Monday, 26 March 2018

রূপকথা

শেষের কবিতার অমিত বা গোড়ার গৌড়মোহন, গুরুগম্ভীর পন্ডিতমশাই ই হোন বা আমাদের মতো ১০টা পাঁচটার চাকায় নিষ্পেষিত কোনো মানুষ, কোথায় যেন সবার মাঝে লুকিয়ে আছে সেই এক ছোট্ট মিষ্টি বীরপুরুষ। একটা অনুভূতি প্রবণ, কল্পনা প্রবণ, স্বপ্নের জগতে বেঁচে থাকা মন যেখানে যা কিছু ঘটে সবকিছুকেই মনে হয়,  আমি পারি সব পারি। বড় বড় ইমারত, ইঁট কাঠ পাথর নয়, কিছু নরম নরম মিষ্টি আবেগ, একটু আদর আর ছোট্ট ছোট্ট মিষ্টি অভিমান ফল্গু ধারার মতো বয়ে চলে আমাদের সবার ভেতরে। রোজকারের বেঁচে থাকার যুদ্ধ তাতে প্রলেপ দিয়ে দেয় কাঠিন্যের। সময়ের আগেই হয়তো কখনো অজস্র দায়িত্বের ঘেরাটোপে আমাদের ভেতরের সেই প্রাণবন্ত বীরপুরুষ অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে একেবারে চুপ করে, মনের এক কোণে নিজেকে বন্দী করে রাখে। সময়ের সাথে সাথে , তার বন্দীত্বের মেয়াদ দীর্ঘ্য থেকে দীর্ঘ্যতর হয়, আর তারপর কখন সে ভুলেই যায় সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে।  তার নিজের সেখান থেকে বেরোনোর ইচ্ছেটাই একেবারে চলে যায়।

আজ জানো, তোমাদের এক বীরপুরুষের গল্প বলবো, শুনবে? সেই যে মনে আছে? যখন যুদ্ধ চলছিল "ঢাল তলোয়ার ঝনঝনিয়ে বাজে"....সেই রকম যুদ্ধ। .প্রতিনয়ত। .যুদ্ধক্ষেত্র হয়তো আলাদা হয়, কিন্তু যুদ্ধের বিরাম হয়না, যুদ্ধ শেষে কখনো তাতে আমাদের সবার ভেতরের সেই বীর,..কখনো তারা জয়লাভ করে, কখনো বা ক্লান্ত হয়ে পরে। সেইরকম এক যুদ্ধ ক্লান্ত বীরপুরুষ একদিন এসে বসেছিল এক নদীর পাশে, নদী চলছিল তার আপন নিয়মে, সে নিয়ম কখনো ভাঙ্গেনা। ভাঙলেই যে বড় ভয় , যদি সবকিছু ভেসে যায়, তাই সে সবসময় নিজেকে ওই নিয়মের গন্ডীর ভেতরে রাখে, ওই সীমারেখা সে আপনি টেনেছে, ওর ভেতরে থেকেই সে ছুটে চলেছে দূর থেকে দূরে, বর্ষায় উচ্ছসিত হয়েছে, শীত এ শুষ্ক, গরমে বিদগ্ধ। কিন্তু তার ওই গণ্ডীর ভেতরে।

একদিন দূর থেকে যখন সে দেখলো, ওই মিষ্টি বীরপুরুষ ক্লান্ত হয়ে গেছে বড়। হু হু করে উঠেছিল বুকের ভেতরটা। মনে হয়েছিল তার সমস্ত জল টুকু দিয়ে ভিজিয়ে দি ওই ক্লান্তিটুকু, মুছিয়ে দি সমস্ত পরাজয়। আর তারপর অনেক আদোরে অনেক যত্নে সেই বীরপুরুষ স্নিগ্ধ ছায়াতে তার দুচোখে স্বপ্ন এঁকে নিক তারপর আবার দিগ্বিজয়ে বের হোক। নদীর সে কথা শুনতে পেয়েছিলো বুঝি মানুষটা।ধীর পায়ে এগিয়ে এলো সে। তারপর পারে বসে কত কথা হলো দুজনার। নদী বললো তার চলার কথা আর বীরপুরুষ বললো সে এক রাজকন্যা কে আনতে যাচ্ছে, তার জন্যেই এ যুদ্ধ। তারপর ধীরে ধীরে সূর্য্য পাটে বসলো, যে ভোরের সূচনা একসাথে হয়েছিল, সন্ধ্যাকাশের ওই শুকতারা জানান দিয়ে গেল দিবাবসানের কথা। সেদিন রাতে ছিল একটা ফালি চাঁদ, আর চৈত্র মাসের আকাশ ভরে গেছিলো তারায় তারায়। যুদ্ধে ক্লান্ত বীরপুরুষ ঘুমিয়ে পড়েছিল, নদী তার ছলাক ছলাক শব্দে চেষ্টা করছিলো তার সবটুকু ক্লান্তি দূর করে এই পৃথিবীর সমস্ত সুন্দর কে ওই দুচোখে ঘুমের ছলে এনে দিতে। দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসছিলো বেহাগ এর সুর।

তারপর হটাৎ ঝড় উঠলো , বৃষ্টি আর বজ্রপাতের আওয়াজে ঘুম গেলো ভেঙ্গে, চোখে তখনো স্বপ্নের রেশ লেগেছিলো তার, বাঁশির শব্দ তখনো যাচ্ছিলো শোনা। ভালো করে কিছু বোঝার আগেই তৈরি হয়ে নিতে হলো যুদ্ধের জন্যে। নদী তাকে সঙ্গ দিলো। মনে করিয়ে দিলো, রাজকন্যা কে আনতে যেতে হবে যে। নিজে হাতে যুদ্ধবেশে সাজিয়ে রণভূমিতে পাঠিয়ে দিলো। তলোয়ার যেমন রইলো সে হাতে, ঢাল ও তুলে দিলো নদী নিজে অপর হাতে। নদী জানতো, এ যুদ্ধে সে জয়ী হবেই। আর মনে মনে রাজকন্যা কে বললো, দেখো কন্যে, আমার বীরপুরুষ কে সামলে রেখো। বড় অভিমানী মন তার, যত্ন করে, আদরে মুড়ে দিও তাকে। যুদ্ধশেষে সে এখনো খোঁজে একটা স্নেহময়ী হাত, একটা ভালোবাসার কোল। তাই যুদ্ধশেষে যখন তোমাকে জয় করে আনবে সে, তখন ওই কোল পেতে দিয়ো, যে অপার ভালোবাসায় তুমি তার কাছে ফিরে এলে, সে ভালোবাসা দিও তাকে উজাড় করে।

কোনো এক পড়ন্ত বিকেলের আবীর রঙে রাঙিয়ে রাঙা ঘোড়াকে সঙ্গে নিয়ে সেই ছোট্ট বীরপুরুষ তার  নদীর কাছে এসে বসেছিল। দুজনের কেউ ই বুঝতে পারেনি যে কখন এক মধুর মিতালি হয়ে গেছিলো। সে মিতালীতে ছিল একে অপরকে নিজ নিজ গন্তব্যে এগিয়ে চলার নির্দেশ। সে "বন্ধনহীন গ্রন্থি" তে ছিল স্বপ্ন দেখার আহ্বান। সেই সখ্যতার মধ্যে কখনো ছিল ছোট্ট ছেলের দামালপনা, কখনো বা মা এর মতো শাসন, আবার কখনো বা খেলার সঙ্গী হারানোয় দুই শিশুর মতো একে অপরের কাছে অশ্রুসজল অবোধ অনুযোগ।

আজ আবার এক পড়ন্ত বিকেল। নদীর পারে সূর্য্য আবার পাটে বসেছেন। ধ্যানমগ্ন শান্তিতে নদী স্থির করেছে নিজেকে। ছোট্ট বীরপুরুষ এখন অনেক বড়, সে তার ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেছে অনেক দূরে। নদী জানে, যে যুদ্ধ এখন চলছে, সে যুদ্ধ শেষ হবেই। যুদ্ধজয়ী পরিণত বীর খুঁজে পাবে তার সুখী গৃহকোণ। রাজকন্যের হাত ধরে সেই ঘরের কোণে সন্ধ্যারতির মধ্যে দিয়ে নেমে আসবে শান্তি। আর নদী, নদী সেই সুখী গৃহকোণের শান্তিবারিতে নিজেকে করবে স্নিগ্ধ, করবে সমৃদ্ধ। আর মনে মনে বলবে, দেখো কন্যে, আমার বীরপুরুষ কিন্তু সত্যি ই বড় বীর। অসীম তার ধৈর্য্য, সহ্য। যত যুদ্ধই চলুক, দেখো সে যেন আহত না হয়। আর বীরপুরুষ, তার জন্যে শুধু একটাই কথা, যেকথা বলতে চেয়েছিলো, কিন্তু তখন আর বলা হয়নি, সেটা হলো, তোমার ওই দামাল মনটাকে শিকলে বেঁধোনা, খুব নরম তো, জোর করে বাঁধলে লাগবে, তাকে যত্নে রেখো। আদরে। আর ভালো থেকো।। খুব।







No comments:

ইচ্ছেনদী

আমার ল্যাব টা মাউন্ট sinai এর ১০ তলায়, আর আমার ওয়ার্কিং ডেস্কটা একদম জানালার ধারে , বিশাল জানালা। মনে হয় মেঘ গুলো এখুনি ঢুকে পড়বে এর মধ্যে। ...