Thursday, 15 March 2018

মায়া

সকালবেলা যখন মেট্রো তে আসি, খুব সুন্দর নরম একটা রোদ তখন আমার এই প্রিয় শহর টাকে জড়িয়ে রাখে। প্রিয় বললাম এই কারণেই, কারণ এই জায়গাটা কে খারাপ লাগার মতো সেরকম কোনো কারণ আমি পাইনি। বরং প্রায় গত ৭ বছর ধরে এই শহর টা আমাকে দুহাত ভোরে এনে দিয়েছে অসংখ্য opportunity . আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এই শহর এ এসে। predoctoral , doctoral , postdoctoral.....premarital থেকে marital ,  বন্ধুত্ব থেকে একসাথে ঘরবাঁধা, আমাদের সংসার, স্বপ্ন দিয়ে সাজানো প্রতিটা কোণ। আঙুলে আঙ্গুল ছোঁয়া থেকে হাত ধরা, হাতে হাত রাখা, পাশে থাকার অঙ্গীকার। মুখে শুধু বলা নয়, লোক দেখানো ফেসবুক এ শুধু গলা জড়িয়ে ছবি দেওয়া নয়, সত্যি হাত না ছাড়া। সংসার অনলে চারিদিক যদি পুড়েও যায়, বারংবার যদি স্বপ্ন আহত হয় ও, তবুও আবার স্বপ্ন দেখা, স্বপ্নের বীজ বোনা, তাতে জল দেওয়া, প্রাণ দেওয়া, আর ওই আগুন থেকে সযত্নে রক্ষা করে আস্তে আস্তে বড় করে তোলা ভালোবাসার চারাগাছ। এও এক সাধনা। যে করে শুধু সেই জানে এ সাধনের ত্যাগ, তিতিক্ষা, গভীরতা। 

আর এই সাধনাতে আমাকে অনেকের সাথে, অনেক কিছুর সাথে, সাহায্য করেছে, আমার এই শহর টাও। কত কিছু যে শিখিয়েছে। সব থেকে বেশি করে বোধয় এই শহর টাতে আসার পরে আমি নিজেকে চিনতে পেরেছি। অস্মভব আত্মসম্মান বোধ আর আত্মবিশ্বাস, এই শহর টাই দিয়েছে আমায়। ফিরে পেয়েছি নিজেকে, বুঝতে পেরেছি নিজেকে, অন্যকে। দেখেছি চড়া makeup এর নিচে লুকিয়ে থাকা কদর্য্যতা। আবার তার ই পাশে খুঁজে পেয়েছি শিশুর সারল্য। বুঝেছি, আমাদের চারপাশে প্রতিদিন ঘটে যায় এমন অসংখ্য ঘটনা, তার মধ্যে মন কে ক্লেদাক্ত করে দেবার মতো ঘটনাও যেমন আছে, তেমন ই মন কে পবিত্র করে দেবার মতো অনেক কিছুই ছড়িয়ে আছে। কোনটা কুড়িয়ে নেবো আর কোনটার দিকে ফিরেও তাকাবোনা, সেটা সম্পূর্ণ আমাদের ওপর নির্ভর করে।

আজকের সকাল টা অন্যদিনের মতো আনন্দের সাথে শুরু করতে আমি পারিনি, কেমন এক মনখারাপ মেশানো সকাল ছিল আজকের। যত দিন এগিয়ে আসছে এই জায়গাটা ছেড়ে চলে যাবার, ততো বেশি করেই যেন এই জায়গাটা আমাকে মায়ায় জড়াচ্ছে। কি যে পোড়া মন একটা আমার। কোনো কিছু ছেড়ে চলে যেতে বড্ডো মনখারাপ হয়। যখন স্কুল এ পড়তাম, মনে আছে নতুন ক্লাস এ যখন উঠতাম, নতুন বই এর আনন্দের সাথে সাথে পুরোনো বই গুলোর জন্যে খুব মনকেমন করতো। খুব যত্ন করে ভালো করে সেগুলোকে আবার রেখে দিতাম। অর্পিতা বলে আমার এক জন পাড়াতুতো বোন ছিল, টুকটুক করে এসে ও সেই বই গুলো নিয়ে যেত। 

সেরকম ই হয়তো, আমার এই শহর , কাগজফুলে মোড়া বসন্তের এই সময়, যেন বারবার আমাকে এখান থেকে চলে যাবার এক মনখারাপ এ করে তুলছে কর্মবিমুখ, ভুলিয়ে দিচ্ছে আমার সমস্ত বাস্তববোধ কে। শুধুই যেন ওই সৌন্দর্য্যে বিভোর হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। এ ইচ্ছে অলীক। জীবিকার প্রয়োজনে জীবন কে কখনো বলতেই হয় "রোসো ভাই, আর কাব্য করোনাতো, ওসব রাখো, অবসর জীবনে বসে বসে কাব্য করে চলো মন খুলে।..এখন নয়। " সত্যি কি তাই....কাব্য কি অবসর জীবনে হয়, নাকি জীবনে অবসর কোনোদিন সেভাবে আসে, কাব্য কি মানুষ কে 'চলো ভাই একটু কাব্য করি.'..এই ভেবে করতে হয়। কবিতা কি আমাদের প্রতিদিনের সমস্ত কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে নেই? ওই গাছের পাতায়, নরম রোদের আলতো সকালে, পাতা ঝরা শীত এ বা কচিপাতায় মোড়া বসন্তে, সব কিছুর মধ্যেই কি সেই ছন্দ, সুর, তাল, লয়  এ সময় থমকে যায়না? আমিতো বেশ শুনতে পাই, চাঁদনী রাতের শিহরণের ছন্দ, বিষণ্ণ বিকেলের সুর, এমনকি প্রচন্ড গরমের বিদগ্ধ দুপুরের ও আছে এক না বলা বাণী। শুনতে চেও কাছে গিয়ে, নরম সুরে জিজ্ঞাসা করে দেখো।..দেখবে বুক ভোরে আছে তার না বলা কথায়। কবিতার ছন্দের মতো, গানের সুরের মতো সারা দুপুর তোমার বয়ে যাবে, সেই কথার ঘোরে। শুধু একবার শুনতে চেও।

আমার শহর, নিজের হাতে গড়া আমাদের ছোট্ট সংসার আর শহরতলীর এই একান্ত আপনার আমার ছোট্ট ঘরের কোণ। শহর আর শহরতলী, এই দুয়ের ভালোবাসা, এই দুয়ের মায়া আমাকে এই কয়েকবছর যেন একদম আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। সেই মায়াকাজল চোখে দিয়ে আমি সবকিছুর মধ্যে খুঁজে পেয়েছি অনন্ত ভালোলাগা। ঘুম ভেঙে উঠে চাঁদ দেখেছি। পাগলের মতো কাজ করেছি, পড়াশুনা করেছি, বিকেলে কফির কাপ এর চুমুকে জীবন্ত হয়ে উঠেছে আমার ক্যাফেটেরিয়ার নরম আদর, দুচোখ ভোরে দেখেছি ওই আবীর মাখানো গোধূলি, ধ্যানমগ্ন সন্ধ্যার সান্নিধ্য এ পেয়েছি নিশ্চিন্তের শান্তি, ব্যাডমিন্টনের racket এ শেষ করে দিয়েছি সমস্ত না পাওয়ার অভিমান, তারপর রাত্রির মুগ্ধতা দুচোখে জড়িয়ে নিয়ে পরের দিনের নতুন ভোরকে করে নিয়েছি আলিঙ্গন।

শনি রবিবার গুলোতে আমাকে রান্নার নেশাতে পায়, যদি আমি বলি, সেও এক অনবদ্য কবিতা, জানি, হাসবে তুমি। তা হাসো, কিন্তু ভাবোতো তেল, মশলা আর সমস্ত উপকরণ যদি সঠিক ভাবে ছন্দবদ্ধ না হয়, সুরে সুর যদি না মেলে, তাহলে কখনই কি আর সে সঠিক রান্না হতে পারে? সেই কবিতার সুরে আমাদের রসনা হয়েছে তৃপ্ত। দিল্লীর অলিতে গলিতে আছে অনেক ইতিহাস। সেই ইতিহাস কুড়োতে কুড়োতে কখন আমাদের ও অনেক ভালোলাগা ছড়িয়ে দিয়েছি ওই কালীবাড়ি প্রাঙ্গনে, মার্কেট ২ এর আড্ডায়, বাউলির সিঁড়িতে, c.p. এর রাস্তায়, নিজামের কাবাব এ, karims এর কোর্মা তে, পুরোনো দিল্লির ঘিঞ্জি গলি বা গুরগাওঁ এর মেকি আধুনিকতায়; জামা মসজিদের আজানে বা ইস্কন এর আরতিতে, বাংলা সাহেবের আতিথেয়তায় বা অক্ষরধামের চাকচিক্যে, গুরবায়ুর সিম্প্লিসিটিতে বা লোটাসে র শান্ত সৌন্দর্য্যে। মনে আছে যেদিন প্রথম ওখানে যাই, আরতির তালে তালে চোখ দিয়ে দরদর করে জল পরে চলেছিল, আর সেই প্রথম আমি কান্না লুকানোর কোনো চেষ্টা করিনি। কান্নার মধ্যে যে এতো তৃপ্তি আছে সেদিন বুঝেছিলাম।

এইভাবেই কখনও এই শহর আমার কাছে ওই pollution, রেপ বা চুরির শহর হয়ে উঠেতে পারেনি, খুব এক ভালোলাগার শহর হয়ে থেকেছে। জানি যেখানেই যাবো, যেখানেই থাকবো সেখানেও আবার খুঁজে পাবো আমার হাজার ভালোলাগা। নিশ্চই খুঁজে পাবো। তবু আমার আমি টাকে এই শহর টাই এনে দিয়েছিলো আমায়, আর সেই আমি টাই আবার কোনো এক মধ্যাহ্ণের, নিস্তব্ধতার মধ্যে, সন্ধের শান্তির মধ্যে দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাদের দুজনার ভালোবাসায় মোরা সুখী গৃহকোণে। ঝড়ের মধ্যে দিয়েও বারবার খুঁজে পেয়েছে সেই বন্ধুতার হাত। সেই সব কিছুকে, সেই অনুভবের জায়গা গুলোকে কি ছেড়ে যাচ্ছি? জানিনা।.কেন আর কিসের এই মনখারাপের নেশায় পেয়েছে আমায়। 









No comments:

ইচ্ছেনদী

আমার ল্যাব টা মাউন্ট sinai এর ১০ তলায়, আর আমার ওয়ার্কিং ডেস্কটা একদম জানালার ধারে , বিশাল জানালা। মনে হয় মেঘ গুলো এখুনি ঢুকে পড়বে এর মধ্যে। ...