Wednesday, 5 June 2019

ছাতা

দিল্লিতে থাকাকালীন সেভাবে কেউ ছাতা ব্যবহার করেনা , তবে এবারে কলকাতা গিয়ে বুঝলাম ছাতার অনস্বীকার্য ভূমিকা। ছাতা অর্থাৎ কিনা যে ছায়া দান করে। ছোটবেলাতে আমার একটা রঙ্গীন ওই যে রংবেরঙের ছাতা হয়না, ঐরকম একটা ছাতার খুব শখ ছিল। খুব ইচ্ছে হতো, ঐরকম একটা ছাতার। কিন্তু ওই যে মা বলেছিলো, বায়না করতে নেই কখনো। সেটা নাকি ভীষণ একটা খারাপ জিনিস। ফলত ওই ইচ্ছেটা মনের ভেতরেই থেকে গেছে কখনো আর সামনে আসেনি। সে যাই হোক, আজকে ছাতা নিয়ে লিখতে বসে, প্রথমেই মনে পরে গেল আমার বাবার যে একটা ঢাউস কালো রঙের ছাতা ছিল তার কথা এবং তারপরেই মনে পরে গেল সেই রং বেরঙের ছাতার কথা, যেটা সেই সময়ে আমার কোনো এক বন্ধু নিয়ে আসতো স্কুল এ এবং যার ওপরে আমার যার পরনাই লোভ হয়েছিল। অবাক হলাম এই দেখে যে এই এত বছর পরেও সেই রঙ্গীন ছাতার স্মৃতি এক ই ভাবে মনের মধ্যে ঢেউ তুললো। অর্থাৎ কিনা কোনো ইচ্ছে, কোনো চাওয়া পাওয়া, ভালোলাগা, তা সে যত ক্ষণিকের বা যত তুচ্ছই হোকনা কেন , কিছুই আমাদের ছেড়ে যায়না। সেই ভালোলাগার তরী বেয়ে আমার কাছে এসে পৌঁছনো এক দাবি কে রাখতে গিয়ে শুরু করলাম এই ছাতা বৃত্তান্ত। বলা বাহুল্য যে এ দাবী মেটাতে আমার খুব ভালো লাগছে। চিরকাল ই চেয়েছি আমার ওপর কেউ অধিকার বোধ দেখাক, ভালোবাসার জোর করুক। এমনকি ভালোবাসার সেই জায়গা থেকে কেউ আমাকে তুই এই শাড়িটা পর, বা ওই জুতোটা, বা ওই জামাটা  বা ওই কানের দুলটা খুলে ফ্যাল বা ইত্যাদি ইত্যাদি এমন সব জোর ই যা আপাত দৃষ্টিতে খুব কম মেয়েই মেনে নিতে পারে, তা করে, তাহলে আমার থেকে খুশি কেউ হয়না। সেই কারণেই আমার মায়ের পছন্দ নিজের অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও মেনে নি, কিছুটা সময়ের জন্যে। তবে সে যাই হোক, এই ছাতা প্রসঙ্গে আমার বাবার সেই বড় কালো ছাতাটির কথা না বললে ছাতা কাহিনী নিতান্তই অসমাপ্ত থেকে যাবে। কারণ আদ্যন্ত কাল আমি ওই কালো ছাতাটি দেখেই বড় হয়েছি। তার বাঁট টিও বাঁকানো এবং কালো রঙের। গ্রীষ্ম কালে ওই ছাতাটি সবসময় না থাকলেও বর্ষাতে বাবার সবসময়ের সঙ্গী ছিল ওই ছাতাটি। আর কারোর বাবার হাতে অমন ছাতা দেখতামনা, শুধু আমার বাবার ই অমন পুরোনো আমলের ছাতা। ফ্যাশন সম্পর্কে বেশ সচেতন হতে শুরু করেছি তখন। ফলত ছোট ছোট ফোল্ডিং নানান রঙের ছাতার সামনে বাবার ওই ঢাউস কালো ছাতাটির ওপরে আমার ছিল যার পরনাই রাগ। কেন বাবা শুধু ওই ছাতাটা নিয়েই যায়, বিয়ে বাড়ি থেকে অন্নপ্রাশন কি রোজের স্কুল এ যাওয়া, সবেতেই কালো বাঁকানো বাঁটের লম্বা ইয়া বড় একটা ছাতা হাতে একমুখ হাসি নিয়ে আমার বাবা। কতবার বকতাম বাবাকে, তুমি কেন ছোট ছাতা নাওনা গো, সবাই কেমন ছোট ছাতা নেয়, বাবা বলতো, অরে আমি এত লম্বা, আমাকে পুরোটা বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে গেলে তো এইরকম বড় ছাতাই চাই .খুব ই সহজ সোজা উত্তর। কি আর বলবো। এখন ভাবলে খুব গর্ব হয়। ছাতা নিয়ে সবাই যখন ফ্যাশনেবল, বাবা ভুলেও ভাবতোনা, লোকে কি বলবে কি ভাববে, কিভাবে নেবে। শুধু মিটিমিটি হেসে নিজের যেটা মনে হতো, সেটাই করে যেত। এমন ই ছিল আমার বাবা। কত স্ট্রং ছিল তার will power , কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতেই না দিয়ে।
ওই ছাতাটা আর ছাতার অনেকগুলো বাঁট এখনো রাখা আছে। তখন যে জিনিসটার ওপরে খুব রাগ হতো, এখন সেই জিনিসটাকে যেন আঁকড়ে ধরে থাকতে ইচ্ছে করে। মনে হয় একবার ওই মানুষটা আসুক, আসুক সামনে একবার ওই ছাতাটা নিয়ে। খুব গর্ব ও হয়। আমার বাবা যে অন্য আর সবার মতো ছিলোনা। সেই শার্লক এর দাদা মাইক্রফট হোমস এর মতো একটি লম্বা কালো ছাতা বাবার সঙ্গী। পরে এখন দেখি, ইংল্যান্ড এর খুব অভিজাত ফ্যামিলি তে ঐরকম ছাতা নেওয়ার চল আছে। 

যাই হোক, যে কথা বলছিলাম। বলছিলাম অধিকার বোধ এর কথা, দাবী। একটা ছাতা কি আর এমন গুরুত্ব পূর্ণ জায়গা হতে পারে, যে যার জন্যে মাথার যন্ত্রণা থেকে শুরু করে হাতের হাজারো কাজ তুচ্ছ করে অনায়াসে আবোল তাবোল বকবক করতে পারা যায়, একথা আগে বুঝিনি। এখন কথা হচ্ছে এই যে, আজ থেকে ৩০ বছর আগে যদি আমাকে কেউ বলতো ছাতা নিয়ে লিখতে তাহলে আমি কি লিখতাম। তখনো কি আমি এইভাবে লিখতাম যে ছাতা শব্দটি এসেছে ছা ঋতুর রি সমাস থেকে, বা ইত্যাদি ইত্যাদি। নাহ , নিশ্চই এভাবে শুরু করতাম। 

লিখতাম , আমার একটা গোলাপি রঙের ছাতা আছে। গোলাপি রংটা হলো ওর কাপড়টা , বেশ কিছু মেটাল রিব দিয়ে আর একটা স্টিল এর পোলের ওপরে ওই গোলাপি কাপড়টা আটকিয়ে এই যে জিনিসটা আছে, পাপাই বলেছে এটার নাম ছাতা। এখন বাইরে খুব গরম, আমি যখন ই বাইরে বেরোই বা স্কুল এ যাই, এই ছাতাটা নিয়ে যাই। এই ছাতাটা আমাকে সূর্য্যের তাপ থেকে রক্ষা করে। আবার যখন বৃষ্টি পড়ে , তখনো আমি এই ছাতাটা নিয়ে যাই, তাতে আমার গায়ে আর জল পড়েনা। এর থেকে আমার মনে হয়েছে যে যা ছায়া দেয়, বাইরের রোদ , ঝড় , জল থেকে আমাদের বাঁচায় তাই হলো ছাতা। মাঝেমাঝে আমি এই ছাতাটা নিয়ে ঘর ঘর খেলিও, এই ছাতা টা টাঙিয়ে তার ভেতরে গিয়ে আমার পুতুলদের নিয়ে গিয়ে বসি। বেশ লুকোচুরি খেলার মতন আমাকে কেউ দেখতে পায়না কিন্তু ওই ছাতার নিচে আমি বসে থাকি। শীত, গ্রীষ্ম বা বর্ষা বছরের সকল সময়েই ছাতা দরকার হয়। ছাতা সাধারণতঃ দুরকমের হয় (collupsable and non collupsable) কোনো কোনো ছাতাকে গুটিয়ে ছোট করে নেওয়া যায়, আবার কোনো কোনো ছাতা লম্বাই থাকে, তাকে গুটিয়ে নেওয়া যায়না।

ইতিহাস বলে প্রথম ছাতার ব্যবহার শুরু হয় চীন দেশে, এবং যথাক্রমে (প্রাচীন) মিশর, গ্রিস এবং আমাদের দেশ ভারত এ। তবে সমসাময়িক ইউরোপিয়ান বিভিন্ন দেশেও ছাতার ব্যবহার শুরু হয়। এবং পরে ব্রিটিশ শাসনকালে ইংরেজ দের হাত ধরে এদেশে আসে নানান রং বেরঙের হাল ফ্যাশনের ছাতা। বর্তমানে পৃথিবীর সমস্ত দেশ এই ছাতার ব্যবহার করা হয়। ১০ th february কে বিশ্ব ছাতা দিবস বা national umbrella day হিসেবে পালন ও করা হয়। বার্বি থেকে শুরু করে নানান জাপানী পুতুলের হাতে খুব সুন্দর সুন্দর ছাতা থাকে।

পাপাই বলেছে, ছাতা শব্দ টা এসেছে সংস্কৃত শব্দ ছত্র থেকে। হিন্দু, বৌদ্ধ আর জৈন ধর্মের কাছে ছাতা খুব একটি শুভ চিহ্ন। যার সূত্র ধরেই অনেক দেব দেবীদের মাথায় ছাতা দেওয়ার একটি রীতি আছে, এবং একসময় বিভিন্ন রাজা রাজরাও যা নিজেদের আভিজাত্য দেখানোর ক্ষেত্রে বহন করে থাকেন। ছাতার ইংরাজী প্রতিশব্দ হলো umbrella.
ছাতাটা যেন আমার পাপাইয়ের মতন। আমার পাপাই যেমন সব কিছু থেকে আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, আগলে রাখে, এই ছাতাটাও যেন তাই।

ছাতা টা বাবার মতন না বাবারা ছাতা হয়ে আমাদের সবকিছু থেকে আগলে রাখে, ঢেকে রাখে সে কথা ঠিক করে বোঝার ক্ষমতা আমার তখন ঠিক হয়নি, কিন্তু এখন হয়েছে। এখন বুঝতে পারি, বাবারা সত্যি ই ছাতার মতন করে আমাদের কে বাহ্যিক যা কিছু অসহনীয় তার থেকে ঢেকে রাখে, আগলে রাখে। প্রতিটা পদক্ষেপে ঠিক কোথায় কোথায় কি কি করতে হবে, কিভাবে গেলে তাঁর সন্তান সুরক্ষিত থাকবে, এমনকি শুধুই ওই মুহূর্তের জন্যে নয়, চিরকালীন চিন্তা করে, ভবিষ্যতে ও যাতে সে এক ই ভাবে সুরক্ষিত থাকতে পারে, এইসব ভেবে, আমাদের এক একটা পদক্ষেপের আগে থাকে ওই মানুষটার এই এতকিছু ভাবনা।
তাইতো শুধু ছাতা নয়, যখন অনেক বড় বড় কোনো গাছ দেখি, মহীরুহ , এইরকম মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি , গায়ের রং কেমন একটা কালচে বাদামী , বিশাল বিশাল ডাল পালা পাতা, অনেক রোদের মাঝেও যার তলায় গিয়ে দাঁড়ালে সমস্ত দেহমন শীতল হয়ে জুড়িয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনা। খুব রোদে তাপে পথ যখন রুক্ষ হয়ে রাস্তা আগলে দাঁড়ায়, তখন মনে মনে আমরা খুঁজে চলি এমন ই কোনো মহীরুহ কে, মনে হয় একটু দাঁড়াই কাছে গিয়ে, একটু বসি এর তলায়। ওই শান্তির আশ্রয়টাই অনেকটা পথ হেঁটে যাবার শক্তি জুগিয়ে দেবে। খুব ভাগ্যবানরা তাদের মা বাবাকে জীবনের অনেকটা পথ পর্যন্ত পায়, তাদের আলো ছায়ায় ভরিয়ে রাখার জন্যে, ছেলেমেয়ের ছাতা হয়ে থাকার জন্যে। আর আমার মতন হতভাগ্য যারা যারা জীবনের কিছু টা চলেই ওই ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়, তখন মাথা কুটে মরে গেলেও সেই স্নেহময় মধুর ছায়াটি যেন কিছুতেই পাওয়া যায়না। তবে না হয়তো বা এটা ঠিক ব্যাখ্যা হলোনা বা, কারণ physically ওই মানুষটাকে কাছে পাই বা না পাই, তাঁর স্নেহচ্ছায়া থেকে বঞ্চিত আমি একথা কখনো ঠিক নয়। কখনো নয়। তাঁর স্নেহছায়া আছে বলেইতো সব কাজে এত জোড় পাই, শক্তি পাই। তবে হ্যাঁ এটাও ঠিক যে কখনো কখনো ওই ছাতার মতো কাউকে সামনে থেকে সত্যি পেতে খুব ইচ্ছে করে। আমরা যে রক্ত মাংসের মানুষ। তাই নয়নের সম্মুখে না থেকে নয়ন মাঝে ওই মানুষটা ঠাঁই নিয়ে আছে জেনেও, তাকে নয়নে সম্মুখেই তবু চাই। বাবারা যেভাবে আগলে রাখে, তা কেউ ই পারেনা কখনো। তবে জীবনে চলার পথে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ কখনো কখনো আসে, তাদের মধ্যে, না ছাতা হয়ে হয়তো কেউ আসেনা তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছাতা হাতে করে নিশ্চই আসে। কিছুটা সময় কিছুটা রাস্তা ওই যে যতটা আমাদের ভাগ্যে বরাদ্দ থাকে, ততটা রাস্তা বেশ নিশ্চিন্তে হাঁটা যায়। মনে হয় এখানে আমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই, দরকার নেই অকারণ চিন্তার। আমার কাজ শুধু হেঁটে যাওয়া। পাশের মানুষটার ছায়ায় বেশ নিশ্চিন্তে আমি চোখ বন্ধ করে হেঁটে যেতে পারি।

আজ যখন বাবা আর কাছে নেই, তার সেই ঢাউস ছাতার নিচে তার আদরের মান্তুকে আগলে সমস্ত রোদ, ঝড়, জল থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলার (physically), তখন ও মনে এখনো চোখ বন্ধ করে সেই ছবিটাই ভেসে আসে, আর মন বলে, এই মান্তু তো নাহয় বড় হয়ে গেছে অনেক। কিন্তু আরো ছোট্ট মান্তু যেন ওই ছাতাটা পায়। ঠিক করে। যেন ঝড়, বৃষ্টি, রোদের আঁচ না লাগে তার গায়ে।  

No comments:

ইচ্ছেনদী

আমার ল্যাব টা মাউন্ট sinai এর ১০ তলায়, আর আমার ওয়ার্কিং ডেস্কটা একদম জানালার ধারে , বিশাল জানালা। মনে হয় মেঘ গুলো এখুনি ঢুকে পড়বে এর মধ্যে। ...