আমার ঘুম ভাঙে ঠিক ভোর ৫ টায়। শীত , গ্রীষ্ম , বর্ষা সবসময় ৫ টা থেকে সারে ৫টার মধ্যে আমার সময় ঘড়ি আমায় জাগিয়ে দেয়। খুব আশ্চর্য্য লাগে, আমাদের ওখানকার থেকে ভোর এখানে হয় প্রায় ঘন্টা খানেক দেরিতে। অন্তত আধ ঘন্টা তো বটেই, তবুও ঠিক ওই সময় টাতে আমার পূর্বঅভ্যাস আমাকে তুলে দেয়। একেই কি বলে অভ্যেস? সেই ছোটবেলাতে, বাবা ওই সময় এ আমাকে যোগ ব্যায়াম , প্রাণায়াম অভ্যাস করাতো আর আমি শুধু ফাঁকি দিয়ে ঘুমোতাম। খুব ছোটবেলাতে অবশ্য বাড়ির মধ্যে আমিই সব থেকে দেরি করে ঘুম থেকে উঠতাম, রুগ্ন মেয়ে বলে আদুরেও কম ছিলামনা, অনেক আদরে , সাধ্য সাধনা করে ঘুম থেকে তোলা হতো আমায়। বড় হয়ে সেই আমি কিভাবে যেন ভোর কে খুব ভালোবেসে ফেললাম। সেই বিএসসি এম এসসি থেকে আরো বেশি করে। বাবার থেকে দূরে তখন। খুব মন কেমন করতো আর বাবা যা যা শেখাতে চাইতো আমায় আরো বেশি করে সেই জিনিস গুলো প্রতিদিনের অভ্যাসের মধ্যে এনে ফেলি।
তারপর যখন আরো দূরে বা হয়তো বা আরো বেশি কাছের হয়ে গেলাম বাবার, জানিনা ঠিক, তবে ঠিক তখন থেকেই সূর্য্যও যেন বেশি করে আমার কাছে চলে এলো। মনে হতো আমাকে জেগে যেতে হবে, ওই সূর্যোদয় এর সাক্ষী হতে হবে, সাক্ষী হতে হবে ওই বিদায়ী ক্ষণের। আর তখন থেকেই কিভাবে যেন আমার প্রতিটা দিন, দিনের প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে এক অন্যভাবে ধরা পড়লো। কত আনন্দ লুকিয়ে আছে এই এক একটা মুহূর্তের মধ্যে,কত ভালোলাগা, হয়তো বা অনেক খারাপ লাগাও , কিছু আদর হয়তো কিছু অনাদর তবুও সব সবকিছু খুব সুন্দর। একে অন্যের থেকে আলাদা, অভিনব অনুভব এ জড়ানো।
আজও ঠিক সেভাবেই ঘুম ভাঙ্গে। যান্ত্রিক অ্যালার্ম এর দরকার পড়েনি , এমনি ই ঘুম ভাঙ্গে, চোখ খুলতেই মুখের ওপর উছলে উঠলো একরাশ আলো। ভোর তো তখন ও হয়নি, ওমা , জানালার দিকে তাকাতেই দেখি, একদম আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে শেষ রাতের সুধাকর। সাথে, ঠিক পাশেই আছে শুকতারা। কি অসম্ভব সুন্দর সে মুহূর্ত। চোখ ফেরানো যাচ্ছিলোনা যেন। কি অনুপম তার রূপ। কিছুদিন আগেই পূর্ণিমা ছিল, তাই ভরা যৌবনের সমস্ত মাধুর্য্য নিয়ে চন্দ্রমা এসে দাঁড়িয়েছিল যেন।
কালকে শোবার সময় চাঁদ দেখিনি, ছোট্ট মিষ্টি একজন মানুষ তাকে খুঁজেওছিলো নাকি, শেষে বলছিলো, চাঁদের নাকি কষ্ট হয়েছে, তাই সে আসেনি। শেষ রাতে চাঁদ বোধয় তার সমস্ত কষ্ট কে একটানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শুধু আমাদের মুহূর্তকে সুন্দরতা তে ভোরে দেবে বলে অমন ভুবন ভোলানো হাসিতে চারিদিক ভাসিয়ে দিতে এসেছিলো। ছোট্ট শুকতারা, মুচকি হেসে তার পাশে থেকে তাকে সাহস জোগাচ্ছিলো। শুয়ে শুয়েই তাকিয়ে ছিলাম সেই দিকে, তারপর উঠে পড়ি, সাক্ষী হলাম সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তের। দিবাকরের রশ্মিতে এক হয়ে মিশে গেলো আমার চাঁদের আলো আর সারাদিন বারবার আমার মনে পড়তে লাগলো সেই যুগলবন্দীকে।
আস্তে আস্তে সূর্য্যের তেজ বাড়লো, মধ্যাহ্ন পেরিয়ে পড়ন্ত বিকেল আবার ঘোর লাগালো চারিদিকে। সন্ধের ধ্যানমগ্নতা আমাকে আজ করলো একেবারে নীরব। দূরে ওই মৌন্য আরাবল্লী, সন্ধ্যার রঙে রং মিলিয়ে আরো গাঢ়, গভীর হয়ে মিশে যাচ্ছিলো ওই আকাশে। আজ আবীরের বাহুল্য ছিলোনা পশ্চিমে। আজ ছিল শুধু যেন প্রতীক্ষা। কিসের তা ঠিক জানিনা। হয়তো সুরের , হয়তো বা সঠিক ছন্দের। তবে প্রতীক্ষা ছিল নীরব, শান্ত। সেই নীরব প্রতীক্ষার মধ্যে দিয়ে ধীর পায়ে, সন্ধ্যা নামলো। দূরে ওই বহুদূরে যে ছোট্ট মন্দির টা দেখা যায়, সেখান থেকে খুব অল্প করে ভেসে এলো সন্ধ্যারতির শব্দ। আর এই নিস্তব্ধ নিশিকে স্বাগত জানিয়ে ওই পশ্চিম আকাশেই আপন স্তিমিত মুখ খানি মেলে ধরলো আমার শুকতারা।
No comments:
Post a Comment