অপেক্ষা শব্দটা শুনলেই আমার কেমন যেন মনকেমন করতো আগে। একটু ভয় ও বা। জানিনা কেন অপেক্ষা শুনলেই মনে হতো সেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা রাজকাহিনীর বর্ণনাতে পাওয়া মেবারের রানীর প্রতীক্ষা কখন তার প্রিয়তম এসে পিছন থেকে হটাৎ চোখ টিপে ধরবে। অথবা অপেক্ষা রত রমণীর সেই বিশেষ মানুষটার জন্যে ভাবতে ভাবতে সেলাই করা, হটাৎ অন্যমনস্কতায় হাতে ছুঁচ ফুটে গেল আর সেই শ্বেত শুভ্র রুমালের ওপর এক ফোঁটা রক্ত পরে রুমাল টাকে যেন অস্তাচলের রঙে রাঙিয়ে দিলো, আহা কি অপূর্ব সে বর্ণনা। সমস্ত মেবার যেন চোখের সামনে দুলে ওঠে সেই বর্ণনার মধ্যে দিয়ে। সেই প্রতীক্ষা তার সমস্ত আকুতি নিয়ে যেন আপনা থেকে প্রার্থনা করতে লাগে, ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও।
মনে পরে যায় অপেক্ষা , বাবার আসতে দেরি হলে, খাতার পেছনে লুকিয়ে ঠাকুরকে চিঠি লেখার সেই অভ্যেস। কি বিশ্বাস ও বা। তারপরে হটাৎ বাবা চলে এলে, বাবাকে জড়িয়ে ধরে কি শান্তি।
সেই বিশ্বাস ও নাড়া খেলো, যখন অপেক্ষা চিরন্তন হয়ে গেল। ছোট মেয়ে টাকে হটাৎ এক ধাক্কায় অনেকটা বড় করে দিয়ে ওই ঠাকুর বুঝিয়ে দিলো, এই অপেক্ষা এত সহজে মিটবেনা। তখন থেকে অপেক্ষা শব্দের সাথে জুড়ে গেল কান্না।
আর আজ, অপেক্ষা দিয়ে গেল একটা সুন্দর শান্ত হাওয়া। ধৈর্য্য আর অপেক্ষা শব্দ গুলো বাবা খুব ব্যবহার করতো। বারবার বলতো, জীবনকে সময় দিস আর শান্ত হয়ে নিজের সমস্ত কর্তব্য দায়িত্ব পালন করে যাস, তোর যা পাবার যেটুকু তোর বরাদ্দ তার জন্যে ধৈর্য্য ধরে, সঠিক ভাবে অপেক্ষা করে থাকলে ঠিক সময়ে, ঠিক সেটা তোর কাছে আসবে। তার আগে তাড়াহুড়ো করিসনা, সব নষ্ট হয়ে যাবে তাহলে। বাবা যতদিন কাছে ছিল, তখন শুধু তাড়াহুড়োই করে গেছি। বাবার কাছে না থাকাটা ধীরে ধীরে বাবার বলা সমস্ত কথার মানেকে নতুন ভাবে বুঝতে শিখিয়েছে আমাকে। কিছু বুঝেছি। অনেক হয়তো এখন বাকি। তবে, আজ সন্ধ্যের ধুপ ধুনোর গন্ধের মাঝে, গোধূলির লালের রেশ তখন পুরোটা মুছে যায়নি, এদিকে আকাশ সেজে উঠতে চলেছে কুমুদিনীর স্বর্ণাভ আভায়, আকাশের আর একদিকে আবার মেঘের ঘনঘটা। এমন হাজারো রঙে যখন প্রকৃতি নিজেকে সাজিয়ে তুলে ধরেছে, তখন, শাঁখ, ঘন্টা, প্রদীপের আলো আর আমার ধুপ ধুনোর গন্ধে চারিদিক ভীষণ পবিত্র ভীষণ সুন্দর হয়ে, শান্ত হয়ে আমার কাছে থমকে দাঁড়ালো। আর কেমন যেন খুব ভেতর থেকে একটা বিশ্বাস, এক অনন্য অনুভূতিতে আমাকে দিয়ে ঠিক বাবার বলা ওই বোধ টাকেই ফিরিয়ে দিয়ে গেল। মনে হলো, "আমাদের যা কিছু তা আমাদের ই থাকবে।" চারপাশের সমস্ত দায়িত্ব পালন করার পরে, সবাইকে ভালো রাখার পরে , সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটার ঠাকুর, সেই যে গভীর বিশ্বাস থেকে সে ঠাকুরকে চিঠি লিখতো, সেই বিশ্বাস সে নিশ্চই আবার ফিরে পাবে আর ওই ছোট্ট মেয়েটার ঠাকুর একদিন নিশ্চয়ই তাকে ইচ্ছেপূরণের ঝুলি নিয়ে বসতে দেবে। হ্যাঁ , শর্তটা মনে আছে, অপেক্ষা টা মনের গভীরে সত্যি সত্যি থাকতে হবে। genuinely. আর চাওয়াটাও। তার মধ্যে যেন কোনো ভান না থাকে, কোনো ফাঁকি না থাকে। তাহলে যে চাঁদ এর জন্যে এতদিন অপেক্ষা করেছিলাম, সেই চাঁদ সেদিন আকাশে আসবে। সঙ্গে থাকবে নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি।
আর সেই মিষ্টি প্রতীক্ষার কথা ভাবতে ভাবতে, আজ চলো স্বপ্ন দেখি নতুন মঙ্গলময় সূর্য্য ওঠা ভোরের। পাখির কাকলীতে ভোরে উঠুক চারিদিক। আগামীর আশায় নতুন করে বুক ভোরে নি শ্বাস আর শুরু করি কর্মময় কর্তব্য। সেই কর্তব্য পূরণের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের স্বপ্নরা ডানা মেলুক, নতুন কচি সবুজ পাতায় ভরা চারাগাছ আলোয়, ছায়ায়, মায়ায় ধীরে ধীরে পরিণত হোক সুন্দর মহীরুহে।
আর বারবার আমরা প্রাণ ভোরে নি, বলি, "কি আনন্দ, কি আনন্দ, দিবারাত্র নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ "......আর এইভাবেই করি অপেক্ষা। নিজেদের আমি গুলোকে ফিরে পাবার অপেক্ষা, ফিরিয়ে নেবার অপেক্ষা। ফিরিয়ে দেবার অপেক্ষা। আর যা কিছু আমাদের তার কাছে ফিরে যাবার অপেক্ষা। এই অপেক্ষার মধ্যে কোনো হতাশা নেই, দুঃখ নেই, অশান্তি নেই...এই অপেক্ষার মধ্যে শুধু আছে শান্তি, আছে অনন্য আশা আর প্রতিটা দিনের প্রতিটা ভোরের কাছে কাছে প্রার্থনা আমাদের সমস্ত ক্ষণ কে যেন সুন্দরতা দিয়ে ভোরে দিয়ে আমাদের পৌঁছে দেয় সেই মুহূর্তগুলোর কাছে। তার জন্যে অপেক্ষা।
শিউলি ফুটেছে কি?
No comments:
Post a Comment