Tuesday, 4 June 2019

কানায় কানায়

টলটলে শান্ত স্থির শীতল দীঘির ধারে থাকতো এক মাছরাঙ্গা। শান্ত সবুজ আলোছায়া ঘেরা গাছগাছালি। ঝিকিমিকি দীঘির জল।  দিন যাচ্ছিলো তার নিজের মতো করে। দীঘির জল এ  ডুব দিতো, মাছ নিয়ে মুখে করে তার ছোট্ট বাচ্ছা মানুষটাকে দিতো, তারপরে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীর গল্প বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে পড়তো। একটু একটু করে ওই তার ওই ছোট্ট ছানা টিকে বড় হতে দেখতে দেখতে তার দুচোখ আশায় গর্বে ভোরে উঠতো। এইভাবে রূপকথার জগতে তরী বেয়ে তার দিন কাটছিলো। 

এমন সময় একদিন ধ্যানমগ্ন মাছরাঙ্গা যখন দীঘির ধারে চুপ করে বসেছিল, হয়তো বা তার চোখে ছিল কোনো মেঘের ছায়া। সময়টা ছিল শীতকাল। দেশ বিদেশের পরিযায়ী পাখিরা তার এই সুন্দর গ্রাম বাংলার ছায়া সুনিবীড় শান্তির নীড় এ আসছিলো, যাচ্ছিলো। সেইরকম কোনো এক বিষন্ন বিকেলে, শীতের আসন্ন সন্ধ্যের নিস্তব্ধতার মধ্যে দেখা হলো এক পরিযায়ী পাখির সাথে। অনেকটা আমাদের দেশের চড়াই পাখির মতো যার আকার আয়তন, অর্থাৎ কিনা মাছরাঙ্গার থেকে অনেক পুচকে মতন ছিল সেই পাখি। সাদা রঙের পালকে ঢাকা, আর দলের নানান সঙ্গীদের থেকে ছিল একেবারেই সাধারণ তার চাল চলন আহার বিহার। তা সেই পাখি তার চোখে দেখলো আসন্ন রাত্রির ছায়া। জানতে চাইলো কারণ, বললো এইতো রাত পেরিয়েই আবার ভোর হয়ে যাবে, কেন তবে তুমি মনখারাপ করে আছো। মাছরাঙ্গা বললো বসবে আমার পাশে, আমার এই স্থির শান্ত দীঘির ধারে। পরিযায়ীর মনে ছিল চিরকালীন থিতু হবার স্বপ্ন। বসলো সে। তারপরে কত কথা কত কাহিনী। যেন জন্ম জন্মান্তর ধরে দুই ভিন্ন দেশী ভিন্ন পরিস্থিতির পাখির মনে জমেছিলো কত হাজারো না বলা গল্প। ধীরে ধীরে সেই একদিনের অল্প আলাপ পরিণত হলো গভীর বন্ধুত্বে। মাছরাঙ্গার মনে হলো তার যে এমন এক সুন্দর গাঢ় নীল রং আছে, একথা এমন ভাবে তো তাকে কেউ বলেনি, আর পরিযায়ীর মনে হলো তার এই যে সাদা রংটাকে সে এতদিন খুব সাধারণ ভেবে এসেছে, তা সত্যি ই কাউকে রঙ্গীন করে তুলতে পারে? এইভাবে কিছুদিন স্বপ্নের মতো কেটে চললো। পরিযায়ীর ফেরার পালা, মন চায় তার স্থির নিস্তরঙ্গ এক জলতরঙ্গ। চির শান্তির আশ্রয়। আর মাছরাঙ্গার ক্ষণিকের জন্যে মনে হলো, আমিও যদি যেতে পারতাম দূর থেকে দূরে। "নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারে তে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। " তারা দুজনেই না পারে, তাদের আপন আপন বৃত্ত ভেঙে বেরোতে, না পারে সেই বৃত্তের ভেতরে থাকতে। এমনি এক অবস্থায় পরিযায়ী বারবার চলে আসে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে সেই ঝিলের ধারে , দুজনের দেখা হয় কিন্তু তাতে আরো বেশি কাছে পাবার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে। পরিযায়ী ভাবে এ কি বিড়ম্বনা। এ দেখা নাহোলেই ছিল বেশ ভালো আর নীলকণ্ঠী মাছরাঙা ভাবে দেখা হয়েছে যখন,তখন এর কিছু শুভ উদ্দেশ্য নিশ্চই আছে। ওপর থেকে বিধাতা হাসেন। আর এভাবেই দুই দূর প্রান্তের দুই ভিন্ন পরিস্থিতিতে থাকা মন নিজেদের মতো করে একে অপরের কর্তব্য পালন করে চলে, আবার সেই দুই মন নিজেদের মতো করে একে অপরের কাছে আসে। তাদের ভিন্ন জায়গা, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন আচার বিহার, তবু কি যেন এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন তাদের একে অপরকে রেখেছে বেঁধে। 
আসলে ক্ষুদ্রতর জায়গায় যা আলাদা, বৃহত্তর ক্ষেত্রে তাই যে এক। ধরো পৃথিবীর এক প্রান্তে যখন দিন অন্যপ্রান্তে তখন রাত , একদিকে যখন ঠান্ডা অন্যদিকে তখন গরম অথচ আবার যখন বৃহৎ বৃহৎ অনেক বৃহত্তর বৃত্তে আপন আপন গন্ডির বাইরে গিয়ে যদি আমরা ভাবি, তখন দেখি একটি ই সূর্য্য এই কান্ডটি ঘটাচ্ছেন , সেই এক ই সূর্য্যকে আমরাও দেখছি আবার দেখছে অপর পক্ষের সবাই ও। আকাশ ভরা তারা জায়গা বিশেষে পর্যোবেক্ষণের অবস্থান বদলায় ঠিক ই কিন্তু যার পরিপ্রেক্ষিতে তা বদলায় সেই বিশাল অসীম মহাবিশ্বের প্রেক্ষাপট যে একটি ই। সেই এক ই আকাশ। এক টি ই চাঁদ। যে চাঁদ দেখে রবিঠাকুর বলে উঠেছিলেন "চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে", সেই চাঁদ দেখেই আবার Wordsworth বলেছেন "The Crescent-moon, the Star of Love, /Glories of evening, as ye there are seen".    
তবু রক্তমাংসের বাস্তব দুনিয়াতে এমন দার্শনিক কথা মেনে এবং মনে নিয়ে চলা খুব দুষ্কর। ফলত: ঝড় উঠতো, এবং সেই ঝড়ে কখনো আমাদের নীলকণ্ঠী অভিমানে গলা ফুলিয়ে বসে থাকতেন, কখনো বা শুভ্র চড়াইটি মুখ কালো করে অভিমানে মুখ লুকোতে। নীলকণ্ঠীর মনে হতো তুমি তো আর কখনো আমার হয়ে থাকবেনা, কেন তুমি আমার হয়ে থাকতে পারোনা? অভিমানে তার গলা ধরে আসতো, চোখে আসতো জল, মনে হতো এসব মিথ্যে, কখনোই পরিযায়ী আমার হবেনা, একদিন ঠিক আমাকে ভুলে অনেক দূরে চলে যাবে। পরিযায়ীর মনে হতো, নীলকণ্ঠীর নিজের দুনিয়াতে সে বড় ব্রাত্য। কেনই বা সে তার সুন্দর স্থির নিস্তরঙ্গ জল এ ঢেউ তুলে যাবে? নাহ এ তার কখনোই ঠিক নয়, এভাবে তার শীতল দীঘিতে ঢেউ তোলার সে কেউ ই নয়। সে আর কখনো নীলকন্ঠীর বৃত্তের ভেতরে আসবেনা। এমন কথা শুনে নীলকন্ঠীর হতো রাগ, সে প্রমান করতে বসত যে বস্তুতঃ ই  তার দীঘির জল না ছিল কখনো শান্ত, না ছিল কখনো শীতল। পরিযায়ী চড়াই দিতো কানে আঙ্গুল, কিছুতেই সে শুনবেনা। এভাবেই সময় পেরোচ্ছিলো। 

এই দুটির কথা অলক্ষ্যে জানতেন শুধু একজন, তিনি চুপচাপ মিটিমিটি হেসে লিখে চললেন কাহিনী। সে কাহিনীর শুরু কিভাবে কোথায় বা শেষ সে সব কথা ধীরে ধীরে হলো অপ্রাসঙ্গিক। সে কাহিনীতে সত্যি হয়ে রইলো শুধু ঝিলের শান্ত নিস্তরঙ্গ জল, ঝিকিমিকি সূর্যের আলো, কালো পিচ ঢালা রাস্তা, শীতের উষ্ণ আদর, গ্রীষ্মের দাবদাহ, বর্ষার জল, ভরা নদী, অপরাজিতার গাঢ় নীল, গোলাপের পাপড়ি, জুঁই এর শুভ্রতা, গন্ধরাজের মত্ততা, কৃষ্ণচূড়ার লাল, চাঁপার মৃদু অথচ উজ্জ্বল মধুর তেজ, সুবাসিত রাত্রি, ভোরের স্নিগ্ধতা, নতুন দিনের আশা, সোনালী বিকেল, গোধূলির আবেশ, ধূপের গন্ধ, ধুনোর ঘোর, শঙ্খ ধ্বনির শান্তি, কাঁসার থালার সাবেকিয়ানা, খাওয়ানোর আকুলতা এমন কত কি। আর এই সব কিছু আবর্তিত হতে থাকলো ওই একটি ই সূর্য্য , একটি ই চাঁদ , এক ই আকাশ ভরা তারা, আর একরকম রং এক ই তুলি দিয়ে আঁকা একরকম স্বপ্নকে ঘিরে। সেই স্বপ্নই তাদের নিজ নিজ জায়গার ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে তাদের স্থির রাখতো, জোর দিতো মনে, দুর্বলতা নয়, শক্তি হয়ে থাকতো , আর দিনের শুরুতে তাদের মনে হতো আর একটা নতুন দিন, আর একটা নতুন স্বপ্ন, আরো একবার নিজেদের সব কিছু জেনে নেবার বুঝে নেবার সময়। আর দিন শেষে তারা সারাদিনের ছোটো বড় সকল প্রাপ্তিকে একে অপরের সাথে ভাগ করে নিয়ে চলতে থাকলো। 

না প্রয়োজন কিছুমাত্র ছিলোনা এদের একে অপরকে, কিন্তু সকল প্রয়োজন সব স্বার্থের থেকে উর্ধে উঠে এই যে সম্পর্ক, এর নাম আমার জানা নেই, জানা নেই হয়তো বা এ বিশ্বের সেই মহাকাল সেই মহাকবির ও। তাই হয়তো তিনিওবা তখন আপন লেখনী থামিয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এ পৃথিবীর বুকে সূর্য্যকে বললেন আরো মধুর হয়ে উঠতে, চাঁদ কে বললেন আরো স্নিগ্ধ আরো নরম হয়ে আদর হয়ে জড়িয়ে রাখতে, আর ফুলে ফলে রঙে রসে সবুজে সবুজে ভোরে দিতে প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটি ক্ষণ। প্রতিদিনের যে বাঁচা সকল স্বার্থের থেকে উর্ধে এসে থাকতে পারে, যার মধ্যে এতটুকু স্বার্থের ছোঁয়া থাকেনা এমন গভীর বোধের গোপন প্রাপ্তিকে কেউ না বুঝুক শুধু তার ব্যাপ্তিটুকু এই দুই মন কে কানায় কানায় রাখুক ভরিয়ে। সেই দুই মনের গভীরে তাই সকল কলুষতা হিংসা স্বার্থ হানাহানি কাড়াকাড়ি লড়াই কিছু প্রবেশ করতে পারেনা, সকল অশান্তি যেন ঠিক ওই দীঘির জল এর মতোই স্থির শান্তি নিয়ে এসে দুই মনকে একেবারে ভিজিয়ে দিয়ে যায়, আর সেই ভেজা মনের নরম মাটিতে জন্ম নেয় নব বোধের কচি সবুজ চারাগাছ; ভালোবাসায় আদোরে সোহাগে যত্নে তাতে ফুল আসে, ফল হয়, সবুজ চারাগাছ পরিণত হয় মহীরুহে , ছায়া দেয়। আর সেই ছায়া, নতুন উজ্জ্বল আলোর সাথে মিশে গিয়ে এক অদ্ভুত মায়াজাল রচনা করে এই দুই মনকে পরিপূর্ণ করে রাখে। কানায় কানায়। এর যেন বিরাম নেই, বারণ নেই, নেই থেমে যাওয়া, সেই যে একসময় কালিদাস যেমন লিখেছিলেন সেইরকম ই বলতে ইচ্ছে করে, সহস্র বৎসর যেন এইভাবেই এক লহমায় পেরিয়ে যায়। এই কানায় কানায় পরিপূর্ণতা যেন সকল অপ্রাপ্তি, সকল অন্ধকারকে একেবারে আলোয় আলোয় প্রাণ দিয়ে ভরিয়ে দেয়। কানায় কানায়। 

No comments:

ইচ্ছেনদী

আমার ল্যাব টা মাউন্ট sinai এর ১০ তলায়, আর আমার ওয়ার্কিং ডেস্কটা একদম জানালার ধারে , বিশাল জানালা। মনে হয় মেঘ গুলো এখুনি ঢুকে পড়বে এর মধ্যে। ...