয়া, জামাখরচ আর সব কিছুর হিসেব ভুলে গিয়ে শুধু শুনতে ইচ্ছে করছিলো। কিকথা? কিজানি। কিন্তু শুনলাম কত কথা। হালকা মজা, গল্প, কিছু সুর, আবার কিছু কাঠিন্যের আবডালে আবদার রক্ষার তাগিদ। অনুভব করলাম। আর এই সব কিছুর মধ্যে বোকার মতো সত্যি ই ভুলে গেলাম হিসেব। কর্তব্য। যে কর্তব্যে এই কয়েকবছর নিজেকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছি, কোনো কোথাও চুলচেরা হিসেবে এতটুকু শৈথিল্য যে কোনোদিন হতে দেয়নি, সেই আমি ই সেদিন সত্যি ই দেনা পাওনার সব হিসেব, কর্তব্য ভুলে চুপ করে বসে ছিলাম। আর তারপর অপরাহ্নের আলোয় ভেসে যাওয়া ডিঙি নৌকা, মনের মাঝে বয়ে চলা নির্বাক শান্তির সাথে মিশে গিয়ে আমাদের চারপাশের সমস্ত কিছুকে যেন এক অপরূপ বাঁধনে বেঁধে ফেললো। সেদিন ছিল ভাঁটা।
তবে সেই "বন্ধনহীন গ্রন্থি"র টান অনুভব করলাম, আজ। আজ ছিল ভরা জোয়ার। জোয়ারে উথাল পাতাল গঙ্গা আমাদের পাশ দিয়ে বয়ে যেতে যেতে খুব আদর মাখিয়ে সারাদিনের ওই কয়েকটা ঘন্টার মদিরাতা তুলে ধরছিল। ওই যে পায়ে পা মিলিয়ে রৌদ্রতপ্ত দুপুরে হেঁটে বেড়ানো। আড়চোখে দেখতে পাওয়া মাটির লস্যির ভাঁড়ে আবেশ মাখানো সলাজ চুমুক। অনেকজনের মাঝে খোলা আকাশের নিচে একসাথে ভাগ করে খাবার খাওয়া। এই সব সব কিছু আমার কাছে একেবারে প্রথম। এই সবকিছুর মধ্যে দিয়ে হটাৎ করে যেন চারপাশের পৃথিবীটার বয়স অনেকটা কমে গেছিলো। খুব মিষ্টি লেগেছে আদর মেশানো হালকা ধমকের সুরে বলা 'খেয়ে নাও' . ওই সুর মনে এসে এখনো ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে দিয়ে গেল। ওই সুর আর এই কয়েকদিনের সখ্যতা হটাৎ যেন বাবার হাত ধরে রাস্তা পার হওয়া থেকে হটাৎ বড় হয়ে যাওয়া দায়িত্ব কর্তাব্যপরায়ণ মেয়েটাকে আবার কেউ আদর করে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিলো। অজস্র জটিলতা আর দায়িত্ব কর্তব্যের ঘেরাটোপে থাকা দুটি মন একটু বেশি উচ্ছল হয়ে উঠেছিল কি আজ ? কিজানি, হবে হয়তো। তবে আনকোরা আমার মনে ভেসে এসেছিলো আজ বেহাগের সুর। উচ্ছলতা সেখানে স্থির শান্তির সাথে মিশে গিয়েছিলো। গঙ্গার ছলাৎ ছলাৎ বারবার বলছিলো সব কিছুকে দুচোখ ভোরে নিতে। আর বলছিলো এই যে মুহূর্তরা ভিড় করে আসছে, তৈরি হচ্ছে একের পর এক মুহূর্ত। আবার তাও ভেসে চলে যাচ্ছে, এইরকম ই সময় সব কিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। পরে থাকে ওই মুহূর্তরা। আর আজ হটাৎ একি অসম্ভব এক মুহূর্তে, আমার পরিমিত, কর্তাব্যপরায়ণ আমির ভীষণ বেহিসেবি হয়ে আত্মপ্রকাশ, আমার আমিকেই ভীষণ লজ্জায় ফেলে দিলো।
আজ সকালে বেরোতে যাবো, হটাৎ দেখলাম, গেট এর পাশে হয়ে থাকা অপরাজিতা গাছে এক গাঢ় নীল অপরাজিতা। বৃষ্টিস্নাত, সবুজের মাঝে নীল। কি স্নিগ্ধ। কি সুন্দর। ফুল তুলতে আমি ভালোবাসিনা। কষ্ট হয়, কিন্তু তাও এর মধ্যের ওই রোমাঞ্চিত গাঢ় বার্তা পৌঁছে দিতে ইচ্ছে হোলো, অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে। অনেক ভালোলাগার আর অনেক ভালোবাসায় মুড়ে ওকে আলতো করে তুলে রেখেছিলাম ব্যাগ এর ভেতরে। সারাদিনের সব কিছুর মাঝে যখন হারিয়ে ফেললাম মনের মাঝে গুছিয়ে রাখা কিছু ইচ্ছেকে। তখন বুকের মধ্যেটা হটাৎ ছটপট করে উঠলো, মনে হলো কি করে দি, কেমন করে পৌঁছে দি আমার ওই আলতো আদরকে। হাতে থাকা অনেক কিছুকে এক নিমেষে কেমন যেন ভুলে গেলাম, দৌড়ে মাঝরাস্তার মধ্যে এসে হাতে তুলে দিলাম ওই শুখনো হয়ে যাওয়া নীল আদরকে। আর তারপরেই যেন একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরলো আমায়, কেন লজ্জা আর কিসের জন্যে তা, জানিনা। ভুলে গেলাম রাস্তার কথা, দাঁড়িয়ে থাকা হলুদ ট্যাক্সি। মনে হলো যেন ওই একটা ছোট্ট নীল ভালোবাসা আমার মনের অনেকটা কোথাও উন্মোচন করে দিলো। গাল আর কানের মধ্যে এক অদ্ভুত উষ্ণ অনুভূতি, আমাকে দাঁড়াতে দিলোনা, লজ্জা অথচ দিতে পারার এক অদ্ভুত আনন্দ আমাকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে এলো, সাহস হলোনা ফিরে তাকাতে। আর তারপর, সমস্ত রাস্তা কেমন যেন ওই হলদে অপরাহ্নের আলোতে আমায় স্তব্ধ করে নিয়ে এলো। বুকের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি মনের গভীর অন্তস্থল পর্যন্ত আলোয় ভরিয়ে রেখেছিলো। অভ্যেস বশত একবার বিচারে বসেছিলাম ঠিক ভুলের দণ্ড হাতে। আমার গভীর ভালোলাগায় তা অনন্য ভাবে আমার কাছেই ফিরে এলো। দিতে আমি সবসময় ই খুব ভালোবাসি। কিন্তু ওই সামান্য একটা নরম পাপড়ির আলগোছ আদর দিতে পারার মধ্যে যে এত ভালোলাগা লুকিয়ে থাকতে পারে, ওই সুন্দরকে হাতে তুলে দিয়ে যে এমন পরিতৃপ্তি আসবে, এত প্রশান্তি, ভাবিনিত কখনো। বুঝিনি তো তা।
মনে হলো, ভরা গঙ্গার ছলাৎ ছলাৎ শুনতে পেলাম। গীতবিতানের পাতার পর পাতার এক একটা শব্দরাশি যেন নানান ভাবে নানান ছন্দে সুরে সুরে আমার চারপাশে এক অদৃশ্য মায়াজাল রচনা করে রাখলো। মনে হলো, ওই নীল অপরাজিতা আর ওই বুড়ো লোকটার সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আমি যেন আমার সমস্ত না বলা কথাকে বলতে পেরেছি। সময়ের নিয়মে হয়তো একদিন পথ দুই পথিককে এক পথে কিছু সময় পাশাপাশি হেঁটে যেতে দিলো। এরপর হয়তো আবার পথের ই নিয়মে তা আলাদা করে দেবে ওই দুই মনকে। কিন্তু তবু ওই বুড়ো লোকটার অমোঘ সৃষ্টি তখনো সেতু হয়ে থাকবে সব কিছুর মধ্যে। হয়তো হলুদ আলোর নিচে বসে ওই বইটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আর কেউ নদী বলে ডেকে উঠবেনা। খোলা চিঠি, গোলাপওয়ালার হাত ধরে গোলাপের গন্ধ নিয়ে একরাশ জুঁই ফুলের নরম ইচ্ছে হয়ে পরে থাকবেনা হয়তো আর। হয়ত ওই অভ্যেস গুলো তখন আর দরকার হবেনা কারোর।
তবু আজকের যা কিছু তা তো আজকের ই। আমি জানবো এ আমার অনেক গভীরের খুব শান্তির আর ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ। এর মধ্যে আর যাই থাকুক কোনো মিথ্যের আবডাল নেই, নেই সত্যি গোপনের প্রয়াস। নেই কোনো বাঁধনের বাড়াবাড়ি বা অধিকারের দমবন্ধ তা। তুমি থেকো, তোমার মতো করে। যেদিন মনে হবে, সব ফেলে চলে যেও। তবু আজকের যা কিছু তা আজকের ই। মিথ্যে দিয়ে মনভোলানো র প্রয়োজন যেন কখনো না হয়ে পরে। আজকের অভ্যেস যেন কালকে রাস্তা না রোধ করতে আসে। প্রার্থনা করি স্বপ্ন দেখতে যেন আমি চিরকাল পারি। আর আজ আমার ওই স্বপ্নের একফালি তোমার কাছে পৌঁছে দিলাম। যেখানের আকাশ সবসময় নীল, শিরশিরে দখিনা বাতাস, শিলং পাহাড়ের মতো ঘন গাঢ় সবুজ আর জ্যোৎস্নার মতো স্নিগ্ধ। সেই সবটুকু আমি পৌঁছে দিলাম তোমার কাছে।
সময়ের সাথে সাথে আমাদের বোধ হয় উন্নত, পরিণত। আমরা তখন আমাদের না পূরণ হওয়া ইচ্ছেগুলোকে আর পুরান করার জন্যে না দৌড়ে, তাকে ভবিষ্যতের হাতে গচ্ছিত রেখে দি। আর প্রতিদিনের টানাপোড়েনে ওই যে সবার অলক্ষ্যে যে বসে আছে, সেই লোকটা যখন হটাৎ করে জোয়ার এনে দেয় , ভাসিয়ে দেবার সমস্ত উপকরণ সামনে রেখে মুচকি মুচকি হাসে, তখন যদি ভেসে না গিয়ে আমরা ঠিক আজকের মতোই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তার উচ্ছলতা দেখি। আর হাসিমুখে হাতে হাত রেখে একে অপরের অনুভবের মধ্যে অসংখ্য সুন্দর মুহূর্তের সঙ্গে আরো কিছু সুন্দর মুহূর্ত মিশিয়ে দি, তখন একদিন যখন ফিরে তাকাবো তখন জানি অজস্র ভালো খারাপ স্মৃতির মাঝে শুধুই ওই সুন্দর মুহূর্ত গুলো আমাদের ঠোঁটের ওপরে হাসির রেখা এনে দিয়ে যাবে। আর সেদিন ইচ্ছেপূরণের চাবিকাঠি হাতে আসুক বা না আসুক, সেদিন আমরা যত্ন নিয়ে খুব ভালোবেসে আজকের দিনের এই সমস্ত সুন্দর মুহূর্তকে ভাববো। হয়তো একসাথে, হয়তো আলাদাভাবে। আর ওই বুড়োলোকটার সৃষ্টি গুলো পরে থাকবে আমাদের মাঝে। তাবলে ভেবোনা যেন তুমি নিজের অযত্ন করতে পারবে, ওই যে সবুজ পাতা গুলো? ওগুলো কিন্তু মোটেও আমাকে মনে করানোর জন্যে নয়, ওগুলো শুধুই একজনের খোঁজ নেবার জন্যে। ওগুলো সামনে থাকলে আমি জানি, জল না নিয়ে একজন বেরোতেই পারবেনা। পারবেনা খাবার না খেয়ে অযত্ন করতে নিজের। আর সাবধানে রাস্তা চলতেই হবে তাকে। রাতে স্নানের পরে ভালো করে মাথাও মুছতেই হবে।
আর এইভাবেই আমাদের এই "বন্ধনহীন গ্রন্থি" দিয়ে এক অমোঘ বাঁধনে বাঁধলাম তোমায় আমি আজ। যাতে তুমি পাবে তোমার খোলা আকাশ, উড়ে বেড়াবার অবাধ গতি। তবে দিনশেষে ক্লান্তি এলে, থাকবো আমি দুহাত বাড়িয়ে। আর বাকি যা কিছু সব রইলো আমার বৃষ্টিস্নাত নীল অপরাজিতা আর ওই একটা বইয়ের মধ্যে। ঠিক যেভাবে ওই শুকিয়ে যাওয়া নরম পাপড়ি গুলোকে তুমি তোমার আদোরে জীবন্ত করে রেখেছিলে, সেইভাবে রেখো সবকিছু প্রাণবন্ত করে। আর অপরাহ্নের আলোতে তোমার কাছে, আমার কাছে গলে গলে পড়ুক আমাদের চিকন সবুজের মাঝে রক্ত নীল সোহাগ। আর খুব আদোরে, ভালোবাসায়, নরম হয়ে তোমাকে জড়িয়ে থাকুক তা।
No comments:
Post a Comment