Sunday, 13 October 2019

আমার দুর্গা আজও আমার ঘর আলো করে
মাটির দুর্গা নাহয় গেলেন মণ্ডপ ছেড়ে 
সে যাওয়া যে নয়গো যাওয়া ওগো সে যে নিজের ঘরে গমন 
মা রে তুই যে আমার নিজের নিজের আমার বড় আপন 
দূর্গা হয়ে কোরো মা আমার দুর্গের (ঘর) রক্ষণ 
লক্ষী রূপে থাক মা আমার এই ঘরে নিরুক্ষন। 

তুই আমার দূর্গা মারে, রাতের কোজাগরী 
তুই আমার বীণাপাণি , আদোরে আদুরী। 

Wednesday, 9 October 2019

বিজয়া

নিশি পোহাইলো , উমা গেল চলি কৈলাশ অভিমুখ
বিরহী যক্ষ পাইলেন তাঁরে সংসার সম্মুখ
পতি সোহাগে সতী সোহাগিনী
যুগ যুগ ধরে তাঁরে খুঁজি
যেভাবেই পাই সেভাবেই চাই যতটুকু যা বুঝি
কৃষ্ণপ্রেম যবে মিশে যায় কালিদাস রচনায়
বুঝি সেইক্ষণে কি অমোঘ কারণে ভেদাভেদ মুছে যায়
বৈষ্ণব হোক  কিংবা শৈব, বিধিমতে বা বিরোধে
মূল কথা শুধু হলো প্রেম, লোক মতে, অমতে।
দুই দেহ, মন, শুধু অনুক্ষণ, লোক চোখ কিবা আসে
মায়াময় এ ভুবন অটুট বন্ধন  বেসো ভালো শুধু তার ই আশে।


Saturday, 14 September 2019

ভানুসিংহের পদাবলী


কবিগুরু মাত্র ১৬ বছর বয়সে আস্বাদন করেছিলেন ব্রজবুলি  ভাষার বৈষ্ণব পদাবলীর। আর তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রচিত হয় ভানুসিংহের পদাবলীর। যার প্রতিটা ছত্রে ছত্রে লুকিয়ে আছে অসামান্য প্রেম পূজা। ভানুসিংহের পদাবলীতে আছে মোট  ২২ টি গান
  • "Boshonto aoulo re" ("বসন্ত আওল রে")
  • "Shunoho shunoho balika" ("শুনহ শুনহ বালিকা")
  • "Hridoyoko shadh mishaolo hridoye" ("হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে")
  • "Shyam re, Nipoto kothino mon tour" ("শ্যাম রে, নিপট কঠিন মন তোর")
  • "Sajani sajani radhika lo" ("সজনি সজনি রাধিকা লো")
  • "Bodhua, hiya 'por ao re" ("বঁধুয়া, হিয়া 'পর আও রে")
  • "Shuna shokhi, bajoto bashi" ("শুন সখি, বাজত বাঁশি")
  • "Gohono kushumokunjo-majhe" ("গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে")
  • "Shotimiro rojoni, shochokito shojoni" ("সতিমির রজনী, সচকিত সজনী")
  • "Bojao re mouhan bashi" ("বজাও রে মোহন বাঁশি")
  • "Aju shokhi, muhu muhu" ("আজু সখি, মুহু মুহু")
  • "Shyam, mukhe tobo modhur odhorome" ("শ্যাম, মুখে তব মধুর অধরমে")
  • "Shojoni ga" ("সজনি গো")
  • "Badoroborokhono nirodogorojono" ("বাদরবরখন নীরদগরজন")
  • "Modhobo, na koho adorobani" ("মাধব, না কহ আদরবাণী")
  • "Shokhi lo, shokhi lo, nikoruno Madhob", ("সখি লো, সখি লো, নিকরুণ মাধব")
  • "Bar bar shokhi, baron koronu" ("বার বার সখি, বারণ করনু")
  • "Hom jobo na robo shojoni" ("হম যব না রব সজনী")
  • "Morono re" ("মরণ রে")
  • "Ko tuhu boulabi mouye" ("কো তুঁহু বোলবি মোয়")
  • "Shokhi re, pirit bujhobe ke" ("সখিরে, পীরিত বুঝবে কে")
  • "Hom shokhi darido nari" ("হম সখি দারিদ নারী")

রবীন্দ্রের রাবেন্দ্রিক ভাব অভিন্ন রেখে এই ভানুসিংহএর পদাবলীকে যদি আমরা আমাদের ভাষায় আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে আনতে চাই তাহলে খুঁজে পাই এক প্রেমাতুর প্রেমিক হৃদয়ের যে তাঁর প্রিয় মিলনের আশায় কোনো এক মিলন কুঞ্জ সাজিয়ে অপেক্ষা করছে আর অবিরত তার আবাহন করে চলছে। বলছে , সখি এস, ভয় না পেয়ে , লোকলজ্জা ত্যাগ করে আমার কাছে এস। তোমার প্রেমপূর্ণ হৃদয় কে নীল অন্তর্বাসে আচ্ছাদিত করে, তোমার ওই হরিণচোখে বিমল হাসি এনে আমার এই কুঞ্জবনে এস। ফুলের সৌরভে ভরা পাখির সুরে মদির এই জ্যোৎস্না রাত যে বৃথাই চাঁদের সৌরভে ভেসে যায়।

গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে মৃদুল মধুর বংশি বাজে,
বিসরি ত্রাস-লোকলাজে সজনি, আও আও লো।
পিনহ চারু নীল বাস, হৃদয়ে প্রণয়কুসুমরাশ,
হরিণনেত্রে বিমল হাস, কুঞ্জবনমে আও লো॥
ঢালে কুসুম সুরভভার, ঢালে বিহগ সুরবসার,
ঢালে ইন্দু অমৃতধার বিমল রজত ভাতি রে।
মন্দ মন্দ ভৃঙ্গ গুঞ্জে, অযুত কুসুম কুঞ্জে কুঞ্জে,
ফুটল সজনি, পুঞ্জে পুঞ্জে বকুল যূথি জাতি রে॥
দেখ সখি, শ্যামরায় নয়নে প্রেম উথল যায়,
মধুর বদন অমৃতসদন চন্দ্রমায় নিন্দিছে।
আও আও সজনিবৃন্দ, হেরব সখি শ্রীগোবিন্দ
শ্যামকো পদারবিন্দ ভানুসিংহ বন্দিছে॥


এরপরে মিলন কাতর প্রিয় সম্মুখে লজ্জানত প্রিয়া কে দেখে সে আকুতি করে তার মুখপানে চেয়ে দেখার জন্যে। তার আগমনে যখন প্রিয়া বক্ষের কুসুমহার খসে পড়বে, খসে পড়বে সেই নীল আচ্ছাদন তখন হয়তো সেই মিলন আরো মধুময় হয়ে উঠবে সহচরী বৃন্দের মিলন গীতের মধ্যে, এ মিলন ওই নৃত্য গীতের মতোই আনন্দময় আবার গৃহবধূর স্বামী মঙ্গল কামনায় রাঙা সিঁথির মতোই পবিত্র। ওই মিলন কুঞ্জ আকাশ তখন মদির হয়ে উঠবে, মৌমাছি গুঞ্জরণে হবে চঞ্চল, আমার প্রিয়ার সোনার বর্ণ মঙ্গল দীপের মতো সেই আকাশ আলোকিত করে রাখবে তার নিজ গন্ধে সুরভিত হয়ে থাকবে ওই কুঞ্জ গৃহ।


সজনি সজনি রাধিকা লোদেখ অবহুঁ চাহিয়া,মৃদুলগম শ্যাম আওয়েমৃদুল গান গাহিয়া।পিনহ ঝটিত কুসুমহার,পিনহ নীল আঙিয়া।সুন্দরী সিন্দূর দেকেসীঁথি করহ রাঙিয়া।সহচরি সব নাচ নাচমিলন-গীতি গাও রে,চঞ্চল মঞ্জীর-রাবকুঞ্জগগন ছাও রে।সজনি অব উজার মঁদিরকনকদীপ জ্বালিয়া,সুরভি করহ কুঞ্জভবনগন্ধসলিল ঢালিয়া।মল্লিকা চমেলী বেলিকুসুম তুলহ বালিকা,গাঁথ যূথি, গাঁথ জাতি,গাঁথ বকুল-মালিকা।তৃষিতনয়ন ভানুসিংহকুঞ্জপথম চাহিয়ামৃদুল গমন শ্যাম আওয়ে,মৃদুল গান গাহিয়া।



যুথী বেলি মল্লিকা চামেলীর কুসুম্ভারে ভরা সেই পথ এর দিকে মিলন আশায় হয়তো যুগ যুগ ধরে কত ভানুসিংহ তৃষিত নেত্রে তাকিয়ে আছে। এমন জ্যোৎস্না ভরা রাতে এ লেখা কে ভীষণ ভাবে জীবিত করার জন্যে। 

Saturday, 17 August 2019

রক্তনীল 'অপরাজিতা

আজ নাহয় বৃষ্টি নামুক
ভাঙ্গুক নীরবতা -
আজ নাহয় পাগল হাওয়ায় ,
হোক মাতাল কেবল রক্তনীল 'অপরাজিতা'.
আজ নাহয় বাঁধন খুলুক ,
ভাসুক তরী -
দূর দিগন্তে দূরে
আজ নাহয় আবার তুমি ধরলে কলম
বাঁধলে আমায় নব্য সুরে।।

Thursday, 15 August 2019

রাখী পূর্ণিমা

ছোট থেকেই আমি  ,ইশ আমার বেশ একটা ভাই থাকতো। বেশ কেমন দিদি দিদি বলে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতো। রাখী বা ভাইফোঁটার দিন গুলোতে আমার পিসতুতো মাসতুতো দাদা দিদির বন্ধুরা এদের সবাইকে নিয়ে অবশ্য  খুব ভালোই কাটতো। স্নান করে, একটু বড় হতেই আবার পাকামি করে কেঁদে কেটে শাড়ি পড়তাম, প্রদীপ জ্বালিয়ে শাঁখ বাজিয়ে ঘটা করে হতো ভাইফোঁটা বা রাখিপূর্ণিমা পালন। বাইরে থাকাকালীন ও ভাই দাদা ঠিক ই কারোর না কারোর হাতে রাখি পড়িয়ে বা ফোঁটা দিয়ে তবে জল খাই, আর পোস্ট এ এখনো রাখি গিয়ে পৌঁছয় কাঙ্খিত জায়গায়, তবু যেন কি যেন একটা থাকেনা, কি যেন একটা নেই। পাঁশকুড়াতে থাকাকালীন একদল বাচ্ছা ছেলেমেয়ে আসতো , ওদের হাতে রাখি পড়াতাম আর ওরা খুশিমনে যেত। 
আজকে একটা অন্যরকমের খুশির সাক্ষী হলাম। সকালে কাজের দিদি আসবেনা বলে গেছিলো, কালকে যখন পা ঘষছিলো, মনে হলো কিছু বোধয় দরকার। বললাম কিগো দিদি, বললো না কিছুনা, বুঝলাম, বলতে ইতস্তত করছে। দুজনে আমরা থাকি, তার মধ্যে এই দিদি কখন যেন নিজেদের ফ্যামিলি মেম্বার ই হয়ে গেছে। হাতে কিছু টাকা দিলাম, বললাম ছেলে মেয়েকে মিষ্টি কিনে দিও। খুব খুশি হয়ে গেলো। ওর খুশি দেখে হটাৎ যেন কেমন ঘোর লেগে গেল, মনে হলো এই টুকুতেই এত খুশি, কিছুই যে করতে পারিনা, তাতেই। মনে পরে গেল, আমাদের ছোটবেলার আরতি পিসির কথা। যে স্কুল এ যাবার সময় আমাকে ভাত খাইয়ে দিতো জোর করে। আমি কিছুতেই খেতে চাইতামনা, তারপরে আবার তাকেই খাইয়ে দিতাম আমার থালা থেকে, আমার বাবাকে সেই পিসি ফোঁটা দিতো। নিজের যতটুকু সামর্থ তাই দিয়ে বাবাকে লুঙ্গি গেঞ্জিও দিতো মনে আছো। হটাৎ আমার কি মনে হলো, আরো কিছু টাকা আমাদের এই দিদির হাতে দিয়ে বললাম কালকে রাখী তো? এই নাও তোমার ভাইয়া তোমার জন্যে রেখে গেছে। ও অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চাইলো, আরে ভাইয়া তো বলো, ভাই হয়না তোমার? রাখীতে তোমাকে সে কিছু না দেয় কেমন করে ? ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে থাকলো। হাত দুটো আধা নমস্কারের ভঙ্গিতে তুলে কোনোরকমে বললো "ইতনা ইজ্জত মুঝে আজতক কিসিনে নেহি দিয়া, মেরি আপনি ভাই ভি নেহি ", ইজ্জত, দিতে পেরেছি তবে? আমার চোখ ও শুষ্ক থাকলোনা। 

Thursday, 8 August 2019

So many times when I prayed you give me light
On a sudden I felt that that is hidden insight
On a sudden when I see this floating sky
Green grass blue sky
Gentle wind slows down
Let me see, let me touch
Let me flow and blow on
Time passes left some marks
We decide which to carry or let go
On our works

নীল আকাশ, সাদা সাদা  মেঘ
সকাল থেকেই দিনটা ছিল উড়ো উড়ো
পুজোর আগের আবেশ, পুজো আসার আমেজ
ছোটবেলার স্মৃতি হটাৎ করে এসে এলোমেলো করে দেওয়া কাজের আয়েশ
ডেডলাইন গুলো জমা হতে থাকলো
ডেস্ক এ কাজ হতে থাকলো পেন্ডিং
কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সাথেও সেই আবেশের হলোনা হের্ ফের
দুঃখ বেশিক্ষন রাখতে আমি পারিনা,
বেশিক্ষন দুঃখ নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতেও ভালো লাগেনা
তবু কোনো কোনোদিন হটাৎ হটাৎ বিষণ্ণতায় মুড়ে যায় একেবারে
আবার এই আজকের মতন,
হটাৎ কোনো কারণ ছাড়াই আনন্দের মেজাজ নকশীকাঁথা পেতে বসে থাকে
গল্প বোনার জন্যে
ইঁট কাঠ পাথরের শহর তখন হয়ে যায় রাপুঞ্জেলের রাজত্ব
সেখানে আরব্য রজনীর জিনি র আসতে থাকেনা কোনো বারণ
আর হটাৎ করে এই ভরা দুপুরে অজস্র deadlines আর analysis সরিয়ে
জানালা দিয়ে উঁকি মেরে যায় একফালি আকাশ
এই মেয়ে আসবি নাকি?
ডানা দেব, উড়বি ?
সময়ের পালতোলা নৌকো কখন ভাসিয়ে নিয়ে যায় দুঃখ, নাপাওয়া, ম্যান কষাকষি, ঝগড়া
ওই সাদা সাদা মেঘের হাত ধরে শিরশিরানি বাতাসের সুরে সুরে
শুধু পরে থাকে অজস্র ভালো বাসাবাসি।

ভালোলাগার অনুরণনে কাঁপা কাঁপা সুরে
আমোদিত আকাশ মদির হয়ে তখন চোখ বন্ধ করে ফেলে
ভেতরের আনন্দ বাইরে যাতে উদ্দামতা না নিয়ে আসে
তাই সংযত করতে থাকে নিজেকে
হাতের মুঠোয় বন্ধ আর এক হাত নিষ্পেষিত হয়ে যাওয়ার রোমাঞ্চকতায়
উচ্ছকিত হয়ে লাল হয়ে পরে
সেই স্পর্শিত উষ্ণ উপলব্ধি।
শৃঙ্খলিত চিকণ সবুজ দূর্বা মুখ তুলে তাকায়
আর বন্ধ চোখের ভেতরে নিজের মধ্যের আলোয়
সমস্ত অন্ধকার দূর হয়ে গিয়ে যেন পুনরায় সকাল হয়।


Monday, 5 August 2019

এইরকম ই কোনো এক সময় ছিল সেটা। বৃষ্টি বৃষ্টি, ভেজা ভেজা দিন। season চেঞ্জ এ জ্বর হলো। অল্প অল্প ঘুষঘুষে , ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদতাম। ক্লাস সেভেন কি এইট তখন। মুখে কিছু ভালো লাগছেনা। বাবা সকালে দেখে গেছে জ্বর। তখন ফোন ছিলোনা বাড়িতে। খবর নেবার উপায় নেই, জ্বর যে তেমন তা নয়, তবু বাবার মন বসছিলোনা স্কুল এ তে। ক্লাস শেষ করেই তারতারি বাড়ি ফিরলো, হাতে কাঁচা পেয়ারা আর সেবারের প্রথম শারদীয়া আনন্দমেলা। 

Sunday, 28 July 2019

নাবলা যত গল্প ছিল আমার মনে
তোমার সনে
সব পাপড়ি হয়ে ছড়িয়ে আছে
হয়তো কৃষ্ণচূড়ার বনে
নীল আকাশ মেঘের ভেলা
উতল হাওয়ায় ধায়
আমার বলার ছিল
শুধু তোমার শোনার ছিলোনা আর দায়
এবারে আমি চুপ করলাম
জানি নেই নেই আর কিছু প্রয়োজন
তুমি তোমায় পেয়েছো ফিরে
রাখা রইলো সব আয়োজন
চাঁপার আলো , জুঁই এর সুবাস
থাকলো অপেক্ষায়
তোমার নেই আর কোনো দায়
তোমার সকল নিয়েই তোমায় পাওয়া
দুঃখ এবং সুখে
তোমার কথা কঠিন করে
বড় কঠিন করে বাজে এ বুকে
তুমি থেকো তোমার মতো
সুরের পথ টি চিনে
শুধু নাবলা কত যেন গল্প ছিল আমার মনে
তোমার সনে
রইলো পরে পাপড়ি হয়ে
কুড়িয়ে নিও কখনো
যদি তোমার কখনো পরে মনে
একটু করো যত্ন। 


Friday, 19 July 2019

বদলে যাওয়া পৃথিবীতে থমকে যাওয়া আমি
আমার বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ বেলায়
কেন বিষন্ন বনভূমি
মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি, ভেজা হাওয়ায়
বাণিহারা সবকিছু
থাকনা নাহয়
উতল হওয়া মানা
তবু মনে আমার বেজেই চলে
"ও যে মানে না মানা ".......

শব্দের ভারে বাতাস হয়েছে ভারী
তাই আজ নাহয় লেখা হোক চুপকথা।
নাহয় কিছু স্তব্ধ মুহূর্তের, মৌনতায় ধরা দিক গভীরতা।
ধ্যানমগ্ন চারিদিক, মুখরিত নীরবতা।
আজ সব ছেড়ে দিও
শুধু প্রাণ পাক সঁপে দেওয়া সখ্যতা।।

ধ্যানমগ্ন পৃথিবীতে মুখর নীরবতা
মৌন হয়েই প্রাণ পাক শুধু সঁপে দেওয়া সখ্যতা 

Friday, 12 July 2019

বেহিসেবি সময় কখনো কখনো হিসেবি হয়ে ওঠে খুব। বিকেলবেলার পড়ন্ত রোদ টা যখন কাঁচের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে যায়, আর মন না বসা মন কিছুতেই আর work desk এ বসে না থেকে আকণ্ঠ ডুবদিতে চায় পাশের সবুজ টাতে। ঠিক তখন আনমনে হাত হটাৎ না বলা মোবাইল তুলে নেয়। একসময় কথা ফুরোতোইনা। হোয়াটস্যাপ, এমনি msg , ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন কল। তারপরেও মনে হতো কিছুই তো বলা হলোনা। যেন মনে হতো জন্ম জন্মান্তর ধরে জমে আছে কত না বলা কথা। তারপর হটাৎ করে বেহিসেবি সময় চোখে চশমা লাগিয়ে হিসেবের খাতা খুলে বসে। পাওয়া না পাওয়ার নিক্তি তে বিচার হয় সম্পর্ক। যত্নে লাগানো ফুলগাছ গুলোর মাঝখান গুলোতে হটাৎ একরাশ শূন্যস্থান। একসময় সেই শূন্যস্থান ভরাতে যত্ন নিতো ফুলের পাপড়ি, প্রজাপতির পাখারা। আজ সেখানে হটাৎ জন্মে যায় আগাছা। একেবারে ভর্তি হয়ে যায়। অঘ্রানের শিশির টুপটুপিয়ে পড়তে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়, ও এখানে তাহলে আগাছার ই থাকার কথা ছিল। 
বাতাস ও বইতে গিয়েও ইতস্তত করে। যাবো কি যাবোনা। হটাৎ সবকিছুর মধ্যে থেকে সহজাত spontaneity নিয়েছে বিদায়।  বেহিসেবি মন ভয় পায়। আপন নিয়মে চলার গতি থমকে যায়। হিসেবের পাতায় মাপা হতে থাকে দিন রাত্রির কমা বাড়া। আদুরে রাত্রি হটাৎ মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। বাধাহীন পথ ও আর অনন্ত হয়না, একটু এদিক থেকে ওদিকে গেলেই নেভিগেটর লেডি ও যান্ত্রিক গলায় বলে ওঠে, u have to take the right turn or ১০ mins to reach ur destination . বেহিসেবি পথ হিসেবি হয়েছে। 

Wednesday, 10 July 2019

আদর মাখা ছোটবেলাতে বিকেলবেলা গুলো আসতো ভীষণ মিষ্টি হয়ে। মা চুল টানটান করে দিয়ে দুপাশে দুটো ঝুঁটি বেঁধে দিতো। বাবা একদম একটা করে চুল বাঁধা পছন্দ করতোনা। কোঁকড়ানো চুলে দুটো করে চুল বাঁধলে ঠিক যেন ফুলের মতন থোকা হয়ে থাকে। চুল বাঁধা হয়ে গেলে মা কাজল পড়াতে চাইতো আর বাবা বলতো না কাজলে চোখ নষ্ট হয়ে যাবে। ফলত অনেক বড় বয়স পর্যন্তই আমি মায়ের হাতে ঘরে পাতা কাজল পড়েছি। আর য্খন actually মেয়েরা কাজল এমনকি eyeliner tiner ও কি জিনিস জেনে গেছে , তখন থেকে আর কাজল পড়াই হয়নি আমার। ফলে অভ্যেসটাই চলে গেছিলো কাজল পড়ার। 
চুল বেঁধে কখনো সাদা, কখনো নীল কখনো সেই প্রিয় লাল রঙের ফুলফুল ফ্রক পরে বাবার হাত ধরে আমি বেড়াতে বেরোতাম। দিদি বলতো ওই যে বেড়াতে চললেন মহারানী। আমি লাফিয়ে লাফিয়ে প্রথমেই যেতাম পাশের মাঠে, যেখানে বাদামি রঙের গরুটা বাঁধা থাকতো, সেখানে। তাকে খাওয়াতাম কচি বাঁশপাতা। আর ওর গলায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কি যে গল্প করতাম কিজানি। তারপরে আমাদের গন্তব্যস্থল হতো সামনের ছোট্ট কালভার্ট টা। সেখানে একদিক থেকে পাতা ভাসাতাম আর অন্য দিকে সেই পাতাটা ভেসে বেরোচ্ছে কিনা দৌড়ে দেখতে যেতাম। তারপরে সামনের মাঠ এ তে একটু বসে ফিরে আসা। এই ছিল আমার আর বাবার প্রাত্যহিক রুটিন। ক্লাস চেঞ্জ হয়, একটা একটা করে ধাপ বদলায়, কালভার্ট এর পাতা ভাসানোর সাথে সাথে শিখে ফেলি স্রোতের অঙ্ক , জোয়ার ভাঁটার হিসেব , গতি এমন কত কি। তবে শুধুই অঙ্ক , বিজ্ঞান নয়, ওই পাতা খাওয়ানো আর স্রোতের যাওয়া আসা দেখতে দেখতে কখন বাবা তার ছোট্ট মেয়ের মধ্যে দিয়ে দিয়েছিলো আরো অনেককিছু। কোনো কোনোদিন সেই বেড়াতে যাবার ব্যতিক্রম হলেই মনখারাপ হতো। তারপর আরো বড় হলাম, কখন বেড়াতে যাওয়া রূপান্তরিত হলো দাবার প্রাকটিস আর সন্ধের ছবি আঁকার মধ্যে। তারপর আরো...আরো....এখন আর সেই বিকেল আসেনা, ল্যাব থেকে যাতে বিকেলে বেরোতে পারি, তারজন্যে সবাই খুব রাগায় ও আমায়। কি করে বোঝাই ওদের বাড়িতে যে আমার এক আকাশ বিকেল আছে, সন্ধে আছে। আছে মরসুমি পাখির ঘরে ফেরা। 

তবু সেই বিকেল আসেনা। এখানের গরু গুলো ও যেন আর আদর করে ঘাড় নেরে দাঁড়িয়ে থাকেনা। চারিদিকের পৃথিবীর মতন এরাও বড় হয়ে গাছে যেন, ব্যস্ত হয়ে গেছে, মুডি হয়ে গেছে। কচি পাতাও আর হাতের নাগালে থাকেনা, ডাল নুয়ে দেবার ও কেউ নেই যে আর ওরাও বোধয় ওই যে সবার মতো মুডি হয়ে গেছে, ইচ্ছেমতন আসবে বা আসবেনা। তাই আর ছুঁতে যাইনা ওদের কাছে, দূর থেকেই দেখি, ভালো আছে। সিম্প্লিসিটির হিসেব গেছে হারিয়ে। তবু সেই সব কিছুর মধ্যে আমার বাবার সেই জোয়ার ভাঁটার গল্প সাথে নিয়ে আজ ও সন্ধ্যে বেলার আমি অবাক হৈ। কখনো মনখারাপ লুকিয়ে কখনো মনখারাপ  ভুলে হেসে উঠি। বুকের মাঝের তোলপাড় গলার কাছে কি যেন একটা আটকে রেখে যখন সেই বিকেলের কালভার্ট খুঁজে চলে মনে মনে, বাইরে অচঞ্চল হাসিতে তখন হয়তো কেউ বলে ওঠে তুই তো খুব খুশি। আর আমার ভেতরের আমিটা চোখ বন্ধ করে দেখতে পায় , কখনো স্রোতের টানে, কখনো স্রোতের প্রতিকূলতায় পাতাটার এগিয়ে চলা, নিজ গন্তব্যে। পাঁকে আটকে গেলে হবেনা। চরৈবেতি চরৈবেতি। এগিয়ে চলাই জীবন। স্থির অচঞ্চল ভাবে এগিয়ে চলা। 

Thursday, 4 July 2019

সপ্তপদী

রেজিস্ট্রি অফিসে চার হাত এক করে দিয়ে যখন রেজিস্ট্রি অফিসার অঙ্গীকার করতে বলে একসাথে থাকার, তখন তাঁকেই যেন মনে হয় ভগবান। কিংবা অগ্নি সাক্ষী করে একে অপরকে সঙ্গে করে চলার সেই অঙ্গীকার : সপ্তপদী। দুই মন তখন পরিপূর্ণ ভাবে চায় একে অপরের কাছে সমর্পন। সেই অঙ্গীকার সেই  শপথ , সে ভগবান যীশুর সামনেই নেওয়া হোক বা আল্লা কে স্মরণ করে, মন্দিরেই হোক বা বৌদ্ধ প্যাগোডাতে সব ক্ষেত্রেই তার মাহাত্ম এক ই। শপথ নেবার মাহাত্ম, তাকে মেনে সারাজীবন চলার যে অঙ্গীকার, কত স্বপ্ন কে সত্যি করার যে গভীর অভীপ্সা, এ সব ই ভীষণ ভাবে সত্যি। সেই সময় খুব কম মানুষ ই ভাবে সে নিজে কতটা সুখী হবে, বরং ভাবে পাশের মানুষটাকে সে যেন সুখী করতে পারে। 

 চার্চের ফাদার ই হোন বা সামনে বসে থাকা পুরোহিত, মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দুই তরুণ মন কখনো সেই শব্দ সমষ্টির মধ্যে থেকে বুঝে নিতে চেষ্টা করে অন্তর্নিহিত অর্থ আবার কখনো বা সেই শব্দ শুধুই শব্দ হয়ে কানের কাছে গুঞ্জন সৃষ্টি করে আর নিজ নিজ মনের ভিতরে এতদিনের জমে থাকা কত শত স্বপ্নকে আরো একবার নাড়িয়ে চারিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে থাকে । ছেলেটির হয়তো বা মনে পরে বাড়ির সামনে ঘন ঘন সাইকেল করে যাওয়া আসার কথা, আচ্ছা যে মুখটা একবার একটুখানি দেখার জন্যে একদিন কত অপেক্ষা করেছে আজ থেকে সেই মুখ সর্বক্ষণ সবসময় একরাশ হাসি আর অনেক খুশি নিয়ে শুধু তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে? এই চিন্তায় পুলকিত হয়ে আড়চোখে হয়তো বা পাশের জনকে একটু দেখে নিতে ইচ্ছা করে। সেই তাকানোও গোপন থাকেনা, লুকোচুরি এই চাওয়া পাশের মানুষটির মধ্যেও সঞ্চারিত হয়ে তাকেও করে তোলে শিহরিত। এইভাবে বুঝে বা না বুঝে সম্পন্ন হয় এই সপ্তপদীর অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানের রেশ মনের মধ্যে রেখে শুরু হয় সংসার সাগরে তরী বাওয়া। সহজ তো নয়, সারাজীবনের জন্যে করা একদিনের আকুল শপথ, সারাজীবন স্বাচ্ছন্দে পালন করা। 
ফলে কখনো কখনো ঝড় ওঠে, সংসার তরী টলোমলো হয় ও বা। সেই যে অগ্নিসাক্ষী করেই  হোক বা পরমেশ্বর কে সাক্ষী রেখেই হোক, সেই যে সপ্তপদীর শপথ "Now let us make a vow together. We shall share love, share the same food, share our strengths, share the same tastes. We shall be of one mind, we shall observe the vows together. I shall be the Samaveda, you the Rigveda, I shall be the Upper World, you the Earth; I shall be the Sukhilam, you the Holder - together we shall live and beget children, and other riches; come thou, O sweet-worded girl!"

শয্যা , শয়নে , স্বপনে, সবসময় পাশে থাকার সেই অঙ্গীকার। কখনো বা হয় ব্যাহত। দুই দেহ এক হয়ে গিয়ে এক আত্মা, এক মনন হয়ে যাবার যে স্বপ্ন সপ্তপদীর সময় শপথ নেয় দুই সবুজ মন, অনেক ক্ষেত্রেই তা শুধু ওই মন্ত্র হয়েই থেকে যায়। হয়তো দুই দেহ কখনো এক ই হয়না, এক ছাদের তলায় থেকেও দুই দেহ কখনোই হয়তো হয়না এক। কখনো দেহ মিশে যায়, মন থাকে আলাদা আলাদা জগতে, নিজের নিজের মতন করে। কখনো শুধু মাত্রই জৈবিক কারণে হয় মৈথুন। সন্তান থাকে সেতু হয়ে, ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধে গিয়ে দুই মন আবার নামে সমঝোতায়, তারপর একসময় আবার হয়তো নিজ নিজ স্বত্বাকে ভুলে দেহের মিলন মনের চাহিদাকে করে পরিপূরণ। 
আর এইভাবেই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে হয়ে চলে সপ্তপদী গমন। 
কখনো কখনো ওই যে ওপরে যিনি বসে আছেন, তিনি নেন পরীক্ষা। এই চলার পথের পাথেয় মজবুত কিনা দেখার জন্যে হয়তো কখনো বা ঝড় ওঠে সংসার তরীতে। আর তখন ই বোঝা যায় যে এই সপ্ত গমন এর পথ এতো পলকা নয়, অনেক গভীর এর শিকড়। পাশের মানুষটার এতটুকু শরীর খারাপ সমগ্র পৃথিবীকে দুলিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট। চারপাশের সমস্ত সম্পর্ক সমস্ত কিছু এক নিমেষে তুচ্ছ হয়ে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে যায়। আর এই বোধয় সেই সপ্তপদীর কাহিনী। সেই শপথ গ্রহণের মাহাত্ম। 








Saturday, 22 June 2019

নামকরণ

বৃষ্টি এলকি?
পশ্চিমের আকাশে কালো মেঘ, গাঢ়, ঘন, গম্ভীর। সূর্য্য অস্ত যেতে দেরি আছে কিছুটা। পশ্চিমের পথেই পা বাড়িয়েছে , পৌঁছনোর একটু আগেই রাস্তা আগলে দাঁড়ালো কৃষ্ণকায় মেঘের দল। সূর্যদেব বললেন, সেই ভালো লুকিয়ে থাকি কিছুক্ষন এই মেঘের কোলে। মাঝেমাঝে সেই মেঘের মধ্যে থেকে বিচ্ছুরিত হতে থাকলো ইন্দ্রধনুর মতন আপনার সাত রং। আর গভীর আকাশ, একদিকে তার মৌন গাঢ় নীল আর অন্যদিকে কৃষ্ণকালো মেঘের থেকে বিচ্ছুরিত সপ্ত ডিঙ্গার রূপকথায় নিজের গভীর অন্তস্থলের আনন্দ কে বর্ণনা না করতে পেরে শিহরিত হচ্ছে। সেই পুলকিত শিহরণ গোপন রইলোনা, ধরিত্রীর ওপরে, সবুজ বনানী কে মাতাল করে দিয়ে ব্যস্ত পৃথিবীবাসীর কাছে মেঘের গুরুগুরু সে খবর পৌঁছে দিলো। প্রচন্ড তাপ দগ্ধ প্রকৃতি অপেক্ষা করতে থাকলো আসন্ন বর্ষায় অবগাহনের। 
প্রকৃতির এই মধুর খেলা কখন যেন আবার এক রূপকথার স্বপ্নজাল রচনা করেছে। 
মনে পরে যাচ্ছে, বেশ কিছু আগের কথা। কত বয়স তখন? কি জানি। কি যায় আসে তাতে? মন ছিল খুব সবুজ। তুমি চাঁপা আনলে , এনেই বললে নাম দাও। তোমার সব কিছুতেই তখন নাম চাই। আমিও দিলাম। বললাম এ আমাদের সাঁঝবাতি। তুমি বলবে রূপকথাটা? আমি হেসে বললাম , থাকবে লেখা। প্রথম প্রথম সাঁঝবাতির কদর খুব, কবে ফুল আসবে, কচি পাতায় গাছ ভরবে, গন্ধে আকুল হবে আমাদের ১০ টা ৫ টার জীবনগুলো। গন্ধরাজ আর মাধবীলতার মধ্যে হেসে উঠবে সে। অপরাজিতার গাঢ় নীলে হবে তার নতুন অভিষেক। 
সেবারে সাঁঝবাতি ফুল দিলোনা। পাতা গুলো কেমন একটা হলদে হয়ে শুকিয়ে গেলো। তোমার রকমারি ফুলের বাগানে আরো নানান অভিজাত নিত্য নতুন কেয়ারি করা পাতার বাহারে খুব ব্রাত্য হয়ে পড়লো তার উপস্থিতি। আমাদের সাঁঝবাতি জ্বললনা আর কোনোদিন ই হয়তো বা। 
কথা ছিল, বৃষ্টির প্রথম জলে সে ভিজবে। কথা ছিল নতুন ভোরের প্রথম আলোতে সে ঘুম ভাঙাবে। কিন্তু শুধু আমরা কি সব সময় প্রথম আর নতুনকেই খুঁজি সবসময়, চিরন্তন কে নয়? কিজানি। তাই বোধয়। 
একটা ঠান্ডা হাওয়া দিলো, লেমনগ্রাস এর গন্ধ টা কেমন যেন নেশা নেশা। আচ্ছা আজ এতদিন পরে, ধরো যদি কোন প্রৌঢ় চশমার কাঁচটা আর একবার পরিষ্কার করে নিয়ে ফিরে তাকাতে চায়, সেই অভিমানে ভরা সোহাগী দিনগুলোর দিকে। বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ, ভেজা মাটি আর ম্লান হয়ে আসা স্মৃতি কি তাকে মনে করাবে কত বলা না বলা প্রতিশ্রুতির গুলোর কাছে। সাঁঝবাতি উঠবে জ্বলে? নামকরণ সার্থক হবে? 






Sunday, 16 June 2019

Fathers' day

পিতৃত্ব পালনের কোনো স্পেশাল দিন হয়, বা পিতাকে স্মরণ করার? কিজানি, হয় হয়তোবা। জানিনা। আমি তো প্রতিটা দিন তোমাকে মনে করি। প্রতিটা ক্ষণ তোমার দেখানো পথে চলতে চেষ্টা করি। 
তোমার আমার অনেক ফটো ও কোথাও নেই, তখন যে আমাদের যখন তখন ফটো তোলা হতোনা, তুমি আমি আমরা আছি সেই পুরোনো অ্যালবাম এর পাতায়, সেই বোধয় ভালো জানো , সেভাবে আমাদের শুধু তোমার আর আমার কোনো ছবি না থাকাই বোধয় ভালো। পৃথিবীর যা কিছু চিরন্তন যা কিছু অবিনশ্বর তাই তো নাকি সবসময় থাকে অগোচরে, চোখের আড়ালে, তাই এই বেশ ভালো। তোমার মান্তুর আর তার বাবার একসাথে কোনো ফটো নাহয় নাই রইলো তবে। 

তুমি আমার সবথেকে বড় ভরসা। ছিলে যেমন আজও তো তাই আছো। ল্যাব এ pcr না হলেও তুমি, মনখারাপ হলেও তুমি, মেনি কে অনেক্ষন দেখতে না পেলেও তুমি বা কোন গাছে কি ফুল হয়েছে তাতেও শুধু তুমি ই। আজ আর সেই তুমি চলে যাবার দিনটাকে মনে করতে চাইনা। কিভাবে কেমন করে যে তুমি তোমার ছোট মান্তুকে হটাৎ অনেকটা বড় করে দিলে, সেসব কথাও থাক আজ। শুধু তুমি সবসময় আশীর্বাদ করো সেই বজ্রকঠোর কুসুমকোমল চরিত্র টা নিয়ে আমি যেন সগর্বে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারি। 

ভালোবাসা দুর্বলতা নয়, ভালোবাসা ভালোবাসাই। আবার তেমন ই অনেকের অনেক কিছু হাসিমুখে মেনে নেবার মানেই হেরে যাওয়া নয়, তাদের করুণা করাও তো হতে পারে। এই সব বোধ এখন আমার মধ্যে জাগরিত। এই বোধ গুলোকে আমি বিশ্বাস করি, সঙ্গে নিয়ে চলতে চাই। 

জানো বাবা, যত বড় হৈ , একটা একটা করে দিন যায়, বুঝতে পারি, তোমার দেখানো পথে চলা সহজ নয়, খুব কঠিন তা। 
জানোতো সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিল, যখন আমি শুনেছিলাম আমি সবার কাছে ভালো থাকার জন্যেই নাকি সব কিছু করি। মনে পড়লো, এইরকম কথা একবার অনেকদিন আগে, তোমাকে কেউ বলেছিলো, তুমি নাকি ওই যে সব কিছু হাসিমুখে মেনে নিয়ে, বাইরের যত আঘাত সব নিজের ওই বুকের মধ্যে রেখে দাও, কেন করো তা, কেন কিছু বলোনা। তোমাকে কেউ কোনোভাবে এতটুকু আহত করলো মনে হলে, বা তার এতটুকু আভাস ও পেলে তোমার মান্তু যেন ভেঙে চুরচুর হয়ে যেত। ভীষণ রাগ হতো। সেদিন ওই লোকের কাছে ভালো থাকার কথাটা শুনেও মনে পরে গেছিলো হটাৎ, তোমার ওপর কিছুটা ঐরকম ভাবেই করা সেই অভিযোগ। ভালোবাসার ই অনুযোগ ছিল তা যদিও, তবু ছিল তোমাকে না বুঝে করা। আর সেটাই আমার বুকে বেজেছিল। তবু আজও তুমি আমাকে সেভাবেই রেখো বাবা, যেভাবে তুমি আমাকে গড়েছ। 

কঠিন যেখানে হবার, সেখানে যে আমি কতটা কঠিন, তা তো তুমি জানোই, সেইরকম কঠিন যেন না হতে হয় আমায় কারোর ওপরে, সেই কাঠিন্য কে আমি নিজেই ভয় পাই। তোমার মান্তু যেন তোমার আদোরে কুসুমকোমল হয়েই সবার কাছে আসতে পারে। বজ্রকঠিনতা তার থাকবেই। 

রেখো আমাকে ঠিক যেভাবে তুমি দেখতে চেয়েছো তোমার মান্তুকে। আর শোনো, কোনো চিন্তা করোনা, তোমার মান্তু ভালো আছে। খুব ভালো থাকবে সে। কিছুটি ভেবোনা। সব ভালো আছে। অনেক অনেক কথা আছে তোমার সাথে, কিছুই যেন আর বলতে গিয়ে বলা হয়ে ওঠেনা। মনে হয় আরো কত কথা, আরো অনেক। আরো অনেক। তারপর আরো থেকে যায় কথা। আরো। তোমার কাছে গুছিয়ে ভেবে চিনতে কথা বলার তো আর কিছু নেই, সব তোমার জানা। শুধু তুমি দেখো চারপাশের অনেক আঘাত অনেক হতাশা অনেক না পাওয়া, কিছুতেই যেন তোমার মান্তুকে তুমি যেভাবে তৈরি করতে চেয়েছো, সেখান থেকে সে সরে না আসে। আমাদের সময়ে ফাদার্স ডে জানতামনা, জানতামনা mothers day ও , আজ যদি তুমি সামনে থাকতে তুমি না চাইলেও জোর করে তোমার ভালোলাগার জিনিসে জিনিসে তোমায় ভরিয়ে দিতাম একেবারে। জানি তুমি বকতে, কিন্তু তবু দিতাম, জোর করে দিতাম। খুব জোর করতাম। আমার হাতে তুমি সেই যে বাঁধাকপির তরকারি খেতে পছন্দ করতে সেটাও রান্না করতাম হয়তো, হয়তো সেই আলু ডাঁটা বেগুন দিয়ে মাছের ঝোল টাও হয়তো করতাম। 😊সে যাই হোক, মনখারাপ করবোনা, আমি জানি তোমার মান্তুর এতটুকু মনখারাপ বা গম্ভীর মুখ তুমি সহ্য করতে পারোনা। তাই পরের জন্ম বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তুমি আবার আমার বাবা হয়েই এসো , তোমাকে রোজ সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে প্রণাম করে আমার দিন শুরু করবো। 

Wednesday, 5 June 2019

ছাতা

দিল্লিতে থাকাকালীন সেভাবে কেউ ছাতা ব্যবহার করেনা , তবে এবারে কলকাতা গিয়ে বুঝলাম ছাতার অনস্বীকার্য ভূমিকা। ছাতা অর্থাৎ কিনা যে ছায়া দান করে। ছোটবেলাতে আমার একটা রঙ্গীন ওই যে রংবেরঙের ছাতা হয়না, ঐরকম একটা ছাতার খুব শখ ছিল। খুব ইচ্ছে হতো, ঐরকম একটা ছাতার। কিন্তু ওই যে মা বলেছিলো, বায়না করতে নেই কখনো। সেটা নাকি ভীষণ একটা খারাপ জিনিস। ফলত ওই ইচ্ছেটা মনের ভেতরেই থেকে গেছে কখনো আর সামনে আসেনি। সে যাই হোক, আজকে ছাতা নিয়ে লিখতে বসে, প্রথমেই মনে পরে গেল আমার বাবার যে একটা ঢাউস কালো রঙের ছাতা ছিল তার কথা এবং তারপরেই মনে পরে গেল সেই রং বেরঙের ছাতার কথা, যেটা সেই সময়ে আমার কোনো এক বন্ধু নিয়ে আসতো স্কুল এ এবং যার ওপরে আমার যার পরনাই লোভ হয়েছিল। অবাক হলাম এই দেখে যে এই এত বছর পরেও সেই রঙ্গীন ছাতার স্মৃতি এক ই ভাবে মনের মধ্যে ঢেউ তুললো। অর্থাৎ কিনা কোনো ইচ্ছে, কোনো চাওয়া পাওয়া, ভালোলাগা, তা সে যত ক্ষণিকের বা যত তুচ্ছই হোকনা কেন , কিছুই আমাদের ছেড়ে যায়না। সেই ভালোলাগার তরী বেয়ে আমার কাছে এসে পৌঁছনো এক দাবি কে রাখতে গিয়ে শুরু করলাম এই ছাতা বৃত্তান্ত। বলা বাহুল্য যে এ দাবী মেটাতে আমার খুব ভালো লাগছে। চিরকাল ই চেয়েছি আমার ওপর কেউ অধিকার বোধ দেখাক, ভালোবাসার জোর করুক। এমনকি ভালোবাসার সেই জায়গা থেকে কেউ আমাকে তুই এই শাড়িটা পর, বা ওই জুতোটা, বা ওই জামাটা  বা ওই কানের দুলটা খুলে ফ্যাল বা ইত্যাদি ইত্যাদি এমন সব জোর ই যা আপাত দৃষ্টিতে খুব কম মেয়েই মেনে নিতে পারে, তা করে, তাহলে আমার থেকে খুশি কেউ হয়না। সেই কারণেই আমার মায়ের পছন্দ নিজের অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও মেনে নি, কিছুটা সময়ের জন্যে। তবে সে যাই হোক, এই ছাতা প্রসঙ্গে আমার বাবার সেই বড় কালো ছাতাটির কথা না বললে ছাতা কাহিনী নিতান্তই অসমাপ্ত থেকে যাবে। কারণ আদ্যন্ত কাল আমি ওই কালো ছাতাটি দেখেই বড় হয়েছি। তার বাঁট টিও বাঁকানো এবং কালো রঙের। গ্রীষ্ম কালে ওই ছাতাটি সবসময় না থাকলেও বর্ষাতে বাবার সবসময়ের সঙ্গী ছিল ওই ছাতাটি। আর কারোর বাবার হাতে অমন ছাতা দেখতামনা, শুধু আমার বাবার ই অমন পুরোনো আমলের ছাতা। ফ্যাশন সম্পর্কে বেশ সচেতন হতে শুরু করেছি তখন। ফলত ছোট ছোট ফোল্ডিং নানান রঙের ছাতার সামনে বাবার ওই ঢাউস কালো ছাতাটির ওপরে আমার ছিল যার পরনাই রাগ। কেন বাবা শুধু ওই ছাতাটা নিয়েই যায়, বিয়ে বাড়ি থেকে অন্নপ্রাশন কি রোজের স্কুল এ যাওয়া, সবেতেই কালো বাঁকানো বাঁটের লম্বা ইয়া বড় একটা ছাতা হাতে একমুখ হাসি নিয়ে আমার বাবা। কতবার বকতাম বাবাকে, তুমি কেন ছোট ছাতা নাওনা গো, সবাই কেমন ছোট ছাতা নেয়, বাবা বলতো, অরে আমি এত লম্বা, আমাকে পুরোটা বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে গেলে তো এইরকম বড় ছাতাই চাই .খুব ই সহজ সোজা উত্তর। কি আর বলবো। এখন ভাবলে খুব গর্ব হয়। ছাতা নিয়ে সবাই যখন ফ্যাশনেবল, বাবা ভুলেও ভাবতোনা, লোকে কি বলবে কি ভাববে, কিভাবে নেবে। শুধু মিটিমিটি হেসে নিজের যেটা মনে হতো, সেটাই করে যেত। এমন ই ছিল আমার বাবা। কত স্ট্রং ছিল তার will power , কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতেই না দিয়ে।
ওই ছাতাটা আর ছাতার অনেকগুলো বাঁট এখনো রাখা আছে। তখন যে জিনিসটার ওপরে খুব রাগ হতো, এখন সেই জিনিসটাকে যেন আঁকড়ে ধরে থাকতে ইচ্ছে করে। মনে হয় একবার ওই মানুষটা আসুক, আসুক সামনে একবার ওই ছাতাটা নিয়ে। খুব গর্ব ও হয়। আমার বাবা যে অন্য আর সবার মতো ছিলোনা। সেই শার্লক এর দাদা মাইক্রফট হোমস এর মতো একটি লম্বা কালো ছাতা বাবার সঙ্গী। পরে এখন দেখি, ইংল্যান্ড এর খুব অভিজাত ফ্যামিলি তে ঐরকম ছাতা নেওয়ার চল আছে। 

যাই হোক, যে কথা বলছিলাম। বলছিলাম অধিকার বোধ এর কথা, দাবী। একটা ছাতা কি আর এমন গুরুত্ব পূর্ণ জায়গা হতে পারে, যে যার জন্যে মাথার যন্ত্রণা থেকে শুরু করে হাতের হাজারো কাজ তুচ্ছ করে অনায়াসে আবোল তাবোল বকবক করতে পারা যায়, একথা আগে বুঝিনি। এখন কথা হচ্ছে এই যে, আজ থেকে ৩০ বছর আগে যদি আমাকে কেউ বলতো ছাতা নিয়ে লিখতে তাহলে আমি কি লিখতাম। তখনো কি আমি এইভাবে লিখতাম যে ছাতা শব্দটি এসেছে ছা ঋতুর রি সমাস থেকে, বা ইত্যাদি ইত্যাদি। নাহ , নিশ্চই এভাবে শুরু করতাম। 

লিখতাম , আমার একটা গোলাপি রঙের ছাতা আছে। গোলাপি রংটা হলো ওর কাপড়টা , বেশ কিছু মেটাল রিব দিয়ে আর একটা স্টিল এর পোলের ওপরে ওই গোলাপি কাপড়টা আটকিয়ে এই যে জিনিসটা আছে, পাপাই বলেছে এটার নাম ছাতা। এখন বাইরে খুব গরম, আমি যখন ই বাইরে বেরোই বা স্কুল এ যাই, এই ছাতাটা নিয়ে যাই। এই ছাতাটা আমাকে সূর্য্যের তাপ থেকে রক্ষা করে। আবার যখন বৃষ্টি পড়ে , তখনো আমি এই ছাতাটা নিয়ে যাই, তাতে আমার গায়ে আর জল পড়েনা। এর থেকে আমার মনে হয়েছে যে যা ছায়া দেয়, বাইরের রোদ , ঝড় , জল থেকে আমাদের বাঁচায় তাই হলো ছাতা। মাঝেমাঝে আমি এই ছাতাটা নিয়ে ঘর ঘর খেলিও, এই ছাতা টা টাঙিয়ে তার ভেতরে গিয়ে আমার পুতুলদের নিয়ে গিয়ে বসি। বেশ লুকোচুরি খেলার মতন আমাকে কেউ দেখতে পায়না কিন্তু ওই ছাতার নিচে আমি বসে থাকি। শীত, গ্রীষ্ম বা বর্ষা বছরের সকল সময়েই ছাতা দরকার হয়। ছাতা সাধারণতঃ দুরকমের হয় (collupsable and non collupsable) কোনো কোনো ছাতাকে গুটিয়ে ছোট করে নেওয়া যায়, আবার কোনো কোনো ছাতা লম্বাই থাকে, তাকে গুটিয়ে নেওয়া যায়না।

ইতিহাস বলে প্রথম ছাতার ব্যবহার শুরু হয় চীন দেশে, এবং যথাক্রমে (প্রাচীন) মিশর, গ্রিস এবং আমাদের দেশ ভারত এ। তবে সমসাময়িক ইউরোপিয়ান বিভিন্ন দেশেও ছাতার ব্যবহার শুরু হয়। এবং পরে ব্রিটিশ শাসনকালে ইংরেজ দের হাত ধরে এদেশে আসে নানান রং বেরঙের হাল ফ্যাশনের ছাতা। বর্তমানে পৃথিবীর সমস্ত দেশ এই ছাতার ব্যবহার করা হয়। ১০ th february কে বিশ্ব ছাতা দিবস বা national umbrella day হিসেবে পালন ও করা হয়। বার্বি থেকে শুরু করে নানান জাপানী পুতুলের হাতে খুব সুন্দর সুন্দর ছাতা থাকে।

পাপাই বলেছে, ছাতা শব্দ টা এসেছে সংস্কৃত শব্দ ছত্র থেকে। হিন্দু, বৌদ্ধ আর জৈন ধর্মের কাছে ছাতা খুব একটি শুভ চিহ্ন। যার সূত্র ধরেই অনেক দেব দেবীদের মাথায় ছাতা দেওয়ার একটি রীতি আছে, এবং একসময় বিভিন্ন রাজা রাজরাও যা নিজেদের আভিজাত্য দেখানোর ক্ষেত্রে বহন করে থাকেন। ছাতার ইংরাজী প্রতিশব্দ হলো umbrella.
ছাতাটা যেন আমার পাপাইয়ের মতন। আমার পাপাই যেমন সব কিছু থেকে আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, আগলে রাখে, এই ছাতাটাও যেন তাই।

ছাতা টা বাবার মতন না বাবারা ছাতা হয়ে আমাদের সবকিছু থেকে আগলে রাখে, ঢেকে রাখে সে কথা ঠিক করে বোঝার ক্ষমতা আমার তখন ঠিক হয়নি, কিন্তু এখন হয়েছে। এখন বুঝতে পারি, বাবারা সত্যি ই ছাতার মতন করে আমাদের কে বাহ্যিক যা কিছু অসহনীয় তার থেকে ঢেকে রাখে, আগলে রাখে। প্রতিটা পদক্ষেপে ঠিক কোথায় কোথায় কি কি করতে হবে, কিভাবে গেলে তাঁর সন্তান সুরক্ষিত থাকবে, এমনকি শুধুই ওই মুহূর্তের জন্যে নয়, চিরকালীন চিন্তা করে, ভবিষ্যতে ও যাতে সে এক ই ভাবে সুরক্ষিত থাকতে পারে, এইসব ভেবে, আমাদের এক একটা পদক্ষেপের আগে থাকে ওই মানুষটার এই এতকিছু ভাবনা।
তাইতো শুধু ছাতা নয়, যখন অনেক বড় বড় কোনো গাছ দেখি, মহীরুহ , এইরকম মোটা মোটা গাছের গুঁড়ি , গায়ের রং কেমন একটা কালচে বাদামী , বিশাল বিশাল ডাল পালা পাতা, অনেক রোদের মাঝেও যার তলায় গিয়ে দাঁড়ালে সমস্ত দেহমন শীতল হয়ে জুড়িয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনা। খুব রোদে তাপে পথ যখন রুক্ষ হয়ে রাস্তা আগলে দাঁড়ায়, তখন মনে মনে আমরা খুঁজে চলি এমন ই কোনো মহীরুহ কে, মনে হয় একটু দাঁড়াই কাছে গিয়ে, একটু বসি এর তলায়। ওই শান্তির আশ্রয়টাই অনেকটা পথ হেঁটে যাবার শক্তি জুগিয়ে দেবে। খুব ভাগ্যবানরা তাদের মা বাবাকে জীবনের অনেকটা পথ পর্যন্ত পায়, তাদের আলো ছায়ায় ভরিয়ে রাখার জন্যে, ছেলেমেয়ের ছাতা হয়ে থাকার জন্যে। আর আমার মতন হতভাগ্য যারা যারা জীবনের কিছু টা চলেই ওই ছায়া থেকে বঞ্চিত হয়, তখন মাথা কুটে মরে গেলেও সেই স্নেহময় মধুর ছায়াটি যেন কিছুতেই পাওয়া যায়না। তবে না হয়তো বা এটা ঠিক ব্যাখ্যা হলোনা বা, কারণ physically ওই মানুষটাকে কাছে পাই বা না পাই, তাঁর স্নেহচ্ছায়া থেকে বঞ্চিত আমি একথা কখনো ঠিক নয়। কখনো নয়। তাঁর স্নেহছায়া আছে বলেইতো সব কাজে এত জোড় পাই, শক্তি পাই। তবে হ্যাঁ এটাও ঠিক যে কখনো কখনো ওই ছাতার মতো কাউকে সামনে থেকে সত্যি পেতে খুব ইচ্ছে করে। আমরা যে রক্ত মাংসের মানুষ। তাই নয়নের সম্মুখে না থেকে নয়ন মাঝে ওই মানুষটা ঠাঁই নিয়ে আছে জেনেও, তাকে নয়নে সম্মুখেই তবু চাই। বাবারা যেভাবে আগলে রাখে, তা কেউ ই পারেনা কখনো। তবে জীবনে চলার পথে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ কখনো কখনো আসে, তাদের মধ্যে, না ছাতা হয়ে হয়তো কেউ আসেনা তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছাতা হাতে করে নিশ্চই আসে। কিছুটা সময় কিছুটা রাস্তা ওই যে যতটা আমাদের ভাগ্যে বরাদ্দ থাকে, ততটা রাস্তা বেশ নিশ্চিন্তে হাঁটা যায়। মনে হয় এখানে আমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই, দরকার নেই অকারণ চিন্তার। আমার কাজ শুধু হেঁটে যাওয়া। পাশের মানুষটার ছায়ায় বেশ নিশ্চিন্তে আমি চোখ বন্ধ করে হেঁটে যেতে পারি।

আজ যখন বাবা আর কাছে নেই, তার সেই ঢাউস ছাতার নিচে তার আদরের মান্তুকে আগলে সমস্ত রোদ, ঝড়, জল থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলার (physically), তখন ও মনে এখনো চোখ বন্ধ করে সেই ছবিটাই ভেসে আসে, আর মন বলে, এই মান্তু তো নাহয় বড় হয়ে গেছে অনেক। কিন্তু আরো ছোট্ট মান্তু যেন ওই ছাতাটা পায়। ঠিক করে। যেন ঝড়, বৃষ্টি, রোদের আঁচ না লাগে তার গায়ে।  

Tuesday, 4 June 2019

কানায় কানায়

টলটলে শান্ত স্থির শীতল দীঘির ধারে থাকতো এক মাছরাঙ্গা। শান্ত সবুজ আলোছায়া ঘেরা গাছগাছালি। ঝিকিমিকি দীঘির জল।  দিন যাচ্ছিলো তার নিজের মতো করে। দীঘির জল এ  ডুব দিতো, মাছ নিয়ে মুখে করে তার ছোট্ট বাচ্ছা মানুষটাকে দিতো, তারপরে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীর গল্প বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে পড়তো। একটু একটু করে ওই তার ওই ছোট্ট ছানা টিকে বড় হতে দেখতে দেখতে তার দুচোখ আশায় গর্বে ভোরে উঠতো। এইভাবে রূপকথার জগতে তরী বেয়ে তার দিন কাটছিলো। 

এমন সময় একদিন ধ্যানমগ্ন মাছরাঙ্গা যখন দীঘির ধারে চুপ করে বসেছিল, হয়তো বা তার চোখে ছিল কোনো মেঘের ছায়া। সময়টা ছিল শীতকাল। দেশ বিদেশের পরিযায়ী পাখিরা তার এই সুন্দর গ্রাম বাংলার ছায়া সুনিবীড় শান্তির নীড় এ আসছিলো, যাচ্ছিলো। সেইরকম কোনো এক বিষন্ন বিকেলে, শীতের আসন্ন সন্ধ্যের নিস্তব্ধতার মধ্যে দেখা হলো এক পরিযায়ী পাখির সাথে। অনেকটা আমাদের দেশের চড়াই পাখির মতো যার আকার আয়তন, অর্থাৎ কিনা মাছরাঙ্গার থেকে অনেক পুচকে মতন ছিল সেই পাখি। সাদা রঙের পালকে ঢাকা, আর দলের নানান সঙ্গীদের থেকে ছিল একেবারেই সাধারণ তার চাল চলন আহার বিহার। তা সেই পাখি তার চোখে দেখলো আসন্ন রাত্রির ছায়া। জানতে চাইলো কারণ, বললো এইতো রাত পেরিয়েই আবার ভোর হয়ে যাবে, কেন তবে তুমি মনখারাপ করে আছো। মাছরাঙ্গা বললো বসবে আমার পাশে, আমার এই স্থির শান্ত দীঘির ধারে। পরিযায়ীর মনে ছিল চিরকালীন থিতু হবার স্বপ্ন। বসলো সে। তারপরে কত কথা কত কাহিনী। যেন জন্ম জন্মান্তর ধরে দুই ভিন্ন দেশী ভিন্ন পরিস্থিতির পাখির মনে জমেছিলো কত হাজারো না বলা গল্প। ধীরে ধীরে সেই একদিনের অল্প আলাপ পরিণত হলো গভীর বন্ধুত্বে। মাছরাঙ্গার মনে হলো তার যে এমন এক সুন্দর গাঢ় নীল রং আছে, একথা এমন ভাবে তো তাকে কেউ বলেনি, আর পরিযায়ীর মনে হলো তার এই যে সাদা রংটাকে সে এতদিন খুব সাধারণ ভেবে এসেছে, তা সত্যি ই কাউকে রঙ্গীন করে তুলতে পারে? এইভাবে কিছুদিন স্বপ্নের মতো কেটে চললো। পরিযায়ীর ফেরার পালা, মন চায় তার স্থির নিস্তরঙ্গ এক জলতরঙ্গ। চির শান্তির আশ্রয়। আর মাছরাঙ্গার ক্ষণিকের জন্যে মনে হলো, আমিও যদি যেতে পারতাম দূর থেকে দূরে। "নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারে তে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। " তারা দুজনেই না পারে, তাদের আপন আপন বৃত্ত ভেঙে বেরোতে, না পারে সেই বৃত্তের ভেতরে থাকতে। এমনি এক অবস্থায় পরিযায়ী বারবার চলে আসে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে সেই ঝিলের ধারে , দুজনের দেখা হয় কিন্তু তাতে আরো বেশি কাছে পাবার ইচ্ছে প্রবল হয়ে ওঠে। পরিযায়ী ভাবে এ কি বিড়ম্বনা। এ দেখা নাহোলেই ছিল বেশ ভালো আর নীলকণ্ঠী মাছরাঙা ভাবে দেখা হয়েছে যখন,তখন এর কিছু শুভ উদ্দেশ্য নিশ্চই আছে। ওপর থেকে বিধাতা হাসেন। আর এভাবেই দুই দূর প্রান্তের দুই ভিন্ন পরিস্থিতিতে থাকা মন নিজেদের মতো করে একে অপরের কর্তব্য পালন করে চলে, আবার সেই দুই মন নিজেদের মতো করে একে অপরের কাছে আসে। তাদের ভিন্ন জায়গা, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন আচার বিহার, তবু কি যেন এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন তাদের একে অপরকে রেখেছে বেঁধে। 
আসলে ক্ষুদ্রতর জায়গায় যা আলাদা, বৃহত্তর ক্ষেত্রে তাই যে এক। ধরো পৃথিবীর এক প্রান্তে যখন দিন অন্যপ্রান্তে তখন রাত , একদিকে যখন ঠান্ডা অন্যদিকে তখন গরম অথচ আবার যখন বৃহৎ বৃহৎ অনেক বৃহত্তর বৃত্তে আপন আপন গন্ডির বাইরে গিয়ে যদি আমরা ভাবি, তখন দেখি একটি ই সূর্য্য এই কান্ডটি ঘটাচ্ছেন , সেই এক ই সূর্য্যকে আমরাও দেখছি আবার দেখছে অপর পক্ষের সবাই ও। আকাশ ভরা তারা জায়গা বিশেষে পর্যোবেক্ষণের অবস্থান বদলায় ঠিক ই কিন্তু যার পরিপ্রেক্ষিতে তা বদলায় সেই বিশাল অসীম মহাবিশ্বের প্রেক্ষাপট যে একটি ই। সেই এক ই আকাশ। এক টি ই চাঁদ। যে চাঁদ দেখে রবিঠাকুর বলে উঠেছিলেন "চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে", সেই চাঁদ দেখেই আবার Wordsworth বলেছেন "The Crescent-moon, the Star of Love, /Glories of evening, as ye there are seen".    
তবু রক্তমাংসের বাস্তব দুনিয়াতে এমন দার্শনিক কথা মেনে এবং মনে নিয়ে চলা খুব দুষ্কর। ফলত: ঝড় উঠতো, এবং সেই ঝড়ে কখনো আমাদের নীলকণ্ঠী অভিমানে গলা ফুলিয়ে বসে থাকতেন, কখনো বা শুভ্র চড়াইটি মুখ কালো করে অভিমানে মুখ লুকোতে। নীলকণ্ঠীর মনে হতো তুমি তো আর কখনো আমার হয়ে থাকবেনা, কেন তুমি আমার হয়ে থাকতে পারোনা? অভিমানে তার গলা ধরে আসতো, চোখে আসতো জল, মনে হতো এসব মিথ্যে, কখনোই পরিযায়ী আমার হবেনা, একদিন ঠিক আমাকে ভুলে অনেক দূরে চলে যাবে। পরিযায়ীর মনে হতো, নীলকণ্ঠীর নিজের দুনিয়াতে সে বড় ব্রাত্য। কেনই বা সে তার সুন্দর স্থির নিস্তরঙ্গ জল এ ঢেউ তুলে যাবে? নাহ এ তার কখনোই ঠিক নয়, এভাবে তার শীতল দীঘিতে ঢেউ তোলার সে কেউ ই নয়। সে আর কখনো নীলকন্ঠীর বৃত্তের ভেতরে আসবেনা। এমন কথা শুনে নীলকন্ঠীর হতো রাগ, সে প্রমান করতে বসত যে বস্তুতঃ ই  তার দীঘির জল না ছিল কখনো শান্ত, না ছিল কখনো শীতল। পরিযায়ী চড়াই দিতো কানে আঙ্গুল, কিছুতেই সে শুনবেনা। এভাবেই সময় পেরোচ্ছিলো। 

এই দুটির কথা অলক্ষ্যে জানতেন শুধু একজন, তিনি চুপচাপ মিটিমিটি হেসে লিখে চললেন কাহিনী। সে কাহিনীর শুরু কিভাবে কোথায় বা শেষ সে সব কথা ধীরে ধীরে হলো অপ্রাসঙ্গিক। সে কাহিনীতে সত্যি হয়ে রইলো শুধু ঝিলের শান্ত নিস্তরঙ্গ জল, ঝিকিমিকি সূর্যের আলো, কালো পিচ ঢালা রাস্তা, শীতের উষ্ণ আদর, গ্রীষ্মের দাবদাহ, বর্ষার জল, ভরা নদী, অপরাজিতার গাঢ় নীল, গোলাপের পাপড়ি, জুঁই এর শুভ্রতা, গন্ধরাজের মত্ততা, কৃষ্ণচূড়ার লাল, চাঁপার মৃদু অথচ উজ্জ্বল মধুর তেজ, সুবাসিত রাত্রি, ভোরের স্নিগ্ধতা, নতুন দিনের আশা, সোনালী বিকেল, গোধূলির আবেশ, ধূপের গন্ধ, ধুনোর ঘোর, শঙ্খ ধ্বনির শান্তি, কাঁসার থালার সাবেকিয়ানা, খাওয়ানোর আকুলতা এমন কত কি। আর এই সব কিছু আবর্তিত হতে থাকলো ওই একটি ই সূর্য্য , একটি ই চাঁদ , এক ই আকাশ ভরা তারা, আর একরকম রং এক ই তুলি দিয়ে আঁকা একরকম স্বপ্নকে ঘিরে। সেই স্বপ্নই তাদের নিজ নিজ জায়গার ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে তাদের স্থির রাখতো, জোর দিতো মনে, দুর্বলতা নয়, শক্তি হয়ে থাকতো , আর দিনের শুরুতে তাদের মনে হতো আর একটা নতুন দিন, আর একটা নতুন স্বপ্ন, আরো একবার নিজেদের সব কিছু জেনে নেবার বুঝে নেবার সময়। আর দিন শেষে তারা সারাদিনের ছোটো বড় সকল প্রাপ্তিকে একে অপরের সাথে ভাগ করে নিয়ে চলতে থাকলো। 

না প্রয়োজন কিছুমাত্র ছিলোনা এদের একে অপরকে, কিন্তু সকল প্রয়োজন সব স্বার্থের থেকে উর্ধে উঠে এই যে সম্পর্ক, এর নাম আমার জানা নেই, জানা নেই হয়তো বা এ বিশ্বের সেই মহাকাল সেই মহাকবির ও। তাই হয়তো তিনিওবা তখন আপন লেখনী থামিয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এ পৃথিবীর বুকে সূর্য্যকে বললেন আরো মধুর হয়ে উঠতে, চাঁদ কে বললেন আরো স্নিগ্ধ আরো নরম হয়ে আদর হয়ে জড়িয়ে রাখতে, আর ফুলে ফলে রঙে রসে সবুজে সবুজে ভোরে দিতে প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটি ক্ষণ। প্রতিদিনের যে বাঁচা সকল স্বার্থের থেকে উর্ধে এসে থাকতে পারে, যার মধ্যে এতটুকু স্বার্থের ছোঁয়া থাকেনা এমন গভীর বোধের গোপন প্রাপ্তিকে কেউ না বুঝুক শুধু তার ব্যাপ্তিটুকু এই দুই মন কে কানায় কানায় রাখুক ভরিয়ে। সেই দুই মনের গভীরে তাই সকল কলুষতা হিংসা স্বার্থ হানাহানি কাড়াকাড়ি লড়াই কিছু প্রবেশ করতে পারেনা, সকল অশান্তি যেন ঠিক ওই দীঘির জল এর মতোই স্থির শান্তি নিয়ে এসে দুই মনকে একেবারে ভিজিয়ে দিয়ে যায়, আর সেই ভেজা মনের নরম মাটিতে জন্ম নেয় নব বোধের কচি সবুজ চারাগাছ; ভালোবাসায় আদোরে সোহাগে যত্নে তাতে ফুল আসে, ফল হয়, সবুজ চারাগাছ পরিণত হয় মহীরুহে , ছায়া দেয়। আর সেই ছায়া, নতুন উজ্জ্বল আলোর সাথে মিশে গিয়ে এক অদ্ভুত মায়াজাল রচনা করে এই দুই মনকে পরিপূর্ণ করে রাখে। কানায় কানায়। এর যেন বিরাম নেই, বারণ নেই, নেই থেমে যাওয়া, সেই যে একসময় কালিদাস যেমন লিখেছিলেন সেইরকম ই বলতে ইচ্ছে করে, সহস্র বৎসর যেন এইভাবেই এক লহমায় পেরিয়ে যায়। এই কানায় কানায় পরিপূর্ণতা যেন সকল অপ্রাপ্তি, সকল অন্ধকারকে একেবারে আলোয় আলোয় প্রাণ দিয়ে ভরিয়ে দেয়। কানায় কানায়। 

Wednesday, 22 May 2019

জন্মান্তর

সেদিন, হটাৎ ছেলেটি মেয়েটিকে বললে,
এই আমাকে তুই বলে ডাকবি? ডাকনা।...
মেয়েটি অবাক।....যাহ , তুমি করে ডাকতে ডাকতে হটাৎ আবার তুই বলা যায় নাকি,
ছেলেটি জেদ করলে একবার বলার জন্যে।..
কেন এমন অদ্ভুত আবদার।
অবাক হলো মেয়েটি
পরে বুঝেছিলো, খুঁজে পেয়েছিলাম মাতৃ ছায়া আকাঙ্খিত এক অবুঝ বালক কে
যে বারবার তার পরম কাছের জায়গা থেকে খুঁজে পেতে চেয়েছে মা এর মমত্ব
সহোদরা, বন্ধু, সখী , প্রেমিকা, স্ত্রী। .....বয়সের সাথে সাথে অজস্রের সম্পর্কের ভিড়ে , অনেক দায়িত্বের আবডালে কেউ আর আলাদা করে মনে করেনি বা করায় ও নি, যে তার ও চাই একটা মাতৃক্রোড়ের মতোন ভরসাস্থল
এক নিশ্চিন্তে বাহুডোর
এক অনন্ত আশ্রয়।
মৈথুন রত ক্লান্ত শরীর কি শুধুই শরীর হাতড়ে চলে,
তার মধ্যে কি শুধুই থাকে ভোগের ইচ্ছা, চেতনাহীন, বোধহীন অনন্ত সম্ভোগ?
শুধুই ?
আমি যদি বলি, স্নেহহীন , মমত্ব হীন মৈথুন ধর্ষণ এর ই সমান।....
ধর্ষিত কি শুধু নারী ই হয়,
পুরুষ নয়.........
সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীর যখন চেয়েছে সঙ্গিনীর নরম বক্ষস্থলের উষ্ণ আদোরে গলে পড়তে,
তখন হয়তো তাকে মেটাতে হয়েছে সঙ্গিনীর ই রতি লিপ্সা
তার সন্তুষ্টি আর তৃপ্তির সঙ্গে মিশে যেতে যেতে কখন ভুলে গেছে নিজেরও কিছু চাওয়ার ছিল
বীর্য্যস্খলন এর যন্ত্রণা নয়, তার সুখ শরীরের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইয়ে দেওয়ার, বইয়ে নেওয়ার গভীর অভীপ্সা।
সমঝোতার মধ্যস্থতা নয়, দুটো মনের সঠিক বোঝাপড়ার পরে এক হয়ে মিশে যাওয়া।
শুধুই স্বামীত্বের কর্তব্য নয়, স্বামী হয়ে উঠতে পারার পরম প্রাপ্তি কে আপন স্বত্বার প্রতিটা বিন্দুতে অনুভবের ইচ্ছা।
আত্মগ্লানির মধ্যে জেগে ওঠা নয়,
নতুন ভোরের স্নিগ্ধতার মধ্যে, সলাজ মধুর স্মৃতির রোমন্থনের মধ্যে দিয়ে, নতুন ভোরের পবিত্রতার মধ্যে দিয়ে, নতুন করে মাতৃ ক্রোড়ের মতোই নিশ্চিন্ত তার সঙ্গে ঘুম ভাঙা।..আর দিনের আলোর মতো চেতনা বোধ মায়ায় এগিয়ে চলা।
অবাক হচ্ছেন, ভাবছেন মৈথুন কিভাবে মাতৃপ্রেম এর সাথে তুলনীয় হয়?
হয়....প্রেম মনের এক প্রকাশ, যা সম্পর্কের পরিবর্তনে তার রূপ বদলায় মাত্র, আর আমাদের অন্তরের অন্তস্থলে বয়ে চলে সেই প্রেম এর অবিনশ্বর ধারা।...
যেহেতু মা বাবা হচ্ছেন সবথেকে বিশ্বস্ত জায়গা
তাই....
পুরুষ তার সঙ্গিনীর থেকে খুঁজে চলে সেই নিশ্চিন্ততার জায়গা
নারী তার সঙ্গীর কাছ থেকে খুঁজে চলে সেই ভরসাস্থল
আর যখন এই দুই চাওয়া সম্পূর্ণ হয়, তখন হয় প্রকৃত মিলন
কখনো নারী সেই পর্বত সমান বক্ষস্থলে চায় ছোট্ট চড়াই পাখিটি হয়ে থাকতে
আবার কখনো বা নিজ বক্ষের নরমে আগলে রাখে সেই পর্বত এর ই শিশু সুলভ সত্তা।
সমুদ্র মন্থন এর পরে, আকণ্ঠ গরল পান করে শিব যখন হলেন নীলকণ্ঠ
তখন স্বয়ং পার্বতী তাঁকে আপন স্তন্যের সুধা পান করিয়ে সেই গরল কে অমৃত রূপ দান করলেন।
মহাকাল তখন এক শিশুর মতন মাতৃরূপী পার্বতীর কাছে নিজেকে করলেন সমর্পন।
আর পরম যত্নে, মমতায় পার্বতী আপন সন্তান স্নেহে শিশু ভোলানাথের মুখে দিলেন নিজ স্তন।
কি অপূর্ব, কি অসাধারণ সেই সৃষ্টি।
প্রেম ও প্রকৃতি যদি একাত্ম হয় রচনা হয় যুগান্তকারী সৃষ্টির
নারী পুরুষ তখন উন্নীত হয় শুধুই নারী পুরুষের সাধারণ সম্পর্কের থেকে অনেক ওপরে।

আর এইভাবেই আমাদের নিজেদের অজান্তেই , অজ্ঞানে, হয়তো ফল্গুধারার মতো নারীমনে বয়ে চলেছে, তার পাশের মানুষটিকে যত্নে স্নেহে সমস্ত সংসার গরল থেকে রক্ষা করার বাসনা।....যা তাদের শুধুই  প্রেমিকা, শুধুই স্ত্রী, শুধুই সখার জায়গা থেকে নিয়ে যায় আরো ওপরে।
আর পুরুষ, সমাজ সংসার এ সকল দায়িত্ব , কঠোর কর্তব্যের পরেও মনের গভীরে থাকে এক মা এর খোঁজ, নিজের অজ্ঞানে, অচেতনে
কোথাও হটাৎ যদি সেই স্নেহ ময় মাতৃ রূপ এর সাথে এতটুকু মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তখন মন বলে ওঠে এই খুঁজছিলাম,
কিন্তু কজন নারী একাধারে বান্ধবী, প্রেমিকা,  থেকে সহধর্মিনী হয়ে উঠতে পারে ?
মাতৃরূপে আপন মমতায় পাশের পুরুষটিকে রাখে আগলে ?
আর কজন পুরুষ ই বন্ধু, প্রেমিক, সখা থেকে সত্যি স্বামী হয়ে উঠতে পারে?
বা স্বামীত্বের অধিকার বোধ পেরিয়ে পিতৃত্বের সুরক্ষার আবডালে রাখতে পারে পাশের নারীটিকে
হোকনা নাহয় জন্মাতর এবার ,
নবজন্ম পাক সংসার প্রেম
নব চেতনায় উন্মীলিত প্রেম বোধ তব
ফিরিয়ে আনুক মোরে নব নব রূপে
দিক ফিরিয়ে তোমারে
এ সংসার সাগরে।
বারেবারে।

Thursday, 9 May 2019

আমার পঁচিশে বৈশাখ- tribute to Rabindranath

আজ পঁচিশে বৈশাখ। আমার পঁচিশে বৈশাখ বলতেই চোখ বন্ধ করে একটাই স্মৃতি খুব উজ্জ্বল ভাবে ভেসে ওঠে মনে। সেটা হলো আমার মেজদিদার বাড়ি। দোতলার দক্ষিণের ঘরের টেবিল এর ওপরে বড় একটা কবিগুরুর ছবি। দুপাশে পেতলের ফুলকারী কাটা ফুলদানীতে পুকুর পাড়ের কৃষ্ণচূড়া গাছের থেকে আনা লাল টকটকে উদ্ধত কৃষ্ণচূড়ার গুচ্ছ। মাসি ধুপ জ্বালাতে জ্বালাতে বলছে নমো করো। একটা জিনিস ওই তিন চার বছর বয়সে আমি কিছুতেই বুঝতে পারতামনা। রবি ঠাকুর কি ঠাকুর? তাহলে ওপরের ঠাকুর ঘরে না থেকে বই এর টেবিল এ কেন ? খুব বড় প্রশ্ন ছিল এটা আমার মনে। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম বাবা বললো ঠাকুর তো সবজায়গাতেই থাকে, এখানেও আছে ওখানেও আছে। ঠিক সন্তুষ্ট না হলেও শিশুমন এটুকু  বুঝেছিলো যে ঠাকুর ঘরে থাকা ঠাকুরদের মতন এই ঠাকুর একদম ধরা ছোয়াঁর বাইরে বুঝি নয়, প্রতিদিনের পাঠ্যের মধ্যে এঁকে পাওয়া যায়, নিজের বই এর বনে থাকে বাঘ গাছে থাকে পাখি যে বলেছে সেই আবার দিদির বই এর আঁধার হলো মাদার গাছের তলার কথাও বলেছে, গরমের সন্ধেতে বা চাঁদনী রাতে মায়ের গলার গানে যেমন আছে আবার মামার সেতারেও তার সুর বাজে । গরম কালের সন্ধেতে চাঁদের আলোতে ভেসে যাওয়া ছাদে মাদুর পেতে বসে মা যখন গান গাইতো, কিংবা দুপুর বেলা শুয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে 'লুকোচুরি' শোনাতো, তখন মা এর দুপাশে আমরা দুবোনে শুয়ে সত্যি সত্যি চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফোটার কথা ভাবতাম, অথবা মা যখন বলতো 'যখন যেমন মনে করি তাই হতে পাই যদি '..আর আমার মন ও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠতো, আমি যেন এখুনি হৈ ইছামতি নদী। তারপরে বড় হওয়ার সাথে সাথে আলাদা করে আর বিষ্ময় নিয়ে রবি ঠাকুরকে ভাবতামনা, রবি ঠাকুর তখন পড়াশুনা ইত্যাদির মধ্যে হটাৎ করে রবীন্দ্রনাথ হয়ে গিয়ে পাঠ্য পুস্তক আর পঁচিশে বৈশাখ এর অনুষ্ঠানের মধ্যে আটকে গেলেন। কিন্তু ফিরে পেলাম তাকে আবার, খুব অভিনব ভাবে। কৈশোর পেরিয়ে যৌবন আসবো এসব করছে, আবার কৈশোর ও যাবো কি যাবোনা ভেবে থমকে দাঁড়িয়ে আছে, এমন একটা সময়, যখন আমাদের পাড়ার পল্লীশ্রী পাঠাগারের ছোটদের বিভাগের পাণ্ডব গোয়েন্দা, এমনকি ফেলুদা, কাকাবাবুতেও ঠিক মন টাকে বেঁধে রাখতে পারছেনা, প্রায়শই উশখুশ করছে পাশের বিভাগের বইগুলোর দিকে, বাড়িতেও বড় দের মার্ক করে রাখা বই গুলোর দিকে প্রায় ই হাত বাড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে। এমন সময় এক গোছা গোলাপের গন্ধের সাথে হাতে এসে পড়লো বুদ্ধদেব গুহর বাবলির। বুঝতেই পারছেন সবাই, কৈশোরের প্রথম প্রেম নিবেদন হাতে এসে পৌঁছেছিল আর কি। সে গোলাপের রং টকটকে লাল ছিলোনা, ছিল নেহাৎ ই অপটু হাতের কারোর বাগান থেকে ছিঁড়ে আনা একগোছা গোলাপি প্রকাশ। কিন্তু নিষেধের বেড়া জালের মধ্যে সেটুকু হটাৎ প্রচন্ড উত্তেজনায় কিশোরী মনকে রোমাঞ্চকতায় ভরে দিতে যথেষ্ট ছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। সেই প্রথম বড়দের বই। পড়ার পরে আবার ফেরত দিতে হবে। কি আছে ওই বইতে? কেন আমাকে পড়তে দিলো? উত্তেজনায় আর তর্ সইছিলোনা, পড়ার বইয়ের নিচে লুকিয়ে পড়তে শুরু করে দিলাম। অভিরূপ আর বাবলি সবে হাতে হাত দিয়ে বেড়াতে বেরোচ্ছে এমন সময় পিছন থেকে মা এর চিৎকার, কে দিলো এই বইটা? কোথা থেকে পেলি এ বই তুই? এ বই পড়ার মতন তো তোমার বয়স হয়নি। ওগো দেখে যাও তোমার আদুরে মেয়ের কান্ড, আদোরে আদোরে তো বাঁদর করেছো , এবার বোঝো। ..ইত্যাদি ইত্যাদি, বাস্তবিক ই আমি সত্যি ই সেদিন তখন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি যে বই তো ভালো জিনিস, সেটা আমাকে একজন দিয়েছে আর আমি নিয়েছি, এতে দোষের কি হয়েছে। আমার কথাও যে সেদিন আমার জননী শোনেননি সেটিও বলাই বাহুল্য। প্রচন্ড বকা ঝকা যথারীতি আমি চোখের জলে বালিশ ভাসাচ্ছি এমন সময় কানে এলো পাশের ঘর থেকে আমার বাবা আর আমার এক মামা সেদিন এসেছিলেন, দুজনের কথোপকথন। বাবা একটু চিন্তিত গলাতে মামাকে বলছিলো, বুঝলি বাবুন ছেলে মেয়েরা যতক্ষণ না সব বুঝতে শিখছে ততক্ষন যে কি চিন্তা, আমি মরমে মরে যেতে যেতে শুনতে পেলাম আমার মামা খুব হালকা ছলে বাবাকে বলছে এতো ভাববেননাতো রঞ্জিতদা, এবারে মান্তুর হাতে রবীন্দ্রনাথ তুলে দিন, এখন ওর রবীন্দনাথ পড়ার বয়স , দেখবেন ওই যে কোনটা পড়বো আর কোনটা পড়বোনা, কোনটা বুঝবো আর কোনটা বুঝবোনা, কতটা নেবো আর কতটা নেবোনা সেই সব ভাবনা কেমন এক দিকে channelise হয়ে যাবে। মায়ের অভিযোগ অনুযোগ মেয়ের কান্না এইসবে জর্জরিত অসহায় ভালো মানুষ আমার বাবার গলায় বেশ একটা উৎসাহ এসে গেল হটাৎ। বললো ঠিক বলেছিস, বঙ্কিম কেও এখন ই দিতে হবে। অর্থাৎ কিনা অমৃত রসে আগে সম্পৃক্ত করে দেওয়া হোক অপরিণত মনটাকে, তারপরে, পরিণতির সাথে সাথে যে রকম ই এক্সপোজার ই পাকনা কেন, যে রসে মজে আছে মন , সেই রসে সিক্ত মন নিজেই বিচার করে নিতে পারবে, কোন রসে, কিভাবে কতটা মজবে। পরে বুঝেছি কি অসাধারণ স্ট্রাটেজি। কি অভিনব উপায়ে আমার বড় হওয়ার সাথে সাথে এক একটা মাইলস্টোন দিয়ে আমার ভাবনা চিন্তা গুলোকে একটা লক্ষ্য দিয়ে দিয়েছিলেন আমার চারপাশের এই মানুষগুলো।যাতে অস্থির হয়ে দিকভ্রান্ত না হয়ে সবকিছুকে খোলা মনে বুঝে বিবেচনার সাথে গ্রহণ করতে পারি। সেই প্রথম পাশের ঘরের সেই কথোপকথনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে আমার অন্যভাবে পাওয়া, বা তাঁর কাছে আমার সমর্পন। গীতবিতান এর গান গুলোর সব ই নতুন ভাবে নতুন বোধ নিয়ে আমার কাছে উঠে এলো তা নয়, কিন্তু বঙ্কিমের গড় মান্দারনের সেই রহস্য মাধুর্য্য এর রস রাজ্য এর অপার অকৃত্রিম মধুরতা, সঞ্চয়িতার পাতার পর পাতা বিষ্ময়ের সাথে মিশে গিয়ে আমাকে রুশ উপন্যাস থেকে বুদ্ধদেব, শরৎ, শীর্ষেন্দু, সুনীল, দুলেন্দ্র সবাইকেই অন্তঃস্থ করতে সাহায্য করেছে।

এরপরে জীবনের সমস্ত ধাপে পদে পদে কখন কিভাবে যেন ওই বুড়ো লোকটা জুড়ে গ্যাছে।  শুধুমাত্র কাব্য করার জন্যে বলছিনা, বিশ্বের কাছে নিজেকে রবীন্দ্রপ্রেমী বলে প্রমান করার জন্যে নয়, একদম বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, নিজের সবথেকে কাছের সবথেকে প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে বারবার যখন গীতার মধ্যে শান্তি খোঁজার চেষ্টা করছি, তখন একদিন এমনিই কানে এলো আছে মৃত্যু, আছে দুঃখ, বিরহদহন লাগে। ..এর আগে কত বার শুনেছি ওই সুর, কিন্তু সেদিনের মতন ঐভাবে কোনোদিন যেন অন্তস্থ করতে পারিনি। সেদিন আরাবল্লী পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট সবুজ উপত্যাকাটার গেস্টহাউসে বসে মনে আছে মা বলেছিলো আচ্ছা এই গানগুলো কি আমাদের জন্যেই লেখা। আমরা মা মেয়ে সেদিন ওই সুর গুলোর মধ্যেই ধীরে ধীরে নিজেদের আস্তে আস্তে ফায়ার পেয়েছিলাম। যে অস্থিরতা আমাদের পারিপার্শিক কোনো কাজে মন বসাতে দিচ্ছিলনা, ধীরে ধীরে ওই সুরের প্রলেপ আবার আমাদের নিজ নিজ কর্মযজ্ঞে ফিরে যেতে সাহায্য করলো। তারপর দিন কেটেছে, কত ঘটনা, ঘটনাবলী, কত মানুষ , অভিজ্ঞতা আমাকে আমার বোধকে উন্নীত করে দিয়ে গেছে। কখনো আনন্দে মন উদ্বেল হয়ে গেয়ে উঠেছে, মম চিত্তে নীতি নৃত্যে,....আবার কখনো বা পারিপার্শিক আঘাত, অভিমান, প্রতিকূলতা আমাকে নিয়ে গেছে ছাদের কোণে , নিভৃতে গীতবিতান হাতে ফিরে পেয়েছি নিজেকে। দুজন মানুষ পাশাপাশি ই থাকুক বা থাকুক যোজন মাইল দূরে, মুখ যেখানে মৌন হয়ে, মন চায় মুখর হতে, সেখানে এই মানুষটার লেখনীর মাধ্যম ই অব্যক্ত বক্তব্য কে কতবার পৌঁছে দিয়েছে। মনের আবেগ তার আপন গভীরতায় যখন ভাষা হারিয়েছে, তখন বহুবার সেই অমিতর মতন কত লোককে বলতে হয়েছে, "বাণী দাও, বাণী দাও"...আমিও বলেছি, আশ্রয় নিয়েছি ওই লোকটার লেখনীতে। তাকে সেতু করে কখনো হয়েছে প্রেয়সীর সাথে চারিচক্ষুতে চাওয়ার ইচ্ছে। কখনো "সজনি সজনি রাধিকা লো
দেখ অবহুঁ চাহিয়া, পিনহ ঝটিত কুসুমহার, পিনহ নীল আঙিয়া। সুন্দরী সিন্দূর দেকে সীঁথি করহ রাঙিয়া।" শুনে লক্ষ দামামার শব্দ বেজে উঠেছে বুকে। কত "তৃষিতনয়ন ভানুসিংহ" হয়তো এখনো সত্যি ই কুঁচ্যপথে চেয়ে বসে আছে তার প্রেয়সী কখন জুঁই বেলি মল্লিকার ডালি সাজিয়ে আসবে তার জন্যে। কত প্রেমিক মন হয়তো আজকের দিনে বসেও বুনে চলে অজানা ভবিষ্যতের দিনে শান্তিনিকেতনের কোপাইকে সাক্ষী রেখে শান্তির নীড় রচনার স্বপ্নজাল। আর এই দাড়িওলা বুড়ো লোকটা যেন সেই প্রেমিক মন এর যুগলবন্ধীর মধ্যে সেতুবন্ধন করে কখনো খুঁজে দেয় আমাদের মধ্যের টগবগিয়ে ঘোড়ায় চড়া বীরপুরুষ বা গোড়ার উজ্জ্বল চরিত্র, কখনো বা সে অমিত এর মতো সৌখিনতার মোড়কে খুঁজে চলে কোনো লাবণ্যের সুনন্দিত রুচিশীল স্পর্শ অথবা যোগমায়ার মতন স্নেহময়ী মায়ের একটু ছোঁয়া।  
এখনও যখন কোনো ক্যানোর কোনো উত্তর পাওয়া যায়না, তখন মনে মনে আবৃত্তি করি "কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও, তার রাত নিত্যই উধাও/ জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন/ চক্র পিষ্টে আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন/ ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল জড়ায়ে ধৰিলো মোরে ফেরি তার জাল --"....এইভাবে রোগে, শোকে, দুঃখে, আনন্দে, প্রেমে, বিরহে কখন যেন কিভাবে সবকিছুর মধ্যে ওই সৃষ্টির মধ্যে আবর্তিত হতে থেকেছে আমাদের মন। শান্তি পেয়েছে তাতেই, আশ্রয় পেয়েছে তাতেই। অনন্য আনন্দে মন উঠেছে ভোরে, মনে হয়েছে "আনন্দধারা বহিছে ভুবনে" , কি ব্যাপ্তি, কি শান্তি আর কি অসাধারন বার্তা এর ছত্রে ছত্রে  যখন শুনি "বসিয়া আছ কেন আপন-মনে, স্বার্থ নিমগন কী কারণে।
চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারি, ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি।
প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে।" সত্যি ই যেন এক পুণ্য ইচ্ছা এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বোধিপ্রাপ্ত হই।   আর এমন করেই বহুবার বহুকারণে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি তে , নিজের ই দায়ে থমকে দাঁড়িয়েছি ওই অসীম সৃষ্টির সামনে, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেছে বারবার। রবীন্দ্রনাথ হয়তো আমার প্রতিদিনের দৈনন্দিন জীবনের সাথে এক এবং অদ্বিতীয় ভাবে সচেতন ভাবে জড়িয়ে নেই, কিন্তু যখন চারপাশের অসহিষ্ণুতা, অপ্রীতিকর ঘটনা, অশালীনতা, চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অপ সংস্কৃতীর হাত থেকে আমাদের বাঁচতে হয়, তখন ওই বিরাট মঙ্গলময় সৃষ্টি জলে স্নান করে নিজেকে স্নিগ্ধ করার জন্যে বারবার তাঁর কাছে ফিরে যেতে হয়। তাই বারবার হয়তো নিজের আমিত্ব কে রক্ষার জন্যেই, নিজের স্বার্থেই বারংবার তার কাছে ফিরে যাই, আর বলি "হে নুতন দেখা দিক আর বার জন্মের ও প্রথম ও শুভক্ষণ " যে মহাজন্ম আমাদের বিশ্বসংসার কে আলোড়িত করে তুলেছে, আমাদের প্রতিদিনের বোধ কে উন্নীত করেছে এক অমোঘ শুভ কামনা দিয়ে, আমাদের মানব জন্ম কে সার্থক করার এমন ইঙ্গিত, এমন মঙ্গল ময় শান্তির বার্তা যে দিয়ে গেছে , সে মহা আবির্ভাব ফিরে আসুক বারংবার। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সমস্ত অসুন্দরকে সুন্দর দিয়ে ভরিয়ে তুলি। নাহয় কল্পনার তুলিতে প্রকৃতির রঙে ডুবিয়ে তাকে জীবনের রূপ রস লাবণ্যে ভরিয়ে তোলার জন্যেই থাকো, কিন্তু থাকো আমাদের মর্মে, মননে , জ্ঞানে, অজ্ঞানে , সত্যি আর স্বপ্নে। 






Monday, 22 April 2019

Journey

I went to UNESCO New Delhi office on some days before to meet Dr. Nandini. It was just about taking a signature and some discussion but it took probably longer than I have thought of. While discussing she suddenly told me 'teesta hold your attitude always. I like your attitude, this boldness, very much'. 
I was a bit embarrassed. Why suddenly? I looked at her. I admire her a lot. She is a celebrity scientist. No, obviously I don't admire her because of her celeb image or not because of that she spends her holidays at most expensive places in the world. But yes, she is the one who has proved that if you go with your passion, you will get the reward back. I have learned from her that being a good scientist doesn't mean that you have to let all your dreams go, it doesn't mean that you cannot be a good mother, it doesn't mean that you cannot have wonderful family. Rather she always showed the way to lead a family life and of course celebrate life. In each big or small issues, celebration. Which unknowingly I also started following. No, for me celebration doesn't mean to go to expensive places or some big restaurant or open up drinks. But celebration..even going to eat fuchka or listening to music or dancing in your own way or simply sitting silently at one place can be a celebration for me but yes, I do celebrate. In my own way but each big or small issues of our daily lives, I try to celebrate. 
We cannot get everything that wishes for in one life but what we can do that is we can cherish each moment of our life. Like that, end of the journey probably only good memories will be there and all the bad would fade away. Today something is going worse doesn't mean that yesterday's good memories have no meaning. Therefore not to worry for future good things are getting stored there. No, nobody teaches me all these but sometimes we get to think on some lifestyle, being inspired by some lifestyle. In some of this point, she comes. She also kept her footprint with many more other personalities in the way of my destination. 

For another reason I admire her. This is quite a realistic reason and not to be ignored too. When most of the people leave science, leave academic platform because of money, in that scenario, she proves science also can make you rich and in India itself. When most of the people suffer, struggles and finally left country because lack of chance, money, opportunities, then she is earning 10 lakh per month sitting nowhere but in our home country. She showed that no one cannot ignore money but at the same time no one also should never ignore own passion too. Another thing, I have learned that is you should be strict to your dream, to your passion too. Sometimes, we often frequently change our hobbies, our passions, our commitment and so on but that probably bring us no where. Passion needs sacrifice too.  And today, she kept on telling me, "always remember your journey,  your own struggle, that will make you more confident." Probably, she became a little emotional. She said "I still remember that shy, timid, emotional girl who has become today's bold, beautiful, smart, confident Teesta. When I see you, I really become proud of you and I do admire you." and then on a little low voice she told "I have heard that you fought with somebody in the last meeting". I was embarrassed. It was actually a long argument in support of my analyzed data. She laughed and said "be like this, do argue, let the world prove you wrong, take the critics, make your own improvement but fight but yes be open enough so that you can make your own improvement too".
I was happy while leaving her place. A bit satisfied too. Probably, inside us, we all have kept seating a small kid who likes to be appreciated. 
Her words made me walk in the down memory lane. 2011, when on an all sudden I was being put a completely empty world. Suddenly found that there was no person to whom I can jump with my all nonsense work or talk anything and everything in the world. No words can put my emotions in the right way except emptiness. It was actually difficult for me to stay in the same place where everything was at it was except one person. My Baba. It seemed all the world stopped. 

I left kolkata. Got a chance to work at NBRC.  Left my comfort zone and then started a new life where I had to prove myself in every step. In every step I was being forced to think that I don't know anything, in every step I had to feel inferior about my English speaking, about my pronunciations, writing, lab techniques, Bengali schooling, not being from Presidency college or St. Xaviours' (because people think that only these two places outstands other places are too low to carry academia). Humiliations after humiliations. I have been humiliated for my innocence, for being too simple, for not understanding complexity, hypocrisy, and so on. I have almost no memory in that first one year of NBRC. Rather only lab and room but today while seating inside the car in this rainy stormy morning, I looked back and found everything of that place actually helped me to heal my wound. Those silent nights, shiny morning, green trees, moonlight craze, winter's bugenvelia, spring's Palash, summer's Champa slowly took me away from my pain, engorged me into their beauty. I started taking the sole essence from every single thing. I started loving my life again. I realized the presence of my baba in every single incident. I started living again. I started doing everything whatever my baba wished me to do. Read, worked, played badminton, basketball, learned violin, yoga, listened to silence, helped others. I worked and worked crazily. 

Sometimes in very depressing moments I thought to quit. Almost moneyless, humiliated situations. How could I lead a quality life? All alone. but on those starry nights, I asked myself, what do I want in life. I asked and asked. Got answers. Slow, slow, slow. Be patient. Your time will speak. Wait for your time. Try to listen that. Be ready. Be prepared. amar babar katha. My father used to say those words and some from Sanjib Chattopadhyay's writing. oi katha gulo mone mone abriti kortam. I keep reciting those words. By that time, most of my friends, those are girls, got married. Some of them had kids. Many of our friends, those are men, bought cars, new home, house loan or started staying abroad. I too got position in Canada. Without applying on a sudden, opportunity came. I could have moved away. Everybody asked me to go there except for my own instincts. I felt not to move out but prove myself from here only. Another thing pulled me here, Arnab. No not for obstructing my way, of course, he himself forced me the most to go to Canada. Even till now he blamed me for not going there but I felt I should be right here. I shouldn't go far from him because at that time he was depressed, distorted, unsettled and asthir. asthir is the right word. He also got some of the good jobs at Biorad, premas biotech etc at Gurgaon, where it was 40,000 month starting. In a moneyless situation, it could be huge for him but I knew his dream, so asked him to think and to think a lot but not to take any immediate job. I told him the same thing which I do believe. Slow. Be slow you will be steady. I clearly remember what he said and probably will remember forever. He said ..'but I have nothing, not home, not car, not even money to lead daily life, now everything seems okay for you but how long you will wait for me, one day you will get bored and things will get changed.' I smiled and didn't answer anything. I knew time speaks. year passes. time changes. Four years later in 2014, we got married. I didn't let myself changed. year passes. its 2018 now.  When my research work got media coverage at Hindustan Times, I remembered those days when people laughed at my schooling, questioned my skills. Time changes. Attitude changes. Throughout all those years, probably in a litteral sense, that shyness turns into boldness. The experience made me more confident. and beautiful? No, I never cared for that and never bothered too. While traveling, I see all the faces around me with full of makeup masks. mapa hasi, mapa katha. Sometimes I feel everybody is just running for selling themselves. irrespective of man or woman but everybody. Living in a fake showy selfish world. Competing with surroundings, not ready to give a single space even to own shadow. Those times, yes, I do feel proud. Proud to see me not in that gathering. ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে যে যাইনি, এটা খুঁজে পেয়ে স্বস্তি হয়। and therez my journey come along, keep me steady but down to earth, proud but humble, free but rooted, soft but no one can break me down. I love me, I love my self so much that I can love every single person around. :)

Thursday, 4 April 2019

পাঁচ নারীর জীবন কথা

লেখাটা শুরু করেছিলাম international womens day বিশ্ব নারী দিবস এর দিনে। যদিও কোনো কিছুকেই সম্মান বা পালন করার জন্যে যে শুধু বছরের একটা দিন ই বরাদ্দ এ আমি নিজে খুব একটা বিশ্বাস করিনা। তবে সমগ্র বিশ্ববাসির বিশ্বাস কে হেলায় উড়িয়ে দেব এ হেন অহংকার ও আমার নেই। তাই সেই ভাবনা কে সম্মান জানিয়ে আমি সুযোগ নিলাম আমার জীবনে উল্লেখ যোগ্য কয়েকজন নারী, যাদের জন্যে কোনো সময়ের এক নাক দিয়ে সর্দি পড়া , ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদা ছোট্ট কোঁকড়া ঝাঁকড়া চুলের কোনো এক মেয়ে আজকে কলমের এক আঁচড়ে অনেক কিছু বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছে, তাদের অনস্বীকার্য অবদানকে স্মরণ করার। এখন কথা হচ্ছে এই যে আমার চারপাশের মানুষের কাহিনী আমায় হটাৎ কেন বলতে শুরু করলাম। কি জানেন, এই রাজধানীর বুকে কাটিয়ে দিয়েছি প্রায় ৮টি বছর। রাস্তায় ঘাটে, অফিস আদালতে, নিজের কাজের জায়গাতে অনেক ভালো অভিজ্ঞাতা আমার নিশ্চই হয়েছে, তবু তার সাথে সাথে বারবার এত অসহিষুতা দেখেছি, যার থেকে আমার একটা কথাই খুব মনে হয়েছে। শিক্ষা, আদর্শ, মূল্যবোধ এই সব কথা গুলো শুধু মাত্র বইয়ের পাতার কতগুলো শব্দ নয়, যত্ন করে তাকে রক্তের সাথে মিশিয়ে দিতে হয়, আর তখন যখন একজন ছেলে বা মেয়ে বড় হয়ে ওঠে। তাকে তার লক্ষ্য থেকে মাথা উঁচু করে বাঁচা থেকে কেউ সরাতে পারেনা, ডিগ্রী কখনো কাউকে প্রকৃত শিখিও করতে পারেনা, প্রকৃত শিক্ষা করে এই যে শব্দ গুলো বললাম, এর বোধ গুলো। আর তখন ভিড় করে আসে আমার নিজের ছেলেবেলা, যখন আমার চারপাশের মানুষেরা আমার অজান্তে, হয়তো বা তাদের নিজের ও অজান্তে আমাকে মানুষ করে তোলার কর্মযজ্ঞে মেতে ছিলেন। এদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য মানুষটি আমার বাবা, কিন্তু তার কথা কোনো এক পাঠ্যে তো নয় ই আমার এক জীবনেও আমি সবটুকু বুঝে বলে উঠতে পারবো কিনা সন্দেহ। তাই সেই চেষ্টা না করে ওই যে বললাম, নারী দিবস। সেই পঞ্চনারীর কাহিনীতে আসি।  ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠাতে একের পর এক ভিড় করে আছে কত মুখ। তার মধ্যে শুধু কয়েকজনকে বেছে নেওয়া সত্যি ই কঠিন।
তবু স্মৃতির ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে তুলে বয়সের ক্রমানুসারে তাকে একটু এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাজিয়ে নিলে প্রথমেই মনে আসে এক মাথা সাদা চুলে ভরা সবসময় মুখে একটা মিষ্টি হাসি মাখা পুতুল পুতুল এই মানুষটির। আমার পিসিমা। আমি শুধু পিসি বলেই ডাকি অবশ্য। অবিশ্বাস্য কথা কি জানেন, এই মানুষটিকে আজ পর্যন্ত কেউ কখনো রাগা তো দূরের কথা, উঁচু গলায় কথা বলতেও শোনেনি। পিসির কথা মনে হলেই তাই আমার মাতা বসুধার কথা মনে হয়। না এতটুকু বাড়িয়ে বলছিনা। ধরিত্রীর মতোই অসীম সহনশীলতা তাঁর। আলাদা করে সেরকম বিশেষ করে বকে ঝকে কিছু শেখাতে আসেননি উনি। তবে পিসির ওই ধীর কথা, স্থিরতা, ধৈর্য্য, স্নেহ মায়ায় ভরা কাজ, অকুন্ঠ ভাবে ভালোবাসা এইসব কখন যে কিভাবে অজান্তে আমার ভেতরে আমার ই অজান্তে একদম গেঁথে গ্যাছে বুঝতে পারিনি। আর ও একটা জিনিস এর জন্যে এই মানুষটা সবার শ্রধ্যেয়। সেটা হলো জানার তৃষ্ণা আর মনসংযোগ। এখনো সারাদিন এর সব কাজ নিজে হাতে করার পরে , রাতের বেলায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পরে , বই পরে , ভূগোলের ম্যাপ দ্যাখে , তারপরে শুতে যায়। আমি যখন বকি খুব কেন রেস্ট নাওনা এসব বলি, তখন বলে, সময় তো কমে আসছে, যতটা জেনে বুঝে নেওয়া যায়, কতটা তো এখনো বাকি। এই হলো আমার পিসি। আমরা যারা এই প্রজন্মের facebook , tinder, বিশ্ব সংবাদ এর দুনিয়াতে পুরো একটা পাতা টানা মন দিয়ে পড়ার ধৈর্য্য রাখিনা, সেই খানে ৭২ বছরের এই মানুষটি এখনো রান্না করে, যত্ন করে বাগান করে, গাছ গুলোকে নিজের ছেলে মেয়েকে মানুষ করার মতো করেই বারো করে, ফুল ফোটায়, আমার আদরের কুট্টুস মানে ঘঁটুবুড়ি কে দেখা শোনা করে, ছেলে বৌ নাতনি নিয়ে সংসার এর হাল ধরে শুধু নয়, শক্ত হাতে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পিসি মানেই সাদা হাস্যময় একটা মুখ, কোনো বিরক্তি নেই, কারোর কাছে কোনো প্রত্যাশা নেই, শুধু ভীষণ কৰ্তব্য বোধ আর ভালোবাসা। তাঁর এই ভালোবাসা থেকে ছেলে মেয়ে ভাইপো ভাইঝি থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী, রাস্তার কুকুর বিড়াল কেউ ই কখনো বঞ্চিত হয়নি। এই প্রসঙ্গে অনেক দিন আগের একটা কথা খুব এখানে লিখতে ইচ্ছে করছে। আমি তখন মাস্টার্স করছি gwalior থেকে। বাড়িতে থাকিনা। বাবা, মা ও নিজের নিজের কাজের জগতে ব্যস্ত। পিসি সদ্য retire করেছে, দু দিনের জন্যে খুব সম্ভাবত আমার ছোট পিসিমণির বাড়ি গেছিলো বেড়াতে। বাড়িতে ছিল তখন দাদা আর ভাই। দুজনেই বড়ো, ফলে মা বাড়িতে না থাকায় কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়, বরং নিজের পছন্দ মতো খাবার রান্না করে খাওয়া যাবে, এতে বেশ আনন্দই ছিল এদের মনে। অসুবিধে কারোর ই কোথাও হবার কথা ছিলোনা। কিন্তু অসুবিধে হয়েছিল একজনের। আমাদের পাশের বাড়িতে কোনো এক সময় শখের বশে একটি রাস্তার কুকুরকে পোষা হয়েছিল, পরে তাঁরা একটি বড় আলসেশিয়ান পুষলেন এবং যথারীতি বিদেশী অতিথির সামনে বুড়ো দেশী পশুটি ভীষণ ভাবে ব্রাত্য লাগলো। ওনারা তাঁকে বিদায় পুরোপুরি না দিলেও, চলে গেলে যে ভালো হয় সেটা বুঝিয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি। অবহেলা বোঝার ক্ষমতা সবার ই বোধহয় আছে, সেই অবহেলা এমন অভিমান এর জন্ম দিলো যে সারমেয় টি একটু একটু করে প্রথমে কম করতে করতে একেবারেই ওই বাড়ির অন্ন ত্যাগ দিলো। আমাদের বাড়িতে তখন আমার ছোটবেলার সাথী কুট্টুস, আদুরে সবার চোখের মণি। এ হেনো কুট্টুসের সাথে ওই অভাগীর কিভাবে গড়ে উঠলো এক অলিখিত সম্পর্ক। কুট্টুস থাকতো গেট এর এপারে আর ও থাকতো গেট এর ওপারে, কুট্টুস কে খাবার দেবার সময় হলে, মা বা পিসির কেমন একটা খারাপ লাগতো, ওকেও তখন দেওয়া হতো, প্রথম প্রথম সেই খাবার ও কিন্তু ও মুখ দিতোনা, পরে কিজানি দু বন্ধুর কি কথা হলো, কুট্টুস খেত এদিকে আর ও খেত ওদিকে। আস্তে আস্তে গেট এর barrier গোছানো হলো, কুট্টুসের নতুন বন্ধু স্থান পেলো বাড়ির ভেতরেই। এভাবে চলতে থাকলো, তবে পুরোনো প্রভুদেরও ও ভোলেনি, কর্তব্য করতে যেত প্রতিদিন ওখানে, দেখে আবার চলে আসতো। বেশ কয়েকবছর এভাবে কাটছিলো, বয়সের জন্যে ধীরে ভুলুর জীবনীশক্তি কমতে থাকে, অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বেশ। পিসি না থাকাকালীন অসুস্থতা খুব বেশি বাড়ে। কিন্তু শুধু বুঝি ওই মমত্ব মাখা হাতের আদরটার জন্যে শেষ নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করতে পারছিলোনা। যেদিন পিসি ফিরলো, সেইদিন ই ভুলু কোনোরকমে টলতে টলতে গেট এ এসে দাঁড়ালো, কুট্টুস এর অদ্ভুত ডাকে পিসির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো পিসি, ভুলু টলতে টলতে এসে দাঁড়ালো, দাঁড়ানোর শক্তিও ছিলোনা, পিসি ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই ও শুয়ে পড়েছিল আর অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে তারপর চিরদিনের জন্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। জীবনে অনেক ঘটনাই থাকে আমাদের জানার আমাদের বোঝার বাইরে, এও সেরকম ই একটা ঘটনা যেখানে প্রিয় মানুষের হাতের ছোঁয়া টার জন্যে ছিল একটা অবলা প্রাণের অপেক্ষা।
এই হচ্ছেন আমার পিসি। একদম বইয়ের পাতাতে যেমন পিসিদের গল্প শোনা যায় ঠিক সেরকম। ছোটবেলার রথ, চড়ক এর মেলা বা ঠাকুর দেখতে যাওয়া আমাদের ছোটদের এনার ই হাতে ধরে হয়েছে। সেই ছোটরা এখন সবাই অনেক বড় হয়ে গেছে , ভাইঝি রা তাঁর প্রাণের খুব কাছের। সেই দুই ভাইঝি ও একজন থাকে কানাডায়, একজন দিল্লী। বড় টির কথা পরে বলছি কিন্তু ছোট টিও বিয়ের পর থেকে এতই সংসারী হয়েছেন যে দুদণ্ড বাড়িতে এসে পিসির কাছে বসে কথা বলার তেনার সময় হয়না। একটা কথা খুব মনে পড়ছে এখন লিখতে গিয়ে, সেবারে যখন বাড়ি গেছিলাম, পিসি কেমন ভাবে একটা বলেছিলো, একটু আসবি আমার কাছে, কথা বলবো। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠেছিল। এখনো উঠলো। এইসব পিসি মাসি মা দিদিদের আদরের আবডালে বড় হয়ে ওঠা ছেলেবেলাটা যেন বারো বেশি নিশ্চিন্তে কেটেছে। তবু ওই যে মায়ার ওই বাঁধন ই আবার শিখিয়েছে সবাইকে বেঁধে রাখার মন্ত্র। আর সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই কর্ম কর্তব্যে অনড় থেকে এগিয়ে চলা। আমার বাবা পিসির ছোটবেলা আমাদের মতো সুখের আবডালে মোড়া ছিলোনা, সবদিন পেট ভর্তি ভাত ও সবসময় যে জুটতো তা নয়, শুধু আধপেটা খেয়ে বা না খেয়ে একটা কথাকেই দুভাই বোনে পণ করেছিলেন যে পড়াশুনা টা চালিয়ে যেতে হবে। গিয়েছিলেন। তখন নকশাল আমল। আমার পিসিমা সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে স্কুল কলেজ এর গন্ডি পেরিয়ে ইতিহাসের শিক্ষকতা নিলেন। কিন্তু নকশাল আমলের ওই উত্তেজনার মধ্যে একা যাতায়াত করার অসুবিধের কারণে তাঁর সুযোগ্য ভাই সেকালের লক্ষণ ভাই এর মতোন ই পিতৃক ভিটে ছেড়ে দিদির সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে এসে বসবাস শুরু করতে লাগলেন দিদির ই স্কুল এর খুব কাছে। অচিরেই দুই ভাই বোন তাঁদের স্বভাব সুন্দর প্রকৃতি দিয়ে চারপাশের মানুষ জনকে এক মায়ার বন্ধনে বেঁধে ফেললেন, শুরু হলো তাঁদের অপরকে স্বাক্ষর করার অভিযান। আশপাশের মানুষ জন দের ভালো রাখার প্রচেষ্টা, গ্রামের সবাইকে শিক্ষার আলো দেখানো, আর সেই আলোতে কিছুটা হলেও উন্নয়নের হাওয়া লেগেছিলো বৈকি, আমাদের ওই ছোট্ট রঘুদেববাটী বলে নলপুর এর জায়গাটাতে। অবশ্য ছোট ছোট ওই দু ভাই বোন এর সেই অভিযানের মূল কর্ণধার ছিলেন, একজন অত্যন্ত শ্রধ্যেয় মানুষ (পরবর্তী কালে আমার পিসেমশাই), যাঁকে ওই এলাকার আপামর জনতা মাষ্টারমশাই বলেই চিনতো।
কিছুদিন পরে তাঁদের সংসারে আরো একজন এলেন, আমার পিসির সুদর্শন ভাইটিকে ভালোবেসে, স্বইচ্ছাতে, সরকারি নার্স এর চাকরির চিঠি লুকিয়ে, কিছুটা মা বাবাকে জোর করিয়ে রাজি করিয়ে, হাজারটা তথাকথিত সুপাত্রকে হেলায় সরিয়ে, ভাই বোনের কিছুটা অগোছালো অভাবের সংসারে বিয়ে করে। অভাব এই কারণে তখন স্কুল টিচেরদের এখনকার মতন স্বচ্ছল মাইনে ছিলোনা। আর চাকরির চিঠি লুকিয়ে এই কারণে যে নার্সের ওই চাকুরীতে তখন তিন বছরে বিয়ে না করার শর্ত ছিল। বোকামি? তা হয়তো বা, কিন্তু পৃথিবীতে এখনো ঐরকম কিছু বোকা আছে বলে এই পৃথিবাটা এখনো ফলে ফুলে রঙে রসে ভোরে আছে। যাই হোক, তিনিতো এলেন, চুঁচুড়ার ইলেক্ট্রিক আলো, যানবাহনের আওয়াজ আর শহুরে আর পাঁচটা সুযোগ সুবিধে ছেড়ে, একেবারে খোদ গ্রাম বাংলায় দু ভাই বোনের কোনোরকমে চলা, অগোছালো এক সংসারের মধ্যে। বাপের বাড়ির আদুরে গাছে চড়া মেয়ে অভাব কাকে বলে জানতো, আর জানতো সেই অভাবে কিকরে স্থির থেকে সংসার চালাতে হয়, ফলে হাল ধরতে দেরি হলোনা। শুধু যে হাল ই ধরলো তাই নয়, একদম গুছিয়ে, শ্বশুর শাশুড়ি স্বামী ননদ নন্দাই নিয়ে সবার প্রিয় পাত্রী হয়ে সংসার শুরু করলেন। ততদিনে চাকুরীর চিঠিটি ধরা পরে গেছে। সবার থেকে জুটেছে একরাশ বকুনিও। তিনি বললেন ভাবছো কেন চাকরি নিনি তো কি হয়েছে, নার্সিং ট্রেনিং আর Dr Nun এর কাছে করা OT experience ব্যর্থ যেতে দেব নাকি? সেই গ্রামের মধ্যে তখন ডাক্তার বদ্যির ভীষণ অভাব। গ্রামের অসহায় বিনা চিকিৎসাতে মারা যাওয়া মানুষ গুলোর কাছে তাই সেই নববধূ হয়ে উঠলেন এক অনন্য জায়গা, যেখানে দিন নেই রাত নেই যখন ইচ্ছে ছেলে কোলে করে আসা যায়, ডাক্তার বাবু আসার আগে প্রিলিমিনারি ফার্স্ট এইড টা তো পাওয়া যাবে। ফলে মাথা ফাটা থেকে ডেলিভারি সব এ তেই ডাক আসতে লাগলো। আর এইভাবে ঠেকনো দিতে দিতে বুদ্ধিমতী বধূটি তাঁদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার বোধ, খাবার ঢাকা দিয়ে রাখা, বাচ্চার যত্ন নেওয়া, এইসমস্ত basic hygene concept .। সাথে সাথে চলতে থাকলো সংসার কে একটা সত্যিকারের সংসারের রূপ দেওয়া। বাইরে থেকে কেউ এলে অবাক হয়ে যেত। ঘরের মধ্যে আসবাবের প্রাচুর্য্য নেই, হয়তো বা আছে কিছু অভাবের ই ছোঁয়া, কিন্তু তার মধ্যেও কি পরিপাটি বিছানার চাদর। টেবিল এর ওপরে ফুলদানিতে একরাশ ফুল। শুনেছি প্রথম দিকে ওই টেবিল টাও যখন ছিলোনা, তখন মাটি আর কিসব দিয়ে যেন নিজেই টেবিল বানিয়ে ফেলেছিলেন, পাউডার এর কৌটোতে জল দিয়ে তাতে রাখা হতো কখনো কৃষ্ণচূড়া, কখনো গন্ধরাজ। দেখতে দেখতে দিন এগোয়। সেদিনের সেই নববধূ সমাদৃত হন মাতৃত্বে। আমার মা। ছুটির দুপুরবেলা গুলোতে যখন মা স্নান সেরে চুল খুলে চওড়া করে সিঁদুর পরে পরিপাটি করে ভাত বাড়তে বসত, আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম মুখের দিকে। আর মনে মনে বলতাম আমার বাবা আর মা দুজনে যেন ঠিক ঠাকুরের মতন। ভরা সংসারে মা এর তখন অনেক কাজ। একাধারে নার্স, শিক্ষিকা, মা, মামীমা, লেখিকা, আঁকিয়ে সমস্ত কিছু। শ্বশুড় শাশুড়ির শরীর নিয়েও তাঁর ছিল মহা সজাগ দৃষ্টি। আমার ঠাকুরদা তাঁকে নিজের মেয়ের থেকেও বোধয় বেশি ভালো বাসতেন , এই ছবিটা আমার হালকা ভাবে মনে পরে যে দাদু আমাদের নখ কেটে দিতে দিতে বাবাকে আর মা কে ডাকছেন, বৌমা এসো তো তোমাদের নখ গুলো কেটেদি। এ হেনো দাদুও চলে গেলেন, তখন আমি ক্লাস ২ তে, এক সপ্তাহের অন্তরে চলে গেলেন পিসেমশাই ও। যাঁকে বাবা মা দেবতা জ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন। সেই সময় যখন লোকে আমার পিসতুতো দাদা আর ভাই কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলছে ওরে তোদের কি হলো রে, আমার মা শক্ত হাতে চোখের জল মুছে নিয়ে, বাবা পিসি সবাইকে সামলে নিয়ে আমাদের চার ভাই বোন কে একসাথে মানুষ করেছেন। মা কিন্তু কখনো বলেনি তোদের কি হলো, মা বরং বলেছে তোদের মানুষ হবার সুযোগ এসেছে। তোরা যাদের ছেলে, তাদের মতন নিজেকে তৈরি করতে হবে। ছোটবেলায় হয়তো সেই কারণেই মাকে আমরা চার ভাই বোনে পেয়েছি ভীষণ কড়া একজন মানুষ হিসেবে। নিয়মে বাঁধা ছিল আমাদের জীবন। শুধু ভালো পড়াশুনো নয়, মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। এতটুকু রুডলি কথা বলার সাহস ছিলোনা কারোর। বাড়িতে অনেকটা সময় কাটতো আমার একা একা। মা মনের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন ছবি আঁকা, ডাইরি লেখা, নিজের কাজ নিজে করার অভ্যেস। নিজে নিজেই রুটিন বানাতাম গোটা দিনের। কখন তার মধ্যে নিজেকে ফিট করে ফেলতাম। দিদি অবশ্য একটু অন্যরকম ছিল, ওর ছিল গল্পের বই পড়ার নেশা। আমাকে ক্ষেপাত পুরো ল্যাজবিশিষ্ট ভালো মেয়ে। বাবা মা যা বলে তাই করে। রুটিন বানাতে কে বললো রে তোকে। সত্যি ই কেন যে আমার রুটিন এত ভালো লাগতো জানিনা।  মাঝেমাঝে মা এর অত্যধিক কড়া শাসনে দম বন্ধ হয়ে আসতো। কেমন সবাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারে, দেরি করে বাড়ি ফেরে, অথচ আমাদের ক্ষেত্রে তো সেই নিয়ম নেই। মা এর ছিল সব কিছু হিসেবে বাঁধা। সেই কড়া শাসনের একটা নমুনা দিচ্ছি, আমি তখন higher secondery  পরীক্ষা দিচ্ছি। লাস্ট দিনে মা যাবেনা, আর আমি ফুচকা খেয়ে ফিরবো। ডিল কমপ্লিট। মা ও রাজি। ফুচকা খাবার অনুমতি তখন ছিল ঠিক বছরে দুবার। একবার half yearly আর একবার annualy . যাই হোক, ফুচকাও খেলাম, গল্প ও করলাম। বন্ধু বান্ধব হাসি ঠাট্টায় যে সময়ে ফিরি, তার থেকে দেরি হয়ে গেলো প্রায় ৪০মিন. ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরলাম। এসে দেখি গেট এ তালা দেওয়া ভেতর থেকে মা বলছে যাও যেখানে ছিলে থাকো সেখানেই। পাড়ার লোকে হাসতে হাসতে দেখে দেখে গেলো রঞ্জিত বাবুর সাত চড়ে রা না কারা, তথাকথিত ভালো ছোট মেয়েটি স্কুলের শাড়ি পরে, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ভ্যা ভ্যা করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। অবশেষে বাবার হস্তক্ষেপে ভেতরে ঢোকা। ছোটবেলাতে অনেক অভিযোগ ছিল মায়ের প্রতি। মনে হতো মা তাদের স্কুলের ছেলে মেদের বেশি ভালোবাসে, কতবার মনে হয়েছে, সবার মা এরা কেমন বলে আমার মেয়ে তো কিছু কাজ করতে পারেনা, বা ও এক গ্লাস গড়িয়ে খেতে পারেনা। এইসব। সেখানে আমার মা এর ছিল কড়া নিয়ম। আমাদের বলা হতো তোমরা কেউ গাছতলাতেও থাকবেনা আবার হোটেলেও থাকবেনা, থাকতে হবে তোমাদের সংসারেই অতএব, আমি ইটা পারিনা ওটা পারিনা বা ইটা খাইনা, ওটা খাইনা, এইসব ন্যাকামো একদম করবেন আমার কাছে। আমরা দুবোনেই যখন ক্লাস সিক্স, জেনে গেছিলাম কিভাবে ডিম্ ভাজতে হয়, চা করতে হয় এইসব। রান্না, পড়াশুনা, আঁকা আবৃতি সব কিছু বাড়িতেই করেছি। আর একটা জিনিস শিখেছিলাম মার্ কাছে, যা আমাকে আমার বর্তমান দৈনন্দিন জীবনে ভীষণ সাহায্য করে। সেটা হলো মায়ের পরিপাটি বোধ, শুধু কাজ করলেই হবেনা, সেটাকে সুন্দরভাবে সুষ্ঠু ভাবে করতে হবে। ভাত বাড়া থেকে শুরু করে কিভাবে খাবার পরিবেশন করতে হয় বা কিসের পরে কি পদ কিভাবে সাজিয়ে রাখতে হয়, এসব মায়ের নিজের হাতে শেখানো। এমনকি বাইরে থেকে বাড়ি ঢুকে পায়ের জুতো খুলে সেটা জায়গায় রাখলাম নাকি তাকে ছড়িয়ে ফেলে রাখলাম সে ব্যাপারে ও মায়ের দৃষ্টি ছিল সজাগ। আর একটা ব্যাপারে মা ছিলেন সেকেলে, সেটা ছিল ছেলে মেয়ের অবাধ মেলামেশার ব্যাপারে মায়ের ছিল প্রবল আপত্তি। তবু, বড় হওয়ার সাথে সাথে বন্ধু বান্ধব এর সংখ্যা বাড়তে থাকে আমাদের, মা এর কড়া নিয়ম ছিল দুটোতে, এক রাস্তায় দাঁড়িয়ে কারোর সাথে গল্প করা চলবেনা আর দুই যদি কথা বলার দরকার ই থাকেন তাহলে বাড়িতে সবার সাথে সবার মাঝেই যা বলার বলতে হবে। তখন নতুন বন্ধু, নতুন প্রেম, সবসময় ই আবডাল খোঁজে মন। এমন সময়ে এহেন শাসনে যে সদ্য কিশোর কিশোরী মন গুলো বিদ্রোহী হয়ে উঠতো, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু আজ যখন পেছনে ফিরে তাকাই, বুঝতে পারি, সেদিনের সেই শাসনের মাহাত্ব। এইভাবে মা সামনে থেকে বা না থেকে কিভাবে আর কিকরে যেন আমাদের মধ্যে এক কর্মঠ, সক্রিয় , রুচিশীল আর শিক্ষিত মনন তৈরি করে দিয়েছেন, বুঝতেই পারিনি তখন। মাথার মধ্যে সবসময় ঘুরতো নিজের পায়ে দাড়াঁতে হবে, কিন্তু সেটা মাথা উঁচু করে আর শিক্ষাই হচ্ছে তার একমাত্র উপায়। বাড়ির বাইরে থাকতে হলো পড়াশুনার জন্যে, তখন দেখলাম কিভাবে মা এর শাসন অলক্ষ্যে আমাদের ঘিরে রাখে, অবাক হয়ে যেতাম নিজেকে দেখেই যখন দেখতাম মা সামনে নেই তবুও দু পা হেঁটে সিনেমা হল এ যেতে পারছিনা। ফোন করে অনুমতি নিয়ে তবে যেতাম। সত্যি বলতে কি মা কে একটু ভয় এর চোখেই দেখতাম। লেপটে থাকতাম আমি বাবার সাথে। সবসময় বাবা, বাবা আর বাবা। তবে পরে বুঝেছি, আমার বাবাও তাঁর সবটুকু মাহাত্ব নিয়ে কখনো হয়তো ঐভাবে থাকতে পারতেননা। যদি না মা এর তাঁর পাশে থাকতো। সেই বাবা যখন আমাদেরকে একেবারে অসহায় করে দিয়ে চলে গেল, সমস্ত দুনিয়া আমার চোখের সামনে সত্যি ই দুলে উঠেছিল। কথার কথা নয়, সেদিন বুঝেছিলাম পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া কাকে বলে। আমার মা কিন্তু নিজের স্বার্থের জন্যে একবারও আমাকে আটকে রাখেনি, একমাসের মধ্যে আমাকে নিজে সঙ্গে করে ইন্টারভিউ দিতে দিল্লী নিয়ে আসে। আর চার মাস পার থেকে একা আমার বাবার স্বপ্ন কে পূরণ করার কাজে নিজেকে নিমজ্জিত করে। আমার আর মা এর শুরু হয়েছিল সেই সময় থেকে একেবারে অন্য এক জীবনযাত্রা। আমাকে বাবা সত্যি ই প্রায় তুলো য় মুড়ে বড় করেছিল। সেখান থেকে বাস্তবের কাঠিন্য আমাকে কিছুই দেখতে হয়নি। পেতেও হয়নি তার ছোঁয়া। দায়িত্ব কাকে বলে জানতামনা। কিন্তু দেখলাম আমিও দায়িত্ব নিতে পারছি, অসুবিধে হচ্ছেনা সেগুলোকে সুষ্ঠু ভাবে পালন করতে আর আমাকে, মাকে এসবকিছুর মধ্যে সামলে রেখেছিলেন অন্য আর পাঁচজনের সঙ্গে আরো একজন মহিলা, সে হলো আমার বড় মাসি।
সবাই বলে আমি নাকি মাসির মতো শান্ত। হাঁ এই মানুষটিও আমার পিসিমার্ মতন ই শান্ত প্রায়। শুধু যে শান্ত তাই নয়, ভীষণ স্বপ্ন আর আবেগ প্রবণ। গাছের কচিপাতা দেখলে আমার যেমন ভালোলাগায় চোখে জল ভোরে যায়, আমার মাসিটিও তেমন ই। বাবা চলে যাবার পরে যখন কিছুতেই নিজেদের স্থির রাখতে পারছিলামনা, এই মানুষটি তখন কখনো গীতার উধৃতি তুলে, কখনো রামকৃষ্ণ সারদা মা এর উদ্ধৃতি তুলে কখনো বা বাবার নিজের বলা কথাকেই আবারো অন্যভাবে তার মানে বুঝিয়ে দিয়ে আমাদেরকে শান্ত করেছিল। দূরত্ব সত্যি ই কিছু বাধা হতে পারেনা, এটা মাসির থেকেই শেখা। মাসি ই বুঝিয়েছিল শিখিয়েছিলো কিভাবে নিজের মনের সবটুকু ওই ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে উজাড় করে দেওয়া যায়, কিভাবে যা আমাদের অধরা বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, তা আসলে আমাদের কাছেই থাকে। ইচ্ছে করলেই তাকে ছোঁয়া যায়, তার বোধ করা যায়, তার অনুভূতি নিয়ে বাঁচা যায়। শুধু সেই ভাবনাটাকে অন্তরে প্রতিষ্ঠা করে রাখতে হয়। আর এই মানুষটার কাছ থেকে দেখেছি অসীম ভালোবাসার অকুন্ঠ বোধ। মাসি নিজে মুখে কখনো বলে দেয়নি কিন্তু তার ওই ধীর স্থির ভাবে চলা, সবার জন্যে সত্যি কারের ভাবা, শুধু আমি আর আমার না করে, সবার মধ্যে বাঁচা, কারোর সাথে খারাপ ভাবে কথা না বলা দেখে আমি নিজেই নিজের জীবনে শত প্রতিকূলতা আর রাগের মধ্যেও নিজেকে স্থির শান্ত রেখে এক ই ভাবে কথা বলার চেষ্টা করি। মাসি নিজে অসুস্থ। তবু শত অসুস্থতার মধ্যেও নিজের মা আর শাশুড়িকে একসাথে রেখে সেবা করে যেতে ভোলেনি। দিদা আর ঠামু দুই বৃদ্ধাই প্রায় নব্বই এর ঘর ছুঁই ছুঁই করে ইহলোকের যাত্রা সমাপ্ত করেন। আর মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত দেখতাম মাসিকে তাঁরা কিভাবে চোখে হারান। পেশায় শিক্ষিকা আমার এই মাসির দুনিয়া দেখার খুব শখ। ঘুড়েছেও কম নয় একসময়। কিন্তু শরীরের জন্যে আজ সে একেবারেই শয্যাশায়ী। এই লেখাটা মূলত তাঁকে উজ্জীবিত করার জন্যেই আমার লেখা। এই বোনঝিটি তাঁর খুব কাছের। কত সিক্রেট প্ল্যান তাদের, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন। সে পঁচিশে বৈশাখ হোক বা নাহোক। এই দিল্লিবাসীনি যেদিন ই আসবে মাসির কাছে, বাড়ির ছাদে সেদিন বসবে গানের আসর। ফুলে ফুলে সাজানো হবে চারিদিক। গন্ধরাজ, জুঁই, বেল, রজনীগন্ধা। আর চাঁদনী রাত হতে হবে সেদিন। আমাদের আর এক বন্ধু এর সঙ্গী। অল ইন্ডিয়া রেডিওর চৈতি, আমার এক বোন। আমরা দুজনে মিলে সেদিন সবকিছু সাজাবো যতনে, অমূল রতনে আর দেখবো এভাবেই অধরা মাধুরী কে বাঁধা যায় কিনা ছন্দ বন্ধনে। জীবনে আমার এই মাসির মতন এইরকম কিছু মানুষের খুব দরকার যারা যে কোনো পরিস্থিতেই ভেঙে না পরে, আমাদের চারপাশের প্রকৃতির রূপ রং রস মাধুরী আরো বেশি করে গ্রহণ করে তার মধ্যে জীবনের রসদ খুঁজে পায়। এদের দেখে আমরা, যারা অল্পেই অস্থির, দিশেহারা, তারা নিজেদের আবার স্থির করতে পারি। বাঁধতে পারি। আর মাসির কথাতেই মাসির সম্পর্কে বলা শেষ করে বলি, ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে দুহাত জড়ো করে আবারো বলতে পারি, ঠাকুর আমায় স্থির রেখো, আমি যেন দিকভ্রান্ত না হয়ে পড়ি, নিজেকে যেন সত্যি আর সুন্দরের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, এই জোড় দাও মনে। কি সুন্দর এই চাওয়া, বাড়ি নয়, গাড়ি নয়, বিষয় এর নেশা নয়, এক নিষ্কলুষ চাওয়া আমি সবসময় আমার পরিবারের মধ্যে দেখেছি। যে চাওয়ার বোধ, পারিপার্শিক বৈষয়িক সকল চাওয়ার বোধ থেকে অনেক ওপরে আমাকে উন্নীত করেছে। প্রার্থনা করি ঘরে ঘরে এইরকম মাসি পিসি মা এর উদাহরণ তৈরি হোক, আরো।
এর পরে আমার জীবনের চতুর্থ আর এক গুরুত্বপূর্ণ মহিলাকে আমি পাই, তিনি হলেন আমার শাশুড়িমা। খুব গর্ব করেই বলতে পারি যে শাশুড়ি বৌ এর সম্পর্ক সাধারণত যেমন তিক্ত হয়, সেইরকম আমাদের কোনোদিন ই হয়নি। বরং একটা মিষ্টি সম্পর্ক যেখানে মা তার মেয়েকে শাড়ি কেনার আবদার করতে পারে বা কেন তার বৌমা টি সাজেনা এমন অনুযোগ করতে পারে। ছেলে বৌ এর কাছ থেকে ফেরার সময় চোখের জলে ভাসায় আবার নিজেকে ছেলেকে হাঁরে , ও কত কাজ করে তুইও তো একটু ওকে হেল্প করতে পারিস এমন বলতে পারে।  এ হেন্ মানুষকে শ্রদ্ধা না করে আমি পারিনা। বাইরে তিনি খুব একটা যাননি। ঘরের ভেতরেই তাঁর দুনিয়া শুরু ও শেষ হয়েছে, তবু এমন আধুনিক মনষ্কতা কজন মা এর মধ্যে পাওয়া যায়, আমি জানিনা, তবে আমি তো এই একজনকেই দেখেছি। এনার কাছ থেকে আমি শিখেছি সংসারের মূলমন্ত্র- ভালোবাসা। কিভাবে এই একটা জিনিসের ভিত্তি প্রস্তর দিয়ে সমস্ত সংসার নামক ইমরাতটিকে সযত্নে সোজা রাখা যায় সেটা। কার কি খাবার কখন দরকার, কখন ভালোলাগে বা কিভাবে তাকে সেটা ঠিক সময়ে দেওয়া যায়, এসমস্ত এমন ভাবেই তিনি বুঝে যান বা এতবছর বুঝে গেছেন যার ফলে তাঁর ছেলেরা কখনো খিদে কি বা ভালো খাবার এর অভাব কাকে বলে তার সেই বোধটা থেকেই বঞ্চিত থেকে গেছে।
আর সবার শেষে বলি  আমার ছেলেবেলার সাথী, আমার সব কাজের ভাগীদার আমার থেকে মাত্র পাঁচ বছরের বড় আমার সহোদরা। আমার দিদির কথা। আমাদের বাড়ির প্রথম সন্তান। স্বাভাবিকভাবেই খুব ই আদুরে। ফর্সা টুকটুকে বই মুখে করে বসে থাকা, জেদি সুন্দরী সেই মেয়ে, যাকে জীবন সঙ্গিনী করে পাবার জন্যে আক্ষরিক অর্থেই হাপিত্যেশ করে বসে থেকেছে বহুজন। কিন্তু ওই যে, পারিবারের শিক্ষায় সেদিকে কোনোদিন ঘুরে তাকানোর কথা মনেও আসেনি। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে সম্পূর্ণ অন্য আদর্শবাদী এক পরিবার এর সাথেই যখন বৈবাহিক সূত্রে বাঁধা পারলো সে, এবং পদে পদে যখন দেখি এতদিনের শিক্ষা সম্মান ছোটথেকে বড় হবার সেই আদর্শবোধ গুলো পদে পদে দলিত হচ্ছে, হচ্ছে চুরমার। তখন আমার বহুবার ভীষণ রাগ হয়েছে, মনে হয়েছে চিৎকার করে বলি, দিদি এখুনি চলে যায় তুই আমার কাছে। কিন্তু না ওই যে বলেছিলামনা? জেদি? সেই জেদী আমার দিদি শিরদাঁড়া সোজা রেখে, হেরে না গিয়ে লড়াই শুরু করলো। কিন্তু লড়াইটা কিসের? আজকের দিনে আমাদের জেনারেশন খুব কষ্টে যা ভাবতে পারে, তার লড়াই, বলতে গিয়ে আমার হাসিও পাচ্ছে, রাগ ও হচ্ছে। একটা চরম বিপরীত আদর্শবাদের পরিবারকে তাদের মতো করে ভালোবাসে, ভালো থাকার লড়াই।  তার জীবন যাত্রা থেকে আমি বুঝেছি সহ্য করা কাকে বলে, বুঝেছি প্রতিটা মানুষের নিজের স্বত্বা বাঁচিয়ে রাখা কতটা দরকার। দেখেছি কিভাবে একজন মেয়ে, শুধুমাত্র নিজের ওপরে ভরসা রেখে আর সংসারের ওপর মায়ায় সব কিছু সহ্য করে নিতে পারে। সবকিছু সহ্য করা ভুল কি ঠিক সে তর্ক থাক নাহয় এখন। হয়তো ঠিক নয়, হয়তো বা....জানিনা। তবে এইরকম মানুষ গুলো এখনো আছে বলেই অলিভিয়া স্পিনোলা রা বলতে পারে, তোমরা ? ইন্ডিয়ান মেয়েরা? সবাই এত নরম? সবার এত সহ্যশক্তি? তোমরা স্বামী সন্তান সংসারের জন্যে নিজেদেরকে নিঃশব্দে বলি দিতে পারো? আর আমি মুখটিপে হেসে বলতে পারি, এ তো কিছুইনা স্পিনোলা, আমাদের মেয়েরা আরো অনেক অনেক কিছু পারে, যা দিয়ে তারা বিশ্ব সংসারকে এক অন্যান্য জোড় এ বেঁধে রাখতে পারে, হিংসা নয়, রাগ নয় ঝগড়া নয়। শরীরী আবেদন নয়, ভালোবাসার অভিনয় নয়। সত্যিকারের প্রেম, সত্যি ভালোবাসা, অমোঘ কর্তব্যবোধ আর মায়া। এ আমাদের রক্তে , মজ্জায়।
পরিশেষে বলি, আমি খুব সাধারণ বাড়ি থেকে বড় হয়ে ওঠা একজন মানুষ। এই দিল্লির বুকে চারিদিকে যখন অজস্র অসহিঞ্ষুতা আর মূল্যবোধের অভাব দেখি, তখন খুব বেশি  করে অনুভব করতে পারি, সঠিক বোধ নিয়ে মানুষের মতো করে বড় হবার কি অর্থ। সেই অর্থে আমি মানুষ হতে পেরেছি কিনা জানিনা, কিন্তু চারপাশের যে সব মানুষগুলোর জীবনাদর্শ আমাকে এখনো হয়ত বা ভবিষ্যতেও মাথা উঁচু করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে, খুব ইচ্ছে করলো তাদের সেই জীবনাদর্শের কথা সবার সামনে আনতে। কারণ এখন সময় আমাদের দেখে, শিখে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের এগিয়ে চলার। ওই যে কথায় আছেনা "If you want to change the world, start off by making your bed" তাই সেকথা মনে রেখেই আমার ঘরের আঙ্গিনা থেকেই শুরু করলাম মূল্যবোধের দৃষ্টান্ত। মানুষ হবার প্রথম বুনট। 

Tuesday, 19 February 2019

এখনো সেই আগের মতন

যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করো কি দরকার,
বলবো দরকার কিছুই না।
তবু বিনা দরকার যে কখনো কখনো খুব বেশি দরকারি কিছু হয়ে ওঠে।
তেমন ই
এই পড়ন্ত বিকেলের লাল প্রাণবন্ত আকাশ ,
যখন মনখারাপের মেঘে মুখ ঢাকে ,
তখন আজ ও আমার কান্না পায়।
আজ ও ওই লাল আকাশ এক ই ভাবে আমাকে প্রাণ দিয়ে যায় -
ভরা জ্যোৎস্না তে অজানা আনন্দে আজ ও মন ওঠে দোলে ,
কৃষ্ণচূড়া আজ ও এক ই ভাবে যায় ডেকে ,
আর জোনাকি এক ই ভাবে বাসে ভালো।

Sunday, 27 January 2019

হটাৎ বৃষ্টি

দ্যাখো দেখি এমন শীতের দুপুরে, একরাশ কাজের মাঝে আবার একি বিড়ম্বনা
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি যে
মন কে যখন বুঝিয়ে সুঝিয়ে কাজের মধ্যে রাখা
এমন সময় ঘন কালো মেঘে এই মেঘের গুরুগুরু যে সব কাজ ভুলিয়ে দিলো
 কি যে করি
অগত্যা
এসে দাঁড়ালাম আমার অকাজের এই বারান্দাটায়
শীতের মাঝে যাতে বৃষ্টিতে ভিজে না যাই,
সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি আসছিলাম বাড়ির নিশ্চিন্তের আশ্রয় টা পাবো বলে
আর যেই পেলাম
অমনি সেই বৃষ্টির ছিটে টাকেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলো
এক ই অবাধ্যতা মনের
ক্ষনে ক্ষণে একি পরিবর্তন
কোথায় যেন হারিয়ে গেল হিসেব  নিকেশ
অনেক দিন পরে আবার নাকে এলো সেই সোঁদা গন্ধটা
বৃষ্টির জোলো হাওয়া শীতের কাঁপুনি নিয়ে এক অদ্ভুত শিহরণ এনে দিলো
মনে পড়লো বেশ কয়েকটা দিন হলো আমার বুড়ো লোকটার গান শোনা হয়নি
কত্তদিন হয়ে গেল শেষের কবিতা অভিমানে মুখ লুকিয়ে পরে আছে
আর সব বইয়ের মাঝে
কেমন যেন একটা অবহেলা আর অনাদরে
যেসুরটা সেদিন ঠিক ভাবে বাজেনি,
তাকে আর যত্নে আনা হয়নি আমার বেহালার ছড়ে
কতদিন হয়ে গেল ছাদের আলসে বেয়ে চলা
সেই সবুজ পাতার নরম টাকে ছুঁয়ে দেখা হয়নি
কোথায় আর কিকরে যেন ভুলেছিলাম কত অঙ্গীকার
অসমাপ্ত হয়ে থাকা সেই ফসিল এর ভেতরে লুকিয়ে থাকা
আশ্চর্য্য কাহিনীকে জানার যে আকুলতা একদিন
আমার দিনের সমস্ত কাজকে জড়িয়ে থাকতো
জীবিকার জন্যে সে কেন হলো আমার অবহেলার শিকার


সামনে গাছ গুলো এখন প্রকৃতির প্রলয় এর সাথে তাল মিলিয়ে মাথা দুলিয়ে মেতেছে
সেই তাল হটাৎ যেন আমার আমির ছন্দ টাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেল
কোথায় হারিয়ে ছিল সে...
হটাৎ যেন হারিয়ে যাওয়া সবকটা বোধ খুঁজে পেলো
অবিনশ্বর সেই শান্তির বাণী
আমার রোজের কর্তব্যের সাথে যা আছে জড়িয়ে
আমার আমিকে যা প্রতিনিয়ত রাখে ভরিয়ে
সেই গভীর অমৃত বোধ এই অকাল বৃষ্টির সাথে সাথে
সমস্ত গ্লানি কে ধুইয়ে দিয়ে
যেন কি এক অসামান্য আনন্দে উঠলো গেয়ে
কি আনন্দ কি আনন্দ কি আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ


Sunday, 6 January 2019

ব্যাপ্তি

বেশ অনেকগুলো দিন পরে, আবার এই সময় টাতে আমার অকাজের জায়গা বা আমার খুব নিজের জায়গাটা খুলে বসলাম। আগে, ২০১৮ এর অনেকটা সময় বিশেষ করে, ওই যে মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন ...এই সময় ১০টা নাগাদ রাতের খাওয়া শেষ করে, দিনের কাজ গুলো গুছিয়ে রেখে, সেদিনের মতো সব কাজ শেষ করে এসে বসতাম আমার এই মোহনার ধারে, সারাদিনের রোজনামচা লিখে রেখে তবে শুতে যেতাম। আর চোখ থাকতো স্ক্রিন এর ওপরে, ডানদিকে গুগল+ এর নোটিফিকেশন এর ওপরে, ওই যে লাল হয়ে যেটাতে লেখা থাকতো, সেইদিনের কোনো বিশেষ বার্তা এলো কি এলো না, এইভাবেই আমার কাজের সময়ের কিছুটা চুরি করে আমি সযত্নে দিয়ে রাখতাম এই মোহনার ধারে বসার জন্যে। আর মনের মধ্যে থাকতো এক অনন্য অস্ফুট অপেক্ষা। এই মোহনার ধারের অদ্ভুত ওই নোনা হাওয়ায় যেন আমায় সত্যি এক স্বপ্নরাজ্যে নিয়ে যেত। 

কাটলো একটা বছর। সময়ের আড়ালে আবডালে, আদোরে আবদারে, বাস্তব আর স্বপ্নের মেল্ বন্ধনে অনস্বীকার্য পরিবর্তনের আলতো ছোঁয়ায় পুরোনো কিছু সময় বারবার উঁকি দিয়ে যেতে থাকলো। এ এক মহা মুশকিল আমার, স্মৃতিশক্তি টা বাবার আনুকূল্যে ছোটথেকে একটু বেশিমাত্রায় প্রখর। কোনোকিছুই ভুলিনা ছাই। তার ওপর আবার আছে commitment আর consistency এর জ্বালা। একবার কোনো অভ্যাসে পেয়ে বসলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে রীতিমতো নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। করছিলাম ও এই কয়দিন ধরে। সমাধান পেলাম ওই যে সেই একটাই জায়গায়। লাল শাড়ি তে গাঢ় ঘন হয়ে আসা সন্ধের শাঁখ ঘন্টা ধুপ ধুনো আর ঢাকের শব্দের মধ্যে দিয়ে সেই আমার পরম শান্তির জায়গা থেকে ভেসে আসা অমোঘ আশ্বাস, যা বহুবার বহুরকম ভাবে আমাকে আগলে রেখেছে। সেই জায়গা। সেখান থেকে কিছুটা বকুনি ই খেলাম যেন, যেন মনে হলো, আবার তুই এসব ভাবতে বসলি বুঝি? মনখারাপ এর সব আয়োজন তোমার নিজের ই করা। খুব বোধয় ভালোলাগে? মনখারাপ করতে? বলেছি না সব কিছু কালের নিয়মে ছেড়ে দিতে। এইরকম ই কত কি। চারপাশে তখন ঘোর লাগানো নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু ওই সন্ধ্যারাতির একটানা অবিরাম ব্যাপ্তিহীন শব্দ আমার বুকের মধ্যে উথাল পাথাল লক্ষ দামামার শব্দকে খুব ধীরে ধীরে শান্ত করে দিলো। 

চোখের সামনে রইলো শুধু জ্বলজ্বলে ওই ত্রিনয়ন, গলায় লাল জবা আর অপরাজিতার মালা, আর চারপাশে ধুপ ধুনো কর্পূরের গন্ধ। আমাদের বোঝার বাইরে, আমাদের জানার আড়ালে প্রতিনিয়ত আমাদের নিয়তিকে যে অসীম শক্তি পরিচালনা করে চলেছে, সেই শক্তির অনুভূতি আমাকে যেন কি নিশ্চিন্তের এক জায়গা দিয়ে গেল। তাকে বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। তাকে শুধু বোধহয় অনুভূত করা যায়। আপনা হতেই সেই শক্তির কাছে হাত জড়ো হয়ে যায়, মাথা নত হয়ে যায়, ভালোবাসা আর আর ভক্তি কখন যেন এক হয়ে সমস্ত ভয় ভাবনা কে চোখের জলের সাথেই ভাসিয়ে দিয়ে আত্মবিশ্বাস এ পরিপূর্ণ করে দিয়ে যায়। সীমাহীন কে সীমার মধ্যে, আমাদের একান্ত আপনার করে ধরে রাখার কি অমোঘ সৌন্দর্য্য, কি অসীম পরিতৃপ্তি, কি অপার শান্তি, কি অসীম ব্যাপ্তি। 

ইচ্ছেনদী

আমার ল্যাব টা মাউন্ট sinai এর ১০ তলায়, আর আমার ওয়ার্কিং ডেস্কটা একদম জানালার ধারে , বিশাল জানালা। মনে হয় মেঘ গুলো এখুনি ঢুকে পড়বে এর মধ্যে। ...