Sunday, 5 April 2020

অবসরের জানালায় সবার জন্যে খোলা চিঠি

Hi, কথা বলছি নিউ ইয়র্ক থেকে। হ্যাঁ , ঠিক ই বুঝেছেন। করোনার epicentre যে নিউ ইয়র্ক সেখান থেকেই। গত পরশুদিন গোটা USA তে মারা গেছে হাজারের ও বেশি মানুষ। আমার দেশ এও সংখ্যা বাড়ছে, তার থেকেও বেশি বাড়তে চলেছে না খেতে পেয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা। আমার পুরোনো প্রতিষ্ঠানের দুজন কলিগ এর থেকে জানলাম প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গুলো অর্থনৈতিক মন্দা বন্ধ করতে কিভাবে স্যালারি কম করে দিতে চাইছে। মরিয়া হয়ে খুঁজছে কিছু ফরেন collaboration , যেখান থেকে খড় কুটোর মতো ভেসে থাকতে চাইছে। এসব তথ্য এই আমাদের সবার জানা। তবু আমাদের অনেকের মন ই কিছুতেই আর ঘরের মধ্যে থাকতে চাইছেনা। মনে হচ্ছে ইশ পাড়ার দোকান টাতে বসে কবে যে আড্ডা দেব। এখানের চিত্র ও এরকম ই কিছুটা। আমার জানালার নিচেই আছে এক সবুজ পার্ক। সেখানে প্রতিদিন ই স্বাস্থ সচেতন মানুষ বোধয় খোলা আকাশের নিচে আলো হাওয়া নেবে বলে আসে এবং নাকে মুখে কিছু না বেঁধেই আসে , নাকে মুখে কিছু বেঁধে এলে আলো বাতাস একটু কম ভেতরে প্রবেশ করতে পারে তো। এবং সব বয়সের লোকেদের ই বেশ হলিডে মুড এ একটা পিকনিক পিকনিক মেজাজে জগিং করতে, হাঁটতে এবং গল্প করতে দেখা যায়। ফলত USA এর সংখ্যা যে কেন বাড়ছে সেটা বুঝতে বিশেষ অসুবিধে হয়না। আমার এই অবসরের জানালাতে বসে আমি সারাদিন ধরে এই আকাশ টিকে দেখি। এই যে আকাশ টি দেখছেন। এই আকাশ টি। তো এই আকাশ আমাকে দিয়েছে নিজের মধ্যে একান্ত নিজের মতন করে থিতু হবার আর ভাবনার সময়। এই ভাবনার মধ্যেই চলতে থাকে আমার দৈনন্দিন কাজ, ঘরের কাজ, গবেষণার কাজ, অল্প অল্প আঁকা, লেখা, কবিতা, গল্প, গান। অনেকদিন পরে আবার আকণ্ঠ ডুব দিতে পারছি গল্পের বই এর দুনিয়াতে। পাচ্ছি ঠাকুরের সামনে বসে নিরবিচ্ছিন্ন ধ্যান মগ্ন সন্ধ্যার সান্নিধ্য। আর আপাতত কফির কাপ এ চুমুক দিতে দিতে না ভাবতে চেষ্টা করছি যে আমি আমার কাছের মানুষদের থেকে অনেকদূরে, কবে কোথায় তাদের দেখতে পাবো জানিনা বা আমি একা , বা আমার একলা বয়স্ক মা কিভাবে হাসিমুখে লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছে। এইসব। কারণ গোটা দুনিয়া আজ যে গভীর সংকট এর মধ্যে দিয়ে চলেছে বা চলতে যাচ্ছে, তার সামনে আমরা যারা নিজেদের চাল ডাল টা অন্তত আগে থেকে সংগ্রহ করে রাখতে পারছি , তাদের নিজ নিজ ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ তুচ্ছ হয়ে যায়। অন্যমনস্ক হতে চাইছি আমাকে গতকালকে পাঠানো একটি ছবি থেকে, এক পিতার ছবি, যে দুটো ভাতের আশায় একদিন নিজের জায়গা ছেড়ে হরিয়ানার রাস্তা তৈরির কাজে এসেছিলো, আজ এই অতিমারীতে সেই দুমুঠো ভাতের আশা অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বন্ধ হয়ে যাওয়াতে, পায়ে হেঁটে প্রায় মৃতপ্রায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় নিজের জায়গাটা তে ফেরার চেষ্টা করছে, যেখানে অন্তত মাথার ওপরে একটা ছাদ আছে। ছবিটি সত্যি। অসংখ্য মানুষ এইভাবে এক ই কারণে বাড়ি ফিরছেন, আমার পুরোনো প্রতিষ্ঠানের কিছু সহকর্মী চাঁদা তুলে এদের হাতে তুলে দিয়েছে কিছুটা রাস্তার রসদ আর বেসিক কিছু স্বাস্থ্য সচেতনতা। তাই এছবি আমার কাছে পৌঁছেছে। কিন্তু এও জানি, তাদের প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের কিছুই সাধ্য ই নেই কিছু করার। শুধু একটা জিনিস ছাড়া , সেটা হলো এই ভাইরাস টিকে কিছুভাবেই কোনো হোস্ট বডিএর প্রশ্রয় না দেওয়া অর্থাৎ কিনা আমরা আপনারা যারা কিনা বাড়ি থেকে না বেরিয়ে খেতে পড়তে পারছি তারা অন্তত চেষ্টা করি বাড়িতে থাকতে। যত সঠিক ভাবে আমরা এইটা পালন করবো তত তাড়াতাড়ি ওই দিন আনতে দিন খাওয়া মানুষ গুলো আবার হাসি মুখে কাজ করে খেতে পারবে। তত তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হবে আমাদের চারপাশের ছবিটা। কিছুদিন পরে আবার কিন্তু আপনাকে আমাকে ট্রেন ট্রাম বাস মেট্রোতে ভিড়ে ঝুলে ঝুলে বসার জায়গার জন্যে লড়াই করতে করতে বা tarffic জ্যাম এর মধ্যে গাড়ি নিয়ে আটকে পরে শুরু করতে হবে গ্রাসাচ্ছাদনের চিন্তা। তখন ও আমি নিশ্চিত আমাদের কারোর কারোর মনে হবে বেশ চিলত quarrnatine এর সময় টা, ফেইসবুক জুড়ে আবারো আস্তে শুরু করবে those time বা missing corona এলেও আশ্চর্য্য হবোনা। আমরা সবসময়েই সময় চলে যাবার পরে তার মূল্যটা বুঝতে পারি আর সেই সময় টা কি নেই এর হিসেবে করতে করতে কি আছে সেটা দেখতেই ভুলে যাই, পরে হা হুতাশ করতে বসি। তার থেকে বরং এই সময়টাকেই উপভোগ করি। আসুননা। চারপাশের জগৎ টাকে তো দেখাই হয়না, মোবাইল এর ছোট্ট স্ক্রিন ই মুখ ডুবিয়ে যাওয়া আর আসা। আজ যখন প্রকৃতি সুযোগ দিয়েছেন, দেখে নিন চারপাশটাকে কে বলতে পারে, হটাৎ করে খুঁজে পেলাম কোনো নতুন সঙ্গীকে। ধরুন আপনার পাশের বাড়ির দস্যু বেড়াল টা যে একলা দুপুর বেলা কেমন ঘন্টার পার ঘন্টা ওই আম গাছের তলায় একটা গাছের দল নিয়ে খেলা করে চলে, আপনি হটাৎ ই আবিষ্কার করলেন তা।অথবা সেই কবে থেকে কে জানে, আপনার বাড়ির সামনের জামরুল গাছে থাকা এক সুন্দরী অথিতি বিহঙ্গ যে আপনাকে রোজ সকালে ঘুম ভাঙ্গায়, একদিন হটাৎ ই সায়াহ্ন এর আলোছায়ায় আপনার সাথে দেখা হয়ে গেলো তার। কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধুর হাতে আঁকা ছবি আমাকে ভীষণ ভাবে মুগ্ধ করে দিয়েছিলো। সে নিজেও হয়তো জানতোনা তার মধ্যে এত সুন্দর এক শিল্পী সত্বা লুকিয়ে আছে। আমাদের জীবনটা বারো সুন্দর। চারপাশের সবকিছুও। আর সময়ের ও বারো দাম। আজ পাচ্ছি, কালকে এই সময় আর নাও থাকতে পারে। এতগুলো বছর তো সবার ভালো থাকার জন্যে রোজগার করে গেছেন, আজ একটু নাহয় নিজের আকাশটা দেখলেন, সারাদিন রান্নার পরে আজ নাহয় চট করে একটু খোলা হাওয়ায় গিয়ে দাঁড়ানোই হলো। নিজের হাতে যদি রান্না করে সবাইকে খাওয়ানোর সুযোগ না পেয়ে থাকেন রোজ, তবে এই কদিন সেই সুযোগ টাকে ব্যবহার করুন প্রাণ ভোরে।
কি জানেন আমরা জানি ই না যে আমাদের মনের কোণে কোথায় লুকিয়ে আছে কোনো গায়ক, বাদক, শিল্পী, ফটোগ্রাফার, সুর তাল ছন্দ মায়ায় ভরা মানুষ। দৈনিন্দিন ব্যস্ততার মধ্যে তা কোথায় চাপা পরে গিয়ে হারিয়ে যায় একসময়। রাজকুমারীর দরকার নেই আমরা নিজেরাই নিজেদের ভেতরের সেই সুপ্ত বীরপুরুষের ঘুম ভাঙাতে পারি একটু সোনার কাঠির ছোঁয়ায়। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু হালকা ভাবে নিয়ে এখন ই বেরিয়ে পড়বেন না। অসংখ্য ডাক্তার নার্স পুলিশ প্রশাসন অনলস চেষ্টা করে চলেছে আমাকে আপনাকে সুরক্ষিত রাখতে, দিনের পার দিন বাড়ি যেতে পারছেনা। ডাক্তার দের মুখে মাস্ক এর দাগ হয়ে গেছে , আপনি আমিতো শুধু  শুয়ে বসে বাড়িতে আছি। এটুকুই তো করণীয়। এটুকুই করি। 

 আবারো বলছি  যত তাড়াতাড়ি আমরা না বেরিয়ে সমাজকে সংক্রামন মুক্ত করে ফেলতে পারি, তত তাড়াতাড়ি আমরা তো বটেই ই ওই দিন আনি দিন খাই মানুষগুলোও আবার বেরোতে পারবে। বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ভবিষ্যতের চিন্তায় শয্যা নিয়েছেন সত্যি। আমি জানি আপনারা এসব ই জানেন এবং মনে করছেন আমি আবার জ্ঞান দিচ্ছি। হা দিচ্ছি। রোজ দিনা। আজ দিচ্ছি। কারণ আমাদের মধ্যে অনেকেই আমার ছেলে মাংস ছাড়া ভাত খেতে পারেনা বা টাটকা মাছ ছাড়া খাবো কিভাবে বলে বেরোচ্ছেন এবং মাছের পেট টিপে, রসিয়ে রসিয়ে কচুর লতি হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরছেন। যদি আপনার পাঁচ বছরের ছেলে এখন ই বিশেষ কোনো পদ ছাড়া ভাত না খেতে পারে, তবে এটুকু বলে দিতে অসুবিধে হয়না যে , আপনার ছেলেকে কিন্তু ভবিষ্যতে তাহলে বেশির ভাগ সময় ই নাখেয়েই কাটাতে হবে।  কারণ সাধের খাবার  টুকু কোলকাতাতে সহজলভ্য হলেও কলকাতা থেকে বাইরে বেরিয়ে বেশি দূরে নয় দিল্লি তে গিয়ে থাকলেই ওটাকে বিলাসিতা মনে হবে। বাস্তবিক ই জানেন দিল্লিতে থাকাকালীন বহু জিনিসকে আমাদের বিলাসিতা মনে হয়েছে, যেমন প্রতিদিন ২৫টাকা piece এর রসগোল্লা খাওয়াটা। তাই কস্মিৎ ক্কাল ছাড়া দিল্লিতে কখনো রসগোল্লা কিনে খাইনি। খেতে ইচ্ছে করলে নিজে বাড়িতে দুধ থেকে ছানা কাটিয়ে বাড়িতে রসগোল্লা তৈরি করে ফেলেছি। এবং এরকম বহু জিনিস ই দু ঘন্টা দু ঘন্টা চার ঘন্টা যাতায়াত এর পরেও নিজে হাতে রান্না করে পরিবেশন করে দেখবেন খারাপ লাগেনা। বাচ্ছাকে অযথা প্যাম্পার করে ভবিষ্যৎ টি ঝরঝরে না করে তাকে সবরকম পরিস্থিতে মানিয়ে নিতে সেখান। কষ্ট হচ্ছে শুনতে তো? খারাপ লাগছে? মনে হচ্ছে, নিজের ছেলে হলে বুঝতিস। হ্যাঁ। কিজানেন নিজের ছেলে বা মেয়েকে আমি তার এইরকম কোনো বায়না মিটিয়ে দিতামনা এবং ভবিষ্যতেও দেবোনা। বরং এই বয়স থেকেই চেষ্টা করতাম তাকে ওই ক্লান্ত, ক্ষুধার্থ, আর্ত , অসহায় মানুষগুলোর চিত্রটার সঙ্গে পরিচিত করতে এবং বোঝাতে যে খাবার বিলাসিতা নয় খাবার হোলো নেসেসিটি। আর তারপরেও সে যদি মুখ ভার করে থাকতো, তাহলে বুঝতাম মানুষ করতে পারছিনা আমি। 
আর একটা কথা আজ না বলে পারছিনা, ভুল কম বেশি সবাই করে থাকে, আপনি আমি সবাই। তাই অযথা কোনো এক বিশেষ সম্প্রদায়ের দিকে আঙ্গুল না তুলে আসুননা, একটু মানুষ হয়ে তাকাই একে অপরের দিকে। এতো মানুষের মৃত্যু, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে রোগী ডাক্তার এর এত অজস্র কাহানি তো সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় পাতায়, তবু কি একটু বদলাতে পারিনা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিকে। আগে সময় ছিলোনা ভাবার, এখন তো পেয়েছি সময়, আসুননা নিজেদের অন্তরে একবার গভীর ভাবে তাকিয়ে দেখি, সেখানে কি শুধুই অসহিষ্ণুতা? compassion নেই? empathy ? এগুলো কি শুধুই বইতে পড়া শব্দ?  আমাদের ভেতরের সেই আমি টাকে জাগিয়ে তুলি চলুন। মানুষ তো আমরা। আমরাই পারবো। জানেন এই সময় কিভাবে আমাদের কত মানুষ চিনিয়ে দিয়ে যায়, এই যে সারাদিনে কত অজস্র ফোন, msg আমার খবর জানতে চেয়ে আমার কাছে আসে। এমন কত মানুষ আছে, যারা প্রতিদিন শুধু একবার তিস্তা? লিখে চুপ করে থাকেন। বছরের পার দেখা না হওয়া কত মানুষ স্যুধু একটি বার নিজের মুখে শুনতে চাইছে কেমন আছি, বাইরে বেরোতে বাড়ান করছে, ভালো ভালো বই পাঠাচ্ছে হোয়াটস্যাপ মেসেঞ্জার এ। তাদের আন্তরিকতায় বুক ভোরে যায়।  এইতো। কে বলে আমরা যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। আমরা পারছি। আমরা পারবো ও. চলুন সবাইকে নিয়ে একসাথে এই সময়টাকে পেরিয়ে যাওয়া যাক। জীবনে এক সাথে চ্যালেঞ্জ নেবার সত্যি সময় এসেছে এবার। শাড়ি পাড়ার মধ্যে ভালোলাগা থাকতে পারে, চ্যালেঞ্জ যদি নিতে চান এইসময় সহিষ্ণুতা দেখিয়ে নি চলুন। আর আপনাদের এ ঘরের কোনো মেয়ে, বৌ অথবা বন্ধু যদি এক অজানা দেশে মাটি থেকে ১০ য়ালা উঁচুতে একটি এপার্টমেন্ট একা টিভি ছাড়া, নেটফ্লিক্স, হৈচৈ কিছুর দরকার বোধ না করে , লোকজনের মুখ না দেখে, শুধু এই জানালা দিয়ে আকাশ দেখে বৈচিত্র মে করে তুলতে পারে নিজের জীবন। তাহলে আমি নিশ্চিত, আপনারা সাছন্দে নিজেদের সময়টা উজাড় করে নিজেদের আরো একটু বেশি ভালোবেসে আর সমৃদ্ধ করে গৃহ বন্দী হয়ে থাকতে পারবেন। 

অবসরের জানালায় সবার জন্যে খোলা চিঠি 














No comments:

ইচ্ছেনদী

আমার ল্যাব টা মাউন্ট sinai এর ১০ তলায়, আর আমার ওয়ার্কিং ডেস্কটা একদম জানালার ধারে , বিশাল জানালা। মনে হয় মেঘ গুলো এখুনি ঢুকে পড়বে এর মধ্যে। ...